সিংহ নয়, কেন উত্তর কলকাতার এই পুজোয় দুর্গা ব্যাঘ্রবাহিনী?

Hatibagan Durgapuja 2024: ১৯০ বছরের পুরনো পৈতৃক বাড়ির প্রাঙ্গণে এই মূর্তি তৈরি হয়। আর এই মূর্তি রং হয় প্রাকৃতিক রং দিয়ে, কোনও রাসয়নিকের ব্যবহার নেই এখানে।

দেবী সিংহবাহিনী। কেশর ফুলিয়ে পশুরাজের পিঠে সওয়ার দুর্গা অশুর নিধন করছেন, এমন দৃশ্যই পরিচিত। কিছু পরিবারে, সনাতনী মূর্তিতে ঘোড়ামুখো সিংহ দেখা যায়। সেকালে সিংহ না দেখে মূর্তি গড়া কঠিন, মূর্তিগড়ার কারিগরদের পক্ষে অদেখা সিংহ কল্পনা করাও কঠিন। অগত্যা পরিচিত ঘোড়ার অবয়বেই তৈরি হতো পশুরাজ। বাংলার প্রাচীন পুজোগুলিতে আজও এই মূর্তি দেখা যায়। তবে বেশিরভাগ পুজোতেই দেবী সিংহে সওয়ার, কোনও কোনও বাড়িতে সাদা সিংহ! তবে একটি পুজো, খাস কলকাতাতেই এমন আছে যেখানে দুর্গা রয়াল বেঙ্গল টাইগারে সওয়ার। দেবী এখানে ব্যাঘ্রবাহিনী!

উত্তর কলকাতার হাতিবাগানে কুণ্ডুবাড়ির পুজোতে দুর্গা প্রতিমার বাহনটি সিংহ নয়, বাঘ। না কোনও স্বপ্নাদেশে নয়, কোনও প্রথা মেনে নয়। দেবী এখানে বাঘের পিঠে সওয়ার কারণ এই পুজোর আয়োজক দম্পতি জয়দীপ এবং সুচন্দ্রা কুণ্ডু ব্যাঘ্র সংরক্ষণ নিয়ে কাজ করেন। তাঁদের কল্পনা ও ইচ্ছাতেই দেবীর বাহন বাঘ।

আরও পড়ুন- ‘বাসন্তী’ই আসলে বাংলার আদি দুর্গা, জানেন কোন ইতিহাস লুকিয়ে আছে এই পুজোর নেপথ্যে?

ইন্ডিয়া টু-ডে-র এক প্রতিবেদনে জানা গেছে, ১৬ বছর আগে এই পুজোর শুরু। আর শুরুর দিন থেকেই দেবীর বাহন বাঘ। জয়দীপ কুণ্ডুর কথায়, “বাঘ আমাদের জীবনের এক অবিচ্ছেদ্য অংশ। আমরা সবসময় বাঘের উপরেই দেবীকে সওয়ার হিসেবে কল্পনা করেছি। আমাদের দেবীর যে রূপ, তা আমাদেরই কল্পনাপ্রসূত!” ব্যাঘ্রবাহিনী দুর্গাই উত্তর কলকাতার এই পুজোর মূর্তিটি প্রাথমিক আকর্ষণ।

জয়দীপ এবং সুচন্দ্রা বিশ্বাস করেন, দুর্গোৎসব আসলে প্রকৃতির সঙ্গে মানবতার সংযোগ সম্পর্কের এক উদযাপন। প্রকৃতিকে রক্ষা করা ও উদযাপন করাই এই পুজোর লক্ষ্য। কার্বনের ব্যবহার কমানোর লক্ষ্যেও কাজ করছেন এই দম্পতি। ১৯০ বছরের পুরনো পৈতৃক বাড়ির প্রাঙ্গণে এই মূর্তি তৈরি হয়। আর এই মূর্তি রং হয় প্রাকৃতিক রং দিয়ে, কোনও রাসয়নিকের ব্যবহার নেই এখানে। কারিগররা আসেন মুর্শিদাবাদের বহরমপুর থেকে। শোলার সাজে দেবীকে সাজানো হয়। শোলাও প্রাকৃতিক পদার্থ। শোলার কারুশিল্পের জন্য রাষ্ট্রপতি পুরস্কার জিতেছিলেন শিল্পী আশিস মালাকার। তিনিই দেবী দুর্গা এবং তার সন্তানদের পোশাক গড়েন শোলা দিয়ে।

আরও পড়ুন- মৃৎশিল্পীর ভুলে দেবী হয়ে গেলেন নীল, কৃষ্ণনগরের দুর্গাপুজোর ইতিহাস আজও বিস্ময় জাগায়

কুণ্ডুবাড়ির এই পুজোর 'থিম' একটাই, আমাদের বাস্তুতন্ত্রের রক্ষা, আমাদের ঘিরে থাকা প্রকৃতির আচ্ছাদনকে বাঁচিয়ে রাখা। এই চিন্তাভাবনা থেকেই পুজোর সাজসজ্জাতেও প্লাস্টিকের ব্যবহার নেই বললেই চলে। আখের তৈরি পাতায় ভোগ পরিবেশন করা হয় ভক্তদের। SHER বা সোসাইটি ফর হেরিটেজ অ্যান্ড ইকোলজিক্যাল রিসার্চেসের সঙ্গে যুক্ত এই দম্পতি। শের আসলে একটি এনজিও। সুন্দরবনের মানুষ এবং বন্যপ্রাণীদের নিয়ে কাজ করে এই বেসরকারি সংস্থাটি৷ ২০২৩ সালে, অভয়ারণ্য বন্যপ্রাণী পরিষেবা পুরস্কার জেতে এই এনজিও।

১৬ বছরের এই পুজোকে স্মরণীয় করে রাখতে, ১১টি ছবির পোস্টকার্ডের একটি সিরিজ চালু করেছেন জয়দীপ ও সুচন্দ্রা৷ ১১ জন শিল্পী পোস্টকার্ড এঁকেছেন দুর্গাকে নিয়ে। আর প্রতি শিল্পীই দুর্গাকে বাঘের পিঠে কল্পনা করেই ছবি এঁকেছেন৷ দুর্গা এবং বাঘ আসলে বাংলার দুই 'আইকন'! এই উৎসব ও প্রকৃতিকে সংযুক্ত করার উদ্যোগ এবং বাংলার বাঘ সংরক্ষণ সম্পর্কে সচেতনতা প্রচার করতেই হাতিবাগানের কুণ্ডুবাড়ির দুর্গা ব্যাঘ্রবাহিনী।

More Articles