পুঁজির দানবের বিরুদ্ধে লড়ছিলেন বলেই কি গ্রেফতার সোনম ওয়াংচুক?

Ladakh Activist Sonam Wangchuk Detained: যে-স্কুলটি তিনি প্রতিষ্ঠা করেছেন সেই স্টুডেন্টস এডুকেশনাল অ্যান্ড কালচারাল মুভমেন্ট অব লাদাখ (SECMOL) সম্পূর্ণভাবে সৌরশক্তিচালিত।

“অল ইজ ওয়েল”— কে না শুনেছে 'থ্রি ইডিয়টস' ছবির এই বিখ্যাত গান! কিন্তু যাঁর জীবন নির্ভর করে নির্মিত থ্রি ইডিয়টস ছবির র‍্যাঞ্চো চরিত্রটি, সেই সোনম ওয়াংচুকই কিন্তু ২৩ জানুয়ারি ২০২৩-এ প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদিকে একটি এসওএস করে জানান, “অল ইজ নট ওয়েল ইন লাদাখ”। কাজের কাজ তেমন কিছুই হয়নি তাতে। আর তাই গান্ধীকে স্মরণ করে বারে বারে অনশনে বসতে হয়েছে সোনমকে। প্রতিবারই তাঁর অনশনগুলি নানা প্রশ্নের মুখে ফেলে দিয়েছে কেন্দ্র সরকারকে। তাই এবার সরকার প্রতিশোধ নিল সোনম ওয়াংচুককে জাতীয় নিরাপত্তা আইনে গ্রেফতার করে। লাদাখ পুলিশের ডিজি এসডি সিংহ জামওয়ালের নেতৃত্বে বিশাল পুলিশবাহিনী ওয়াংচুককে তাঁর লেহর বাড়ি থেকে গ্রেফতার করে। সোনমের স্ত্রী জানিয়েছেন, সোনমের সঙ্গে একজন ঘৃণ্য অপরাধীর মতো ব্যবহার করেছে পুলিশ। তছনছ করে দেওয়া হয়েছে তাঁদের বাড়িটিও। এর আগেই অবশ্য বিদেশি অনুদান নিয়ন্ত্রণ আইন (ফরেন কনট্রিবিউশন রেগুলেশন অ্যাক্ট বা এফসিআরএ) লঙ্ঘনের অভিযোগে সিবিআই তদন্ত শুরুর পাশাপাশি সোনমের সংস্থা ‘স্টুডেন্টস এডুকেশনাল অ্যান্ড কালচারাল মুভমেন্ট অফ লাদাখ’ (এসইসিএমওএল)-এর এফসিআরএ লাইসেন্স বাতিল করা হয়েছিল।

জাতীয় নিরাপত্তা আইনে কেন গ্রেফতার করা হল সোনম ওয়াংচুককে? কী তাঁর অপরাধ? লাদাখে অশান্তি এবং প্রাণহানির ঘটনার তিনিই নাকি মূল কারণ! তাঁর বক্তৃতার ফলেই নাকি অশান্ত হয়েছে লাদাখ! অতীতের মতোই এবারও নির্দিষ্ট কিছু দাবি নিয়ে অনশনে বসেছিলেন সোনম ওয়াংচুক। বিশেষ করে তরুণ প্রজন্মের পক্ষ থেকে পাচ্ছিলেন বিপুল সমর্থন। অনশনটি কেবল আর তাঁর একার অনশন ছিল না। ক্রমেই চেহারা নিচ্ছিল এক গণআন্দোলনের। বুধবার লাদাখের এই আন্দোলন সহিংস রূপ নেয়, যেখানে বিক্ষোভকারীরা— মূলত জেন জিরাই— লেহ-তে বিজেপি অফিস ও হিল কাউন্সিলে পাথর ছোড়ে এবং একটি সিআরপিএফ গাড়িতে আগুন ধরিয়ে দেয়। এই হিংসার মূল কারণ হিসেবেই গ্রেফতার হয়ে গেলেন সোনম। অথচ আন্দোলন সহিংস হয়ে ওঠার সঙ্গে সঙ্গেই সোনম অনশন বন্ধ করেন এবং আন্দোলনকারীদের লাদাখে শান্তি বজায় রাখার জন্য আবেদন জানান।

বোঝাই যাচ্ছে যে, সোনমকে শিক্ষা দেওয়ার জন্য একটি সুযোগের অপেক্ষায় ছিল কেন্দ্র সরকার। কিন্তু কেন? কারণ ক্রোনি ক্যাপিটালিজিমের বিরুদ্ধে দীর্ঘদিন ধরে লড়াই করে চলেছেন সোনম ওয়াংচুক। আদানিদের সামনে হয়ে উঠেছিলেন চিনের প্রাচীর। তাই এই লোকটিকে কারাগারে নিক্ষেপ করা অত্যন্ত প্রয়োজনীয় হয়ে উঠেছিল।
থ্রি ইডিয়টস-এর র‍্যাঞ্চোর মতোই লেহ-লাদাখে কিন্তু আক্ষরিক অর্থেই বিপ্লব এনেছেন ম্যাগসাইসাই পুরস্কার-প্রাপ্ত সোনম। তাঁর হিমালয়ান ইনস্টিটিউট অব অল্টারনেটিভস (HIAL) ধারাবাহিকভাবে কাজ করে চলেছে ওই অঞ্চলের প্রকৃতিকে রক্ষা করার জন্য। যে-স্কুলটি তিনি প্রতিষ্ঠা করেছেন সেই স্টুডেন্টস এডুকেশনাল অ্যান্ড কালচারাল মুভমেন্ট অব লাদাখ (SECMOL) সম্পূর্ণভাবে সৌরশক্তিচালিত। শুধু রান্নাবান্না নয়, কোনো কাজেই এই স্কুলে কোনো জীবাশ্ম জ্বালানি (ফসিল ফুয়েল) ব্যবহার করা হয় না।

আরও পড়ুন- সোনম ওয়াংচুক গ্রেফতার জাতীয় নিরাপত্তা আইনে! কী এই আইন?

প্রথাগত শিক্ষাব্যবস্থা যাদের ব্যর্থ বলে দাগিয়ে দেয়, সেই সমস্ত শিশু এবং যুবকদের সাহায্য করার জন্য  ১৯৮৮ সালে সোনম প্রতিষ্ঠা করেছিলেন SECMOL। শুধু শিশু আর যুবকই নয়, ওই অঞ্চলের সাধারণ মানুষের জন্যও সোনম কাজ করে গেছেন নিরন্তর। কাদামাটি দিয়ে তিনি নির্মাণ করেছেন স্বল্পমূল্যের সৌর-তপ্ত বাড়ি, যা লাদাখের মানুষদের প্রবল শীতে হয়ে উঠেছে রক্ষাকবচ। একইভাবে তিনি ২০২১ সালে পরিবেশবান্ধব সৌর-তপ্ত তাঁবুও তৈরি করেন, যা ভারতীয় সেনারা সিয়াচেন ও গালওয়ান ভ্যালির তীব্র ঠান্ডায় ব্যবহার করেন। অর্থাৎ, রাষ্ট্রের অ্যাপারেটসকেও সাহায্য করেছেন সোনম। অথচ তাঁকে গ্রেপ্তার করা হল জাতীয় নিরাপত্তা আইনে!

বলে রাখা ভালো যে, তাঁকে গ্রেফতার করার পর লাদাখ অ্যাপেক্স বডি (LAB) পরিষ্কার জানিয়েছে, লাদাখের হিংসার জন্য কোনোমতেই সোনম দায়ী নন। শেরিং দরজে লাকরুক, যিনি লাদাখ বুদ্ধিস্ট অ্যাসোসিয়েশনের সভাপতি এবং লাদাখ অ্যাপেক্স বডির সহ-পরিচালক, তিনি বলেছেন, “মিস্টার ওয়াংচুক প্রতিবাদকারীদের উসকে দিয়েছেন বলে যে-কাহিনি নির্মাণ করা হচ্ছে, তা ভুল”। কী কী দাবি নিয়ে অনশনে বসেছিলেন সোনম? লাদাখের জন্য বিশেষ মর্যাদা ও রাজ্যের স্বীকৃতি, সংবিধানের ষষ্ঠ তফশিলের বাস্তবায়ন, লাদাখের ‘ভঙ্গুর’ পরিবেশব্যবস্থার সুরক্ষা, লাদাখ ও কারগিলের জন্য পৃথক সংসদীয় আসন এবং লাদাখের জন্য পৃথক পাবলিক সার্ভিস কমিশন। এই একটি দাবিও কিন্তু অযৌক্তিক নয়। এর মধ্যে লাদাখে সংবিধানের ষষ্ঠ তফশিলের বাস্তবায়নের দাবিটি সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ। সংবিধানের ষষ্ঠ তফশিল, অনুচ্ছেদ ২৪৪-এর উদ্দেশ্য হল “কিছু নির্দিষ্ট আদিবাসী এলাকার প্রশাসনকে স্বায়ত্তশাসিত সত্তা হিসেবে নিশ্চিত করা।” আসাম, মেঘালয়, ত্রিপুরা ও মিজোরামের আদিবাসী এলাকায় এটি ইতিমধ্যেই কার্যকর রয়েছে।

এর আগে যখন অনশনে বসেছিলেন সোনম, তখন অনশনের কারণ বলতে গিয়ে তিনি বলেছিলেন, “কেন এই অনশন? সত্যের জন্য, পরিবেশের জন্য, আর গণতন্ত্রের জন্য। এই (তফশিল) বিশেষভাবে তৈরি পাহাড়ি অঞ্চলের জন্য, যেখানে স্বতন্ত্র স্বদেশি আদিবাসী সম্প্রদায় রয়েছে। সাধারণত, ৫০ শতাংশ আদিবাসী জনগোষ্ঠী থাকলেই এর জন্য যোগ্যতা অর্জন করা যায়, কিন্তু লাদাখে আছে ৯৭ শতাংশ। সুতরাং আমরা এই তফশিলের জন্য নিঃসন্দেহে যোগ্য।” এই তফশিল কায়েম হলে, লাদাখে পরিবেশ ধ্বংস করে ক্রোনি ক্যাপিটালিজমের ইচ্ছে মতো উন্নয়নের কাজকর্ম চালিয়ে যাওয়া যাবে না। সেখানে সহজেই জমি কিনতে পারবে না আদানির মতো কর্পোরেট সংস্থাগুলি। সোনমের ওপর কেন্দ্র সরকারের রাগের কারণটি এতক্ষণে নিশ্চয়ই নিশ্চিত বুঝে ফেলেছেন পাঠক।

আরও পড়ুন- কেন লাদাখে ছয় বছরের শান্তিপূর্ণ আন্দোলন হঠাৎ হিংসার রূপ নিল?

উন্নয়নের প্রসঙ্গে উল্লেখ করতে হয় যে, এই মুহূর্তে লাদাখে পরিবেশ ধ্বংসকারী একাধিক তথাকথিত ‘উন্নয়ন প্রকল্প’ চালু রয়েছে। এর মধ্যে রয়েছে পুগা ভ্যালিতে ওএনজিসির প্রস্তাবিত ভূ-তাপবিদ্যুৎ কেন্দ্র, এনটিপিসি-র স্থাপিতব্য সবুজ হাইড্রোজেন ইউনিট, লাদাখ থেকে হরিয়ানায় বিদ্যুৎ সরবরাহের জন্য সৌরবিদ্যুৎ-চালিত বিদ্যুৎব্যবস্থা এবং সিন্ধু নদে আরও ৭টি জলবিদ্যুৎ প্রকল্প। বিদ্যুৎ সঞ্চালন লাইন বসানোর জন্য ১৫৭ একর বনভূমি কেটে ফেলার আয়োজনও শুরু হয়েছে। এই প্রকল্পগুলির পাশাপাশি সেনাবাহিনীর উদ্যোগে রাস্তা নির্মাণের মতো অন্যান্য উন্নয়নমূলক কাজও চলছে। এই তথাকথিত উন্নয়নের ‘মহাযজ্ঞ’ নিয়েই প্রশ্ন তুলেছেন সোনম। তাঁর সঙ্গে রয়েছেন লাদাখবাসীরাও। কারণ, তথাকথিত উন্নয়নযজ্ঞের ফলে ওই এলাকার প্রাকৃতিক সম্পদ— যেমন বোরাক্স, সোনা, গ্রানাইট, চুনাপাথর ইত্যাদি, ধীরে নি:শেষিত হয়ে যাচ্ছে, চলে যাচ্ছে কর্পোরেটের হাতে। এই প্রসঙ্গে কী বলেছেন সোনম? বলেছেন, “আমাদের যাযাবররা দক্ষিণে ভারতের বৃহৎ শিল্পপ্রকল্প আর উত্তরে চিনা অনুপ্রবেশের কারণে পশুচারণের জন্য প্রধান জমিগুলি হারাচ্ছে। এই সরকার ভারতকে ‘গণতন্ত্রের জননী’ বলতে ভালোবাসে। কিন্তু যদি ভারত লাদাখের জনগণকে গণতান্ত্রিক অধিকার থেকে বঞ্চিত করে এবং একে নতুন দিল্লি থেকে নিয়ন্ত্রিত আমলাদের অধীনে রাখে, তাহলে লাদাখের ক্ষেত্রে এই সরকারকে কেবলমাত্র ‘গণতন্ত্রের সৎমা’ই বলা যেতে পারে।” খুব কি ভুল কথা বলেছেন সোনম?

থ্রি ইডিয়টস সিনেমায় র‍্যাঞ্চোর শ্রেষ্ঠত্ব স্বীকার করে নিয়ে চতুর বলেছিল “তুসি গ্রেট হো”। ভারত সরকারের উচিত অবিলম্বে সোনমকে মুক্ত করা। তা না হলে যে-বিক্ষোভ আজ লাদাখে সীমাবদ্ধ, তা গোটা ভারতের ছড়িয়ে যেতে পারে। গোটা ভারতই কিন্তু ইতিমধ্যেই সোনম ওয়াংচুককে বলতে শুরু করেছে, “তুসি গ্রেট হো”।

More Articles