রাজপাট অসমাপ্ত, পূর্বসূরিদের মতোই নাটকীয় ইমরানের সমাপতন
উত্তরাধিকার সূত্রে কর্তৃত্ব স্থাপনের অধিকার পরখ নয়, বিশ্ব-মানচিত্রে পাকিস্তানকে পুনঃপ্রতিষ্ঠা করার উচ্চাকাঙ্ক্ষা নিয়ে এসেছেন। বাইশ গজ ছেড়ে রাজনীতির ময়দানে পদার্পণকে এ ভাবেই ব্যাখ্যা করেছিলেন। কিন্তু সেই উচ্চাকাঙ্ক্ষার চরম মাশুল দিতে দিতে গিয়ে মুখ লুকিয়ে রাজধানী ছাড়তে হল ইমরান খানকে। সবুজ শরীরে ক্রিকেট শাসন করতেন এককালে। কিন্তু রাজনীতি রাতের অন্ধকারে মুখ লুকিয়ে পালাতে বাধ্য করল তাঁকে। তাই নয়া ‘নয়া পাকিস্তান’-এর ভিতপুজো তো দূর, বরং প্রধানমন্ত্রীর চেয়ার থেকে নেমে যেতে হল মাঝপথেই।
মহম্মদ জিয়া উল হক, নওয়াজ শরিফ, পারভেজ মুশারফ, ইমরানের জনপ্রিয়তাকে কাজে লাগাতে চেয়েছিলেন অনেকেই। কিন্তু সন্তর্পণে রান আপ থেকে ব্যাটসম্যানের গতিপ্রকৃতি মেপে নেওয়ার অভ্যাস ঢের আগেই রপ্ত করে ফেলেছিলেন তিনি। তাই বল বয় নয়, পাক রাজনীতিতে আম্পায়ার হতে এগিয়েছিলেন। নিজের দল গড়ে একেবারে তৃণমূল স্তর থেকে শুরু করেছিলেন জমি মাপার কাজ। প্রাথমিক ধাক্কা কাটিয়ে বিপুল সাফল্য পেয়েছিল সেই প্রচেষ্টা। কিন্তু সব পেয়েও ধরে রাখতে পারলেন না তিনি। বরং যা কোনও কালেই হতে চাননি, সেই ‘হেরো’দের দলেই নাম উঠল তাঁর।
আগামী দিনে ইমরান কী করবেন, তার উত্তর এখনও অধরা। কিন্তু আপাতত স্বাধীনতার ৭৫তম বর্ষে ২২তম ব্যর্থ প্রধানমন্ত্রী হয়েই নাম লিপিবদ্ধ হল তাঁর। অর্থাৎ, পূর্বসূরিদের মতোই প্রধানমন্ত্রী পদে নিজের কার্যকাল সম্পূর্ণ করতে পারলেন না তিনি। শুধু তাই নয়, জোর করে ক্ষমতা ধরে রাখতে গিয়ে দেশের অ্যাসেম্বলি থেকে আক্ষরিক অর্থেই বিতাড়িত হতে হল তাঁকে, যা পাক রাজনীতির ইতিহাসে আগে কখনও ঘটেনি।
১৯৪৭ সালে স্বাধীন দেশ হিসেবে আত্মপ্রকাশের পর ২২ বার নির্বাচিত প্রধানমন্ত্রী পেয়েছে পাকিস্তান। ইমরান ছিলেন ২২তম। এর আগে দেশের কোনও প্রধানমন্ত্রীই কার্যকালের মেয়াদ সম্পূর্ণ করতে পারেননি। মাঝপথে ফাঁসি দেওয়া হয়েছে কাউকে, তো কেউ আবার খুন হয়েছেন। দুর্নীতির অপবাদ নিয়েও কুর্সি ছাড়ার উদাহরণও রয়েছে একাধিক। লিয়াকৎ খান থেকে ইমরান, এ বারও তার অন্যথা হল না। বরং স্বাধীনতার ৭৫তম বর্ষে আরও এক ‘অসফল’ প্রধানমন্ত্রী পেল পাকিস্তান।
আরও পড়ুন-পাকিস্তানের ভবিষ্যত কোন পথে?
লিয়াকৎ আলি খান: অবিভক্ত ভারতে ইংরেজ বিরোধী আন্দোলনে সামিল ছিলেন। ১৯৪৭ সালের ১৫ অগস্ট পাকিস্তানের প্রধানমন্ত্রী হন। কিন্তু মসনদে মাত্র চার বছর দু’মাসই টিকে থআকতে পেরেছিলেন। ১৯৫১ সালের ১৬ অক্টোবর মুসলিম লিগের একটি সভায় রাওয়ালপিন্ডিতে খুন হন।
স্যর খোয়াজা নিজামউদ্দিন: পাকিস্তানের দ্বিতীয় প্রধানমন্ত্রী। ১৯৫১ সালের ১৭ অক্টোবর দায়িত্বগ্রহণ করেন। দু’বছরেরও কম সময় মসনদে ছিলেন। সাম্প্রদায়িক দাঙ্গা, অব্যবস্থার জেরে তৎকালীন গভর্নর জেনারেল গোলাম মহম্মদ পদত্যাগের নির্দেশ দেন তাঁকে। নির্দেশ না মানায় ১৯৫৩ সালের ১৭ এপ্রিল অপসারিত হন।
মহম্মদ আলি বোগরা: ১৯৫৩-র ১৭ এপ্রিল দায়িত্বগ্রহণ করেন। ১৯৫৫-র ১২ অগস্ট অপসারিত হন। তাঁকে পদ থেকে সরান তৎকালীন গভর্নর জেনারেল ইস্কান্দর মির্জা। বিভিন্ন প্রদেশ নিয়ে দু’জনের মধ্যে টাানপোড়েন চলছিল।
চৌধরি মহম্মদ আলি: ১৯৫৫ সালের ১২ অগস্ট দায়িত্বে আসেন। দেশের সংবিধানের প্রথম রূপকারও তিনিই। কিন্তু দলের সঙ্গে মতবিরোধে একমাসের মাথায় ১৯৫৬ সালের ১২ সেপ্টেম্বর পদত্যাগ করেন।
হুসেন শাহিদ সোহরাবর্দি: ১৯৫৬ সালের ১২ সেপ্টেম্বর পদে বসেন। ইস্কান্দর মির্জার সঙ্গে মতবিরোধের জেরে তাঁকেও পদত্যাগ করতে হয়। দায়িত্ব ছাড়েন ১৯৫৭ সালের ১৭ অক্টোবর।
ইব্রাহিম ইসমাইল চান্দ্রিগড়: মসনদে ছিলেন দু’মাসেরও কম সময়ের জন্য। ১৯৫৭-র ১৭ অক্টোবর দায়িত্ব হাতে পান। ৫৫ দিনের মাথায় পদত্যাগ করতে হয়।
ফিরোজ খান নুন: ইস্কান্দর মির্জার তত্ত্বাবধানে ১৯৫৭ সালের ১৭ ডিসেম্বর শপথ নেন। ১৯৫৮ সালের ৭ অক্টোবর তাঁকে অপসারণ করা হয়। তার পরই জেনারেল আয়ুব খান চিফ মার্শাল ল’র প্রশাসকের দায়িত্ব পান। প্রধানমন্ত্রী মনোনীত হন।কিন্তু প্রধানমন্ত্রীর দফতর এবং প্রেসিডেন্টের দফতরে মিলিয়ে দিয়ে সেনা অভ্যুত্থান ঘটান।
নুরুল আমিন: দু’সপ্তাহও নয়, মাত্র ১৩ দিন মসনদে ছিলেন। ১৩ বছরের মার্শাল ল’-র অভিশাপ কাটিয়ে ইহাইয়া খানের আমলে প্রধানমন্ত্রী হন আমিন। ১৯৭১ সালের ৭ ডিসেম্বর দায়িত্ব হাতে পান। তখন বাংলাদেশে মুক্তিযুদ্ধের ঢেউ। তাতে অংশ নেয় ভারতও। পপরাজিত হয় পাকিস্তান। তার ১৩ দিনের মাথায় ইসলামাবাদ চেড়ে বেরিয়ে যেতে হয় নুরুলকে।
জুলফিকর আলি ভুট্টো: ভুট্টো পরিবারের কুলপতি। ১৯৭৩ সালের ১৪ আগস্ট পাকিস্তানের প্রধানমন্ত্রী হন। ১৯৭৭ সালে ফের নির্বাচিত হন। কিন্তু তৎকালীন সেনা প্রধান জেনারেল মহম্মদ জিয়া উল-হকের হাতে বন্দি হন। ১৯৭৯ সালে ফাঁসিতে ঝোলানো হয় তাঁকে।
মহম্মদ খান জুনেজো: সেই সময় পাকিস্তানে সেনার কর্তৃত্ব। ১৯৮৫ সালের ২৩ মার্চ প্রধানমন্ত্রী হন। ১৯৮৮ সালের ২৯ মে তাঁর সরকারের পতন ঘটে। জিয়া উলের সঙ্গে ঝামেলায় হাতছাড়া হয় কুর্সি।
বেনজির ভুট্টো: দেশের কনিষ্ঠতম তো বটেই, বিশ্বের তাবড় মুসলিম সংখ্যাগরিষ্ঠ রাষ্ট্রকে টেক্কা দিয়ে প্রথম মহিলা প্রধানমন্ত্রী পায় পাকিস্তান। ১৯৮৮-র ৯ ডিসেম্বর দায়িত্ব গ্রহণ করেন। দুর্নীতির অভিযোগে ১৯৯০ সালের ৬ আগস্ট তাঁকে ইমপিচ করা হয়।
নওয়াজ শরিফ: তিন-তিন বার দায়িত্ব সামলেছেন। ১৯৯০ সালের নভেম্বরে প্রথম বার প্রধানমন্ত্রী হন। কিন্তু তিন বছরেরও কম সময়ের মধ্যে সরকার ভেঙে যায়, ১৯৯৩ সালের ১৮ এপ্রিল। পদত্যাক করেন জুলাই মাসে।
বেনজির ভুট্টো: দ্বিতীয় বারের জন্য পাকিস্তানের মসনদে বসা ১৯৯৩ সালের ১৯ অক্টোবর। ১৯৯৬ সালের ৫ নভেম্বর সেই দুর্নীতির অভিযোগেই ফের ছাড়তে হয় দায়িত্ব।
নওয়াজ শরিফ: ১৯৯৭ সালের ১৭ ফেব্রুয়ারি ভোটে জিতে প্রত্যাবর্তন। জেনারেল পারভেজ মুশারফের উত্থানও তাঁর আমলেই। আর মুশারফের নেতৃত্বেই ১৯৯৯ সালের ১১ ডিসেম্বর সেনা অভ্যুত্থান ঘটে পাকিস্তানে। শরিফকে সরিয়ে জরুরি অবস্থা জারি হয়।
মীর জাফরউল্লা খান জামালি: নওয়াজের দ্বিতীয় দফার পর দীর্ঘ দিন মসনদ খালি ছিল। জামালি দায়িত্ব পান ২০০২ সালের ২১ নভেম্বর। প্রশাসনিক প্রধানের চেয়ে মুশারফের অনুগতই ছিলেন বেশি। সালের ২৬ জুন তাঁকে অপসারিত হন।
চৌধরি সুজাত হুসেন: ২০০৪ সালের ৩০ জুন সংসদীয় নির্বাচনে জিতে ক্ষমতাদখল। ওই বছরই ২৭ আগস্টই শওকত আজিজের হাতে দায়িত্ব ছেড়ে বেরিয়ে যান।
শওকত আজিজ: ২০০৪ সালের ২৮ আগস্ট প্রধানমন্ত্রী হন। পদে ছিলেন ২০০৭ সালের ১৫ নভেম্বর পর্যন্ত।
ইউসুফ রজা গিলানি: ২০০৮ সালের ২৫ মার্চ থেকে ২০১২ সালের ১৯ জুন পর্যন্ত। ত্রিশঙ্কু জোট সরকারের প্রধান হন। দুর্নীতির অভিযোগে ক্ষমতা হাতছাড়া হয়।
রজা পারভেজ আশরফ: পাকিস্তান পিপলস পার্টির মনোনয়নে ২০১২ সালের ২২ জুন থেকে ২০১৩ সালের ২৪ মার্চ পর্যন্ত ক্ষমতায় ছিলেন। বিদ্যুৎ প্রকল্পে দুর্নীতির জেরে গ্রেফতার হলে ক্ষমতা চলে যায়।
নওয়াজ শরিফ: তৃতীয় দফায় ২০১৩ সালের ৫ জুন থেকে ২০১৭ সালের ২৮ জুলাই পর্যন্ত ক্ষমতায় ছিলেন। পানামা পেপারস দুর্নীতি মামলায় তাঁকে ইমপিচ করা হয়। সুপ্রিম কোর্টের নির্দেশ মানলে আর কখনও ভোটে নাম লেখাতে পারবেন না। লন্ডনে স্বেচ্ছা নির্বাসনে রয়েছেন।
শাহিদ খাকান আব্বাসি: শরিফের বাকি মেয়াদটুকুই পূরণের সুযোগ পান। ২০০১৭ সালের ১ আগস্ট দায়িত্ব গ্রহণ করেন। পুনরায় নির্বাচনের জন্য ২০১৮ সালের ৩১ মে অ্যাসেম্বলি ভেঙে যায়।
ইমরান খান: একাধিক বার ব্র্থ হওয়ার পর, ২০১৮ সালের ১৮ অগস্ট পাকিস্তানের প্রধানমন্ত্রী হন ইমরান। সূকিছু ঠিকঠাক চললে ২০২৩ সাল পর্যন্ত ক্ষমতায় থাকার কথা ছিল। ৩ বছর ৭ মাসে আস্থাভটে হেরে অপসারিত হলেন।