অগ্নিপথ-এর নেপথ্যে আসলে আরএসএস? যে প্রশ্ন উঠে আসছে
যে প্রশ্ন দু'-একদিন ধরে মাথাচাড়া দিয়েছে, তা হল এটা নিছক কোনও প্রকল্প কি? এর মধ্য দিয়ে সেনার গায়ে গেরুয়া রং লেপে দেওয়ার কোনও ফন্দি নয় তো? প্রশ্ন উঠছে, সেনার নিয়ন্ত্রণ নিতে এটি আরএসএস-এর গুপ্ত এজেন্ডা নয় তো?
শিক্ষার পর এবার কি সামরিক বাহিনী? কর্নাটকের শিক্ষাকে গৈরিকীকরণের নির্লজ্জ চেষ্টা দেখেছে দেশ। এবার বিজেপি সরকারের নতুন প্রকল্প নিয়ে জ্বলছে দেশ। দেশের চাকরিপ্রার্থীদের কথা ভেবে এনডিএ-র শরিকরাও এটা মানতে পারছে না। আজ ভারতজুড়ে বিভিন্ন স্থানীয় সংগঠনের ডাকে বনধ, কংগ্রেসের দেশজোড়া প্রতিবাদ কর্মসূচি। কিন্তু এর ফাঁকেই যে প্রশ্ন দু'-একদিন ধরে মাথাচাড়া দিয়েছে, তা হল এটা নিছক কোনও প্রকল্প কি? এর মধ্য দিয়ে সেনার গায়ে গেরুয়া রং লেপে দেওয়ার কোনও ফন্দি নয় তো? প্রশ্ন উঠছে, সেনার নিয়ন্ত্রণ নিতে এটি আরএসএস-এর গুপ্ত এজেন্ডা নয় তো? এই প্রশ্ন উসকে দিয়েছেন কর্নাটকের প্রাক্তন মুখ্যমন্ত্রী এইচডি কুমারস্বামী। এই প্রশ্ন দেশের তাবড় সুধীজনের মাথা ঘুরিয়ে দিয়েছে, কারণ অতীতে এই সরকারের শিক্ষা থেকে স্থাপত্য- গোটা সমাজব্যবস্থার ওপর কয়েক পোঁচ গেরুয়া রং ঢেলে দেওয়ার নির্লজ্জ প্রচেষ্টার সাক্ষী থেকেছে দেশ।
কী বলেছেন কুমারস্বামী?
কর্নাটকের প্রাক্তন মুখ্যমন্ত্রী এইচ ডি কুমারস্বামী প্রতিরক্ষা ক্ষেত্রে কেন্দ্রের নতুন নিয়োগ পদ্ধতি নিয়ে প্রশ্ন তুলেছেন। তাঁর আশঙ্কা, অগ্নিপথ প্রকল্প আসলে আরএসএস-এর গুপ্ত এজেন্ডা নয় তো? তিনি আরও মারাত্মক মন্তব্য করেছেন, জার্মানিতে অ্যাডলফ হিটলার তাঁর আমলে যেভাবে সেনাকে কবজা করেছিলেন, সেই একই কায়দার সেনার নিয়ন্ত্রণ নিজেদের হাতে রাখতে চাইছে আরএসএস। জনতা দল সেকুলারের এই নেতা আরও বলেন, কে সরকারকে এই প্রকল্পের কনসেপ্ট ধার দিয়েছে? এর পিছনে সংসদীয় কমিটির অনুমোদন আছে কি না, তা নিয়েও প্রশ্ন তুলেছেন তিনি।
তিনি আরও মারাত্মক অভিযোগ সামনে এনেছেন। আরএসএস-এ কিছু যুবক ইতিমধ্যেই প্রশিক্ষিত। এবং কর্মীও বটে। তাঁদেরকে সেনায় চাকরি পাইয়ে দেওয়ার এটা কৌশল নয় তো?
আরও পড়ুন: অগ্নিপথ নিয়ে জ্বলছে দেশ, কৃষি আইনের মতো এবারও পিছু হটতে হবে কেন্দ্রকে?
অগ্নিপথ নিয়ে উৎসাহী আরএসএস
সারা দেশ জ্বলছে। তাতে ভ্রুক্ষেপ নেই বিজেপি এবং আরএসএস-এর। তার প্রমাণ পাওয়া গেল। অগ্নিপথ প্রকল্পে যোগ দিতে তরুণ এবং যুবকদের উৎসাহ দিতে মাঠে নেমে পড়েছে রাষ্ট্রীয় স্বয়ংসেবক সংঘ। সংঘ সূত্রের খবর, শুরুটা করা হয়েছে নিজেদের ঘর থেকে। সংঘের ‘ভাবধারায়’ বিশ্বাস করে বা সমর্থক, এমন পরিবারের যুবকদের অগ্নিপথ প্রকল্পে যোগ দিতে প্রচার চালাচ্ছেন স্বয়ংসেবকরা। সংঘের একটি সূত্রে বলা হচ্ছে, তাঁরা বিভিন্ন এলাকায় গিয়ে এমনও বলছেন যে, সংঘের ‘সংস্কারযুক্ত’ পরিবারের ছেলেরা অগ্নিপথে বিশেষ গুরুত্ব পাবে।
এই নিয়ে তৈরি হয়েছে বিতর্ক। বিরোধী দলগুলি এবার সেনাবাহিনীতে গৈরিকীকরণের অভিযোগ তুলতে শুরু করেছে। যদিও বিজেপির পাল্টা বক্তব্য, যাঁদের যোগ্যতা আছে, তাঁরা যে কেউ অগ্নিপথ প্রকল্পে নাম লেখাতে পারেন। বিরোধীরাও সেই চেষ্টা করুন।
সংঘের একটি সূত্রের দাবি, অগ্নিপথে তরুণ এবং কিশোরদের প্রশিক্ষণের শুরুতেই দেশের সংস্কৃতি সম্পর্কে জানানো হবে। সম্রাট অশোক থেকে শিবাজীর মতো ‘হিন্দু রাজাদের’ সম্পর্কে পাঠও অগ্নিপথ প্রশিক্ষণে থাকা উচিত বলে দাবি সংঘের। সূত্র বলছে, যত দিন না অগ্নিপথ প্রকল্পে নিয়োগ শুরু হচ্ছে, তত দিন শহর ও গ্রামে তাঁরা প্রচার চালাবেন। প্রথমে সংঘ সমর্থকদের বাড়ি গিয়ে, তার পরে সামাজিক মাধ্যমেও প্রচার চালানো হবে বলে সূত্রটির দাবি। জলপাইগুড়ির এক কার্যকর্তার কথায়, “আমাদের সমর্থক বা সংঘ-মনোভাবাপন্ন যাঁরা আছেন, তাঁদের পরিবারের ছেলেদের অবশ্যই অগ্নিপথে যোগ দেওয়ার ব্যবস্থা করতে বলা হয়েছে। সারা দেশেই এই প্রক্রিয়া চলবে।”
অগ্নিপথ নিয়ে পর্যালোচনার দাবি
অগ্নিপথ নিয়ে ঘরে-বাইরে জেরবার কেন্দ্র। খোদ তাদের শরিক জেডিইউ, অগ্নিপথ প্রত্যাহার নয়, পর্যালোচনার দাবি তুলেছে। কারণ, এর সঙ্গে জড়িয়ে আছে দেশের অর্থনীতি।
জেডিইউ নেতা কে সি ত্যাগী সেনাবাহিনীতে স্বল্পমেয়াদি এবং চুক্তিভিত্তিক নিয়োগের বিরোধিতা করে আন্দোলনরত যুবকদের সমর্থন করেছেন।
সংবাদমাধ্যমের প্রশ্নের উত্তরে জেডিইউ নেতা কে সি ত্যাগী বলেছেন, আন্দোলনরত যুবকদের সঙ্গে যোগাযোগ জরুরি। পাশাপাশি বিষয়টি নিয়ে সেনাবাহিনীর অবসরপ্রাপ্ত আধিকারিক, যুবকদের প্রতিনিধি এবং সরকার একসঙ্গে বসে অগ্নিপথ নিয়ে পর্যালোচনা করুক। তিনি বলেছেন, জেডিইউ এই প্রকল্প প্রত্যাহারের দাবি করছে না, তবে প্রকল্পের পর্যালোচনার দাবি করছে।
তিনি বলেছেন, বিহার ছাড়াও উত্তরপ্রদেশ, উত্তরাখণ্ড, হিমাচল প্রদেশ, হরিয়ানার যুবকদের আকর্ষণের কেন্দ্রবিন্দু সশস্ত্র বাহিনীর চাকরি। এই কাজ কোনও না কোনওভাবে এইসব রাজ্যের গ্রামীণ অর্থনীতির সঙ্গে জড়িত। তিনি বলেছেন, জওয়ানদের বেতন কম হলেও, একটা বড় অংশ তাঁরা বাড়িতে পাঠান। তিনি বলেছেন, দেশসেবা করার পাশাপাশি সেনার চাকরি দেশের সব থেকে বড় দারিদ্র দূরীকরণ কর্মসূচি। তিনি যুবকদের জাতীয় সড়কের পাশে দৌড় অনুশীলন করতে দেখেন বলে জানিয়েছেন। স্বল্প মেয়াদের চাকরিতে তরুণদের প্রত্যাশায় আঘাত লেগেছে বলেও মন্তব্য করেছেন তিনি। বিষয়টিকে সহানুভূতির সঙ্গে দেখার জন্য আহ্বান করেছেন তিনি। শরিকরাও বেসুরো গাইতে থাকায় বেশ বিপন্ন মোদি। এখন কী চাল চালেন, দেখা যাক!
শিক্ষা থেকে প্রাচীন স্থাপত্য, এবার সেনা- সব ক্ষেত্রেই বিজেপি তাদের হিন্দুত্বের রাজনীতি এবং গৈরিকীকরণ সংস্কৃতি স্থাপনের এক নির্লজ্জ প্রচেষ্টা চালাচ্ছে বলে অভিযোগ। চারদিকে হাহাকার- কোথায় গেল আমাদের সংবিধানের দেওয়া `ধর্মনিরপেক্ষতা’! এ কোন রাজত্ব! বিপুল ভোট দিয়ে এই কোন সরকারকে এনেছেন দেশবাসী!
কর্নাটকে শিক্ষাকে গৈরিকীকরণের অনেক চেষ্টা চালিয়েছিল সেই রাজ্যের সরকার। পথে নামে সুধী সমাজ। শিক্ষাকে গৈরিকীকরণ করার চেষ্টাকে দস্তুর মতো নিন্দা করেছিল নানা মহল। তাদের অভিযোগ, টেক্সট বুকের রিভিশন করার প্রক্রিয়া শুধু অগণতান্ত্রিকই নয়, ব্রাহ্মণত্ব কায়েম করার চেষ্টা। কর্নাটক সরকার প্রথমে স্কুলের টেক্সট বই রিভাইস করে। পাঠ্যক্রম থেকে বাদ দেওয়া হয় টিপু সুলতানের গরিমা। পরে অবশ্য এই নিয়ে প্রতিবাদের আঁচ বুঝে ঢোক গিলতে হয় সরকারকে।
সারা দেশ উত্তাল হয়েছে মন্দির-মসজিদ বিতর্কে। জ্ঞানবাপীর পর জামিয়া, ‘মন্দির ভেঙে হয়েছে মসজিদ’, পুজোর দাবিতে সোচ্চার বিশ্ব হিন্দু পরিষদ। রেহাই পায়নি কুতুব মিনার, তাজমহলও। হিন্দুত্ববাদীদের গেরুয়া তকমা এঁটে দেওয়ার কী অসীম সাহস! উত্তরপ্রদেশে বিজেপি রাজ। স্বাভাবিকভাবে সেখানে মাথা তুলছে রামমন্দির। তার ওপর পথ-ঘাট, রেলস্টেশনের নাম পাল্টে দেওয়ার গেরুয়া যজ্ঞ চলছে।
এবার কি সেনা?
কৃষি আন্দোলনের দমকে পিছু হটতে হয়েছিল কেন্দ্রকে। এবার অগ্নিপথ নিয়ে শরিকরাও বেসুরো গাইছে, উত্তাল দেশ, কয়েক কদম পিছোবেন মোদি? না কি সেনার গায়ে গেরুয়া রং না লাগিয়ে তিনি রণে ভঙ্গ দেবেন না!