কোন মন্ত্রে ট্রাম্পের দুর্গে এত বড় ফাটল ধরালেন মামদানি?

The Rise of New York’s Youngest Mayor: জোহরান মামদানির রাজনীতি মূলধারার থেকে আলাদা। তিনি বরাবরই ‘প্রতিষ্ঠান-বিরোধী’ বা anti-establishment নেতা হিসেবে পরিচিত।

নিউ ইয়র্ক সিটির রাজনীতিতে এক নতুন অধ্যায়ের সূচনা করেছেন জোহরান মামদানি। ২০২৫ সালের ৪ নভেম্বর অনুষ্ঠিত মিউনিসিপ্যাল নির্বাচনে জয়ী হয়ে তিনি শুধু শহরের মেয়রই হননি, বরং অভিবাসী মুসলিম, দক্ষিণ এশিয়া এবং তরুণ ভোটারদের প্রতিনিধিত্ৱ করছেন। মাত্র ৩৪ বছর বয়সে তিনিই শহরটির ইতিহাসে সবচেয়ে কম বয়সি মেয়র হলেন। মামদানির রাজনৈতিক কৌশল, কর্মসূচি বাস্তবায়নের পরিকল্পনা সবকিছুই এই জয়কে অর্থবহ করেছে।

অনেকেই ভাবতে পারেনি, উগান্ডায় জন্ম নেওয়া একজন তরুণ সোশ্যাল ডেমোক্র্যাট একদিন মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের সবচেয়ে প্রভাবশালী শহরের নেতৃত্ব দেবেন। ২০২৫ সালের নভেম্বর সেটাই করে দেখালেন মামদানি। তাঁর প্রতিপক্ষ ছিলেন মার্কিন প্রেসিডেন্ট ডোনাল্ড ট্রাম্প, মার্কিন বিলিনিয়র বিল অ্যাকম্যান, ধনকুবের ইলন মাস্কের মতো কোটিপতি প্রভাবশালীরা। তাঁরা প্রতিদিন তাঁকে 'সন্ত্রাসবাদী', 'কমিউনিস্ট', 'মৌলবাদী' দাবি করে আক্রমণ করেছেন। এমনকি, সোশ্যাল মিডিয়ায় চলেছে অপপ্রচার, টেলিভিশনে প্রচারিত হয়েছে ভয় দেখানো প্রচারণা। মামদানিকে হারাতে ব্যয় হয়েছে কোটি কোটি ডলার। শুধু তাই নয়, নিজের দল থেকেও তিনি পূর্ণ সমর্থন পাননি। ডেমোক্র্যাট পার্টির একাংশ পর্যন্ত তাঁর প্রার্থী হওয়া নিয়ে সংশয়ে ছিল। তবু মামদানি হাল ছাড়েননি, জনগণের সঙ্গে সরাসরি যোগাযোগ করা, স্থানীয় সমস্যা নিয়ে স্পষ্ট কথাবার্তা বলা এবং পরিবর্তনের বার্তাই তাঁকে জনমানুষের নেতা করে তুলেছে। এত সব বাধা পেরিয়ে তিনি দেখিয়েছেন, অর্থ নয়, মানুষের বিশ্বাসই সবচেয়ে বড় শক্তি। লক্ষ লক্ষ স্বেচ্ছাসেবক তাঁর পাশে দাড়িয়েছে। প্রশ্ন হলো, কেন এত মানুষের সর্মথন পেলেন মামদানি?

নির্বাচনী প্রচারণায় জোহরান মামদানি এমন এক নিউ ইয়র্কের স্বপ্ন দেখিয়েছিলেন, যেখানে সবার জন্য থাকবে সমান সুযোগ। তাঁর প্রতিশ্রুতির মূল লক্ষ্য ছিল সাধারণ নাগরিকের জীবনযাত্রা সহজ করা। বাড়ি ভাড়া স্থির রাখা এবং সাশ্রয়ী বাসস্থান নিশ্চিত করা ছিল তাঁর প্রধান প্রতিশ্রুতি। পাশাপাশি, ভাড়াটিয়াদের অন্যায়ভাবে উচ্ছেদ থেকে রক্ষা করতে শক্তিশালী 'Eviction Protection' আইন আনার আশ্বাস দেন।

আরও পড়ুন

ট্রাম্প-মাস্কের হুঙ্কারকে দুয়ো! ইতিহাস গড়লেন জোহরান মামদানি

গণপরিবহন ব্যবস্থায়ও বড় পরিবর্তনের পরিকল্পনা ছিল তাঁর। তিনি সস্তা বা বিনামূল্যে বাস ও মেট্রো পরিষেবার প্রতিশ্রুতি দেন এবং পুরনো ট্রেন ও বাসের আধুনিকীকরণের উদ্যোগের কথা বলেন। অর্থনীতি ও করনীতিতেও মামদানি ন্যায্যতার কথা বলেন। উচ্চ আয়ের নাগরিকদের কর বৃদ্ধি করে, আর্থিক বৈষম্য কমানোর কথা বলেন।মামদানির করনীতির পরিকল্পনা অনুযায়ী, যাঁদের বার্ষিক আয় ১০ লক্ষ ডলারের উপর, তাঁদের অতিরিক্ত ২ শতাংশ কর ধার্য করা হবে। পাশাপাশি, কর্পোরেট করের হার বাড়িয়ে ১১.৫ শতাংশ করার প্রস্তাব দিয়েছেন তিনি।তাঁর একাধিক সামাজিক ও অর্থনৈতিক প্রকল্প বাস্তবায়নের জন্য মামদানি ধনী নাগরিক ও বৃহৎ কোম্পানিগুলোর উপর অতিরিক্ত কর আরোপের পরিকল্পনাও করেছেন। এছাড়াও তিনি নিম্নমজুরির শ্রমিকদের বেতন বৃদ্ধির প্রতিশ্রুতিও দিয়েছেন। শুধু অর্থনীতি নয়, স্বাস্থ্য ও শিক্ষার ক্ষেত্রেও পরিবর্তনের আহ্বান জানান মামদানি। দরিদ্র ও মধ্যবিত্ত নাগরিকদের জন্য সাশ্রয়ী স্বাস্থ্যসেবা, পাবলিক স্কুলগুলোর উন্নয়ন এবং শিক্ষক প্রশিক্ষণ বৃদ্ধির পরিকল্পনারও ঘোষণা করেন তিনি।

প্রথম থেকেই মামদানি কোনো আপোষ করেননি। রাজনৈতিক চাপ, বিতর্ক বা প্রভাবশালীদের বিরোধিতা— কোনো কিছুর সঙ্গেই তিনি আপোষ করেননি। ট্রাম্প, বিল অ্যাকম্যান বা ইলন মাস্কের মতো ক্ষমতাশালী ব্যক্তিদের প্রকাশ্য সমালোচনার মুখেও নিজের আদর্শ থেকে সরে যাননি। সেই বিশ্বাস থেকেই তিনি ধনীদের কর বাড়ানোর, সাশ্রয়ী বাসস্থান গড়ার এবং নিম্নআয়ের মানুষের পাশে দাঁড়ানোর প্রতিশ্রুতিতে অটল থেকেছেন। নিজ দলের মধ্যেও অনেকেই যখন তাঁকে সমর্থন করতে দ্বিধা করছিলেন, তখনও মামদানি নিজের অবস্থান থেকে সরে জানননি। তাঁর এই আপোষহীন মনোভাবই তাঁকে সাধারণ মানুষের কাছে একজন নীতিবান ও নির্ভরযোগ্য নেতা হিসেবে তুলে ধরেছে।

বলতেই হয়, জোহরান মামদানি বরাবরই ইজরায়েলের নীতির কড়া সমালোচক হিসেবে পরিচিত। ফিলিস্তিনে মানবাধিকার লঙ্ঘনের বিষয়ে এবং গাজায় বেসামরিক নাগরিকদের উপর হামলার বিরোধিতা করেছেন। এতেও নিউ ইয়র্কের প্রভাবশালী রাজনৈতিক ও ব্যবসায়ী মহলের একাংশ তাঁর বিরুদ্ধে চলে যায়। তাঁর এই দৃঢ় অবস্থানই তাঁকে তরুণ প্রজন্ম ও প্রগতিশীল ভোটারদের কাছে এক সাহসী, নীতিনিষ্ঠ নেতা হিসেবে প্রতিষ্ঠিত করেছে।

আরও পড়ুন

নেহরুর প্রতিধ্বনি নিউইয়র্কে! ঐতিহাসিক বিজয়ভাষণে মামদানি যা বললেন

জোহরান মামদানির রাজনীতি মূলধারার থেকে আলাদা। তিনি বরাবরই ‘প্রতিষ্ঠান-বিরোধী’ বা anti-establishment নেতা হিসেবে পরিচিত। বড় কর্পোরেট, রিয়েল এস্টেট লবি কিংবা রাজনৈতিক প্রভাবশালীদের সঙ্গে ঘনিষ্ঠতা নয়, বরং তিনি সাধারণ মানুষের সংগঠন, স্থানীয় কমিউনিটি ও শ্রমজীবী মানুষের পাশে দাঁড়ানোর রাজনীতি করেছেন। এই সিদ্ধান্তগুলিই তাঁকে অনেক সময় নিজ দলের নেতাদের বিরুদ্ধেও দাঁড় করিয়েছে। কিন্তু মামদানি সেই ঝুঁকি নিতেও ভয় পাননি। তিনি বারবার প্রমাণ করেছেন, রাজনীতি মানে কেবল ক্ষমতা নয়, জনগণের কণ্ঠস্বর হয়ে ওঠাই আসল দায়িত্ৱ।

মামদানি পায়ে হেঁটে প্রায় মানুষের কাছে পৌঁছেছেন, সরাসরি কথা বলেছেন, আর সোশ্যাল মিডিয়ার অভিনব প্রচারণার মাধ্যমে তরুণ ভোটারদের সঙ্গে সংযোগ তৈরি করেছেন। মামদানির রাজনৈতিক কৌশল ছিল প্রচলিত রাজনীতির বাইরে। তিনি স্বেচ্ছাসেবকদের দিয়ে প্রচার এবং সরাসরি ভোটারের সঙ্গে যোগাযোগের উপর জোর দিয়েছিলেন। সোশ্যাল মিডিয়া ও স্থানীয় কমিউনিটি প্ল্যাটফর্মগুলোকে কাজে লাগিয়ে তিনি শহরের বিভিন্ন প্রত্যন্ত অঞ্চলের মানুষদের সঙ্গে সংযোগ স্থাপন করেছিলেন। তাঁর নির্বাচনী কর্মসূচি ছিল সরাসরি নাগরিকদের দৈনন্দিন সমস্যার সঙ্গে যুক্ত। সোস্যাল মিডিয়া ও প্রত্যন্ত অঞ্চলগুলোতে মানুষদের সঙ্গে কথা বলে তাদের সমস্যাগুলো বোঝেন এবং তার ভিত্তিতে পরিকল্পনা তৈরি করেন। এছাড়া, টিকটক, ইনস্টাগ্রাম ও টুইটারের মতো সোশ্যাল মিডিয়া ব্যবহার করে তিনি যুব সমাজকে সক্রিয়ভাবে প্রচারণায় যুক্ত করেন। এই যোগাযোগের মাধ্যমেই মামদানি শহরের সাধারণ মানুষের প্রকৃত উদ্বেগ ও চাহিদা বুঝতে পেরেছিলেন। সেই অভিজ্ঞতার ভিত্তিতেই তিনি নিজের নির্বাচনী পরিকল্পনা ও নীতিগুলো গড়ে তোলেন।

এভাবেই তিনি নিউ ইয়র্ক সিটির ইতিহাসে সবচেয়ে কম বয়সি এবং প্রথম মুসলিম মেয়র হিসেবে নির্বাচিত হয়েছেন। মামদানির জয় শুধু নির্বাচন জয় নয়, এটি নিউ ইয়র্ক সিটিতে নতুন রাজনীতির সূচনা। তাঁর ভাবনা, কাজের পরিকল্পনা ও বাস্তবায়নের প্রস্তুতি মিলে এমন এক ভিত্তি তৈরি করেছে, যা শহটির মানুষের আশা-আকাঙ্ক্ষার সঙ্গে মিলে যায়।

More Articles