বারবার ভুয়ো সংকেত! ভারতের আকাশপথে বিভ্রান্তির সম্ভাবনা যেভাবে বাড়ছে
Indian aviation cyber attack: শুধুমাত্র দিল্লি নয়, রিপোর্ট বলছে কলকাতা, মুম্বই, চেন্নাই, হায়দ্রাবাদ, অমৃতসর-সহ দেশের প্রথম সারির কয়েকটি বিমানবন্দর 'জিপিএস স্পুফিং' ও 'জিএনএসএস ইন্টারফেরেন্স'-এর কবলে পড়ে।
সপ্তাহের শুরুতে সংসদ উত্তাল হয়ে ওঠে, সম্প্রতি দেশের কিছু গুরুত্বপূর্ণ বিমানবন্দর ঘটে যাওয়া গ্লোবাল পজিশনিং সিস্টেম (জিপিএস) বা গ্লোবাল নেভিগেশন স্যাটেলাইট সিস্টেম (জিএনএসএস) স্পুফিং এর কারণে। গত মাসের শুরুর দিকে, দিল্লির ইন্দিরা গান্ধী আন্তর্জাতিক বিমানবন্দরের আশপাশের বিস্তীর্ণ এলাকা জুড়ে ঘটেছিল এই স্পুফিং। ভুয়ো স্যাটেলাইট সিগন্যালগুলি বিমানের নেভিগেশন সিস্টেমকে পুরোপুরি বিভ্রান্ত করে দেয়, যা হঠাৎ করেই দেশের ব্যস্ততম বিমানবন্দরে প্রতিদিনের কার্যক্রমের মাঝে বিশৃঙ্খলতা তৈরি করে। পরিস্থিতি এই পর্যায়ে পৌঁছায় যে বেশ কয়েকটি বিমানকে জয়পুরে নামাতে বাধ্য হন চালকরা। ফ্লাইটরাডার-24-এর এক প্রতিবেদনে জানা যায়, সে সময় নেভিগেশন ইন্টিগ্রিটি সূচক ৮ থেকে ০ তে নেমে আসে; অনেকগুলি বিমানের সময়সূচিরও পরিবর্তন করতে হয়। বেসরকারি হিসাবে, দেশজুড়ে প্রায় আটশোর অধিক বিমান এই স্পুফিং এর কবলে পড়ে নভেম্বরের প্রথম সপ্তাহে। যদিও সরকারি খতিয়ান অনুযায়ী, এখনও পর্যন্ত গোটা দেশে সংখ্যাটা ৪৬৫ অতিক্রম করেনি।
এই ঘটনা সামনে আসার পরপরই, ডিরেক্টরেট জেনারেল অফ সিভিল এভিয়েশন (ডিজিসিএ) নির্দেশ দেয় ভুয়ো সঙ্কেতের কবলে পড়ার ১০ মিনিটের মধ্যেই যেন জানানো হয়, যাতে করে খুঁজে পাওয়া যায় যে কোথা থেকে ভুয়ো তথ্য প্রচার হচ্ছে। পরিস্থিতি বেগতিক দেখে, জাতীয় নিরাপত্তা উপদেষ্টা অজিত ডোভালের কার্যালয় এই গুরুতর ঘটনার তদন্ত শুরু করে।
আরও পড়ুন
সতর্ক করেই হয় মৃত নয় একঘরে: বিশ্বজুড়ে হুইসেলব্লোয়ারদের পরিণতি
আই জি এ আই, দেশের ব্যস্ততম বিমানবন্দর। পরিসংখ্যান বলছে, গত বছর প্রায় ৭৭.৮ মিলিয়ন যাত্রীকে পরিষেবা দিয়েছে এই আই জি এ আই; ব্যাস্ততার দিক দিয়ে, পৃথিবীতে এটি এটি নবম স্থানে রয়েছে। এমন জায়গায় স্পুফিং, কি মারাত্মক হতে পারে, কল্পনা করা দায়। উপরোন্ত ৬ নভেম্বর মুখ থুবড়ে পড়ে অটোমেটিক মেসেজ সুইচিং সিস্টেম (এএমএসএস), ফলে প্রায় আড়াই হাজার ফ্লাইটকে ম্যানুয়ালি পরিচালনা করা এয়ার ট্রাফিক (এটিসি) কন্ট্রোলের কাছে রীতিমতো চ্যালেঞ্জ হয়ে দাঁড়ায়। এ যেন বোঝার উপর শাকের আঁটি!
শুধুমাত্র দিল্লি নয়, রিপোর্ট বলছে কলকাতা, মুম্বই, চেন্নাই, হায়দ্রাবাদ, অমৃতসর-সহ দেশের প্রথম সারির কয়েকটি বিমানবন্দর 'জিপিএস স্পুফিং' ও 'জিএনএসএস ইন্টারফেরেন্স'-এর কবলে পড়ে। শুরুর দিকে না মানলেও, গত সোমবার সংসদে তা স্বীকার করে কেন্দ্র সরকার।
কী এই 'জিপিএস স্পুফিং'?
এটি বিমান চলাচলের যোগাযোগ ব্যবস্থার উপর এক প্রকারের সাইবার হামলা, যার সাহায্যে গ্লোবাল নেভিগেশন সিস্টেমে ভুল সঙ্কেত পাঠায় দুষ্কৃতীরা। যেমন, সম্প্রতি দিল্লির ঘটনায় বেশ কিছু সংখ্যক পাইলট, অভিযোগ করেছেন, দিল্লি বিমানবন্দরের ৬০-নটিক্যাল-মাইল ব্যাসার্ধের মধ্যে তাঁরা বিমানের অবস্থান সম্পর্কে ভুল সঙ্কেত পেয়েছেন। এটি জ্যামিংয়ের থেকে প্রকৃতগত আলাদা-এক্ষেত্রে জিপিএস সিগন্যাল ব্লক না করে গুলিয়ে দেওয়া হয়। তার ভিত্তিতে বিমানের উড়ান ও অবতরণ বিষয়ক প্রয়োজনীয় তথ্য, যেমন প্রকৃত অবস্থান, গতিপথ, ভূ-পৃষ্ঠ থেকে উচ্চতা, ইত্যাদির গণনায় গলদ দেখা যায়।
মোদ্দাকথা, স্পুফিং এর মূল উদ্দেশ্যই হলো ভুয়ো নেভিগেশন তথ্য ছড়িয়ে দেওয়া; আর মিথ্যা সংকেতগুলিকে প্রযুক্তিগত ভাবে বিবর্ধিত করে উপস্থাপন করা। স্যাটেলাইট থেকে আগত মূল সিগন্যাল এমনিতেই দুর্বল, অপরদিকে স্পুফার সিগন্যাল অনেক বেশি শক্তিশালী হওয়ায়, খুব সহজেই তা মূল জিপিএস সিগন্যালকে প্রশমিত করে দেয়। ফলে, আসলের পরিবর্তে নকলটাকেই আসল বলে মনে হয় পাইলটদের— একবার তাদেরকে পথভ্রষ্ট করতে পারলেই পরিণতি মারাত্মক হতে পারে। এক তরুণী পাইলট দিল্লি বিমানবন্দরে অবতরণের প্রস্তুতি নিচ্ছিলেন, সে সময় তাঁর ককপিটের র্যাডারে ধরা পড়ে তিনি এখনও হরিয়ানাতেই আছেন, বোঝো কাণ্ড!
আরও পড়ুন
দুর্নীতি-অসততা নিয়ে সতর্ক করেন যাঁরা, এদেশে শাস্তি পান তাঁরাই!
মাঝ আকাশে হঠাৎ স্পুফিং এর শিকার হলে, বিমানগুলির অত্যাধুনিক ডিজিটাল যোগাযোগ ব্যবস্থা বিকল হয়ে যায়, এবং বিমানগুলি তাদের প্রকৃত অবস্থান অনুধাবনে ব্যর্থ হয়। ফলে মারাত্মক ভাবে বেড়ে যায় দুর্ঘটনার আশঙ্কা। এই সময় কম্পাস এবং চোখই পাইলটদের একমাত্র ভরসা।
আকাশ পরিবহণে স্পুফিং কোনো নতুন বিষয় নয়। ২০২৩ সালের সেপ্টেম্বর থেকে পশ্চিম এশিয়া, পূর্ব রাশিয়া, পাকিস্তান, মায়ানমার ও ভারতের সীমান্তবর্তী অঞ্চলে এর প্রয়োগ লক্ষ্য করা যাচ্ছে । প্রথমদিকে, হাতে গোনা কয়েকটি স্পুফিং এর কেস নজরে এলেও ২০২৪ সালের জানুয়ারির মধ্যে, সেই সংখ্যাটা দিনে গড়ে ৩০০ ছাড়িয়ে যায়; অগাস্টে সংখ্যাটা পাঁচগুণ বেড়ে যায়। গত বছরে, সারা বিশ্বে মোট ৪১,০০০ স্পুফিং এর ঘটনা সামনে আসে। পরিসংখ্যান গত বিশ্লেষণে দেখা যায়, বিশ্বের শীর্ষ ১০টি স্পুফিং প্রবণ এলাকা গুলির মধ্যে দিল্লি চলে আসছে।
দেশের আকাশপথে আজ আর নিরাপদ নয়। এখন বড় কথা হচ্ছে-যাত্রাপথে, অতর্কিত সাইবার হামলা হলে বাঁচার কি কোনো উপায় আছে? এই রকম পরিস্থিতি মোকাবিলা করার জন্য দরকার উন্নত মানের অ্যান্টি-জ্যামিং এবং অ্যান্টি-স্পুফিং ক্ষমতা সম্পন্ন জিএনএসএস রিসিভার। দেশের প্রধান প্রধান বিমানবন্দর গুলিতে এই সব প্রযুক্তি যত দ্রুত সম্ভব স্থাপন করা দরকার, সেই সঙ্গে পুরনো যন্ত্রাদির আধুনিকীকরণ করা জরুরি। এর সঙ্গে লড়তে গেলে, বিভিন্ন দেশের মধ্যে আন্তঃসীমান্ত সহযোগিতা ও তথ্য ভাগাভাগির উপর জোর দিতে হবে। মনে রাখা দরকার, স্পুফিং কোনো স্থানীয় সমস্যা নয়, এটি একপ্রকারের ডিজিটাল সন্ত্রাস, এর প্রভাব বিশ্বব্যাপী।

Whatsapp
