শিম্পাঞ্জিদের সঙ্গে মানুষের অদ্ভুত মিল, মানুষের সংজ্ঞা নতুন করে লিখেছেন জেন্ গুডল

Jane Goodall: তিনি দেখিয়েছিলেন, শিম্পাঞ্জিরা শুধু যন্ত্র ব্যবহারই করে না, ওরা মাংস খায়, বৃষ্টি পড়লে সবাই মিলে একসঙ্গে নাচ করে, দুই গোষ্ঠীর মধ্যে সংগঠিতভাবে যুদ্ধও চালায়।

আমরা যখন প্রাইমেটোলজির ছাত্র হিসেবে পড়াশোনা শুরু করি, আমাদের সামনে তখন অনেক রোল মডেল ছিল— জিন্‌ আল্টম্যানের নিয়মাবলী মেনে তখন বাঁদর-বনমানুষদের ব্যবহার পড়তে শিখছি। শ্যর্লি স্ট্রামের গবেষণা পড়ে আমাদের উচ্চাকাঙ্ক্ষা হচ্ছে আমরা একদিন কেনিয়া গিয়ে বাবুনদের জীবনযাপন টুকে রাখব খাতায়। গোরিলাদের সঙ্গে ডায়ান ফসি-র অত্যাশ্চর্য জীবন এবং হঠাৎ একদিন তাঁর মৃত্যু আমাদের মর্মাহত করে। আরও অনেক অনেক নারী প্রাইমেটোলজিস্টরা আমাদের মিথোলজিতে মিশে যাচ্ছিল। আমরা পড়ছি, "primatology is a feminist science"। একদা পুরুষশাসিত একটি কর্মক্ষেত্রকে ধীরে ধীরে বদলে দিয়েছেন কিছু দোর্দণ্ডপ্রতাপ নারীরা— সমাজ সংসারের চালিত নিয়মের বিপরীতে দাঁড়িয়ে জীবন কাটিয়েছেন পৃথিবীর প্রান্তিক জলে জঙ্গলে। নিজেদের সন্তানদের মানুষ করেছেন না-মানুষ মায়েদের থেকে শিখে! এসব রূপকথার মতো জীবন! আর এসব জীবনের ছিটেফোঁটা আলো এসে পড়েছে আমাদের চোখে। নতুন করে দেখতে শিখিয়েছে প্রাণী জগতকে, মানুষের সঙ্গে বন্যপ্রাণীর সম্পর্কের অদৃশ্য সুতোগুলো সহজেই আমাদের কাছে ধরা দিয়েছে সোনারেণু হয়ে। এক বিশালাকৃতি বনস্পতির রূপে আশ্চর্য এই উত্তরাধিকার আমরা পেয়েছি। তার শাখা থেকে নেমেছে শত শত ঝুরি, পাতায় পাতায় বাজে একই সুর। এই বনস্পতির মূল কাণ্ডের নাম জেন্‌ গুডল, যাঁর প্রেরণায় আজও উদ্ভাসিত হয়ে আছে অজস্র মন!

ভ্যালেরি জেন্ মরিস-গুডল (Jane Goodall) জন্মসূত্রে লণ্ডনের বাসিন্দা, আদতে তিনি বিশ্বপথিক। শৈশব থেকেই জেন্‌ পশুপাখির অনুরাগী। বাবার দেওয়া ছোট্ট এক খেলনা বাঁদর পুতুল (যার নাম রেখেছিলেন জুবিলি) ছিল তাঁর নিত্যসঙ্গী। পরে অনেক সভায় তিনি বলতেন, হয়তো শৈশবের সেই পুতুলের সঙ্গে সখ্যতাই তার পরবর্তী জীবনে সম্প্রসারিত হয়েছিল, কে জানে? ২৩ বছর বয়সে কেনিয়ার নাইরোবিতে তাঁর পরিচয় প্রত্নতত্ত্ববিদ লুই লিকির সঙ্গে। লিকির সহকারী হিসেবে কাজ শুরু করেন জেন্‌ এবং অচিরেই লিকি তাঁকে গোম্বে ন্যাশনাল পার্কে বন্য শিম্পাঞ্জিদের উপর গবেষণা করার প্রস্তাব দেন। 

আরও পড়ুন- মানুষ আর শিম্পাঞ্জির মিলনের ফল! ১৯২০ সালের যেভাবে তৈরি হয়েছিল হিউম্যানজি!

গোম্বে পৌঁছে জেন্‌ এক অবাক আবিষ্কার করেন। এক প্রাপ্তবয়স্ক পুরুষ শিম্পাঞ্জির নাম রেখেছিলেন ডেভিড গ্রেবিয়ার্ড, একদিন দেখেন ডেভিড একটি ঘাসের ডগা ব্যবহার করে গর্ত থেকে উইপোকা তুলে খাচ্ছে! যন্ত্রপাতি ব্যবহার করে কাজ হাসিলের ক্ষমতা প্রাণীজগতে কেবল মানুষের রয়েছে, এমনটাই ভাবা হত। এই আবিষ্কার জেন গুডলকে বৈজ্ঞানিক জগতে নতুন উচ্চতায় পৌঁছে দেয়। তিনি দেখিয়েছিলেন, শিম্পাঞ্জিরা শুধু যন্ত্র ব্যবহারই করে না, ওরা মাংস খায়, বৃষ্টি পড়লে সবাই মিলে একসঙ্গে নাচ করে, দুই গোষ্ঠীর মধ্যে সংগঠিতভাবে যুদ্ধও চালায়। অর্থাৎ নতুন করে জানা গেল যে, মানুষের মতো অনেক ব্যবহার শিম্পাঞ্জিদের মধ্যে রয়েছে। জৈবিক বিবর্তনের ইতিহাসের জ্বলন্ত নিদর্শন। জেনের গবেষণার ফলেই মানুষের সঙ্গে প্রানীজগতের, বিশেষ করে বনমানুষদের, দূরত্ব অনেকখানি কমে আসে জনমানসে। গোম্বে ন্যাশনাল পার্কের শিম্পাঞ্জিদের জীবন পরম নিষ্ঠায় টুকে রেখেছিলেন জেন্‌ ও তার সহকারী ছাত্রছাত্রী ফিল্ড অ্যাসিস্ট্যান্টরা। এদের মধ্যে অনেকেই এখন নিজগুণে প্রতিষ্ঠিত গবেষক। 

২০১৫-১৬ সালে ডিউক ইউনিভার্সিটিতে অ্যান পিউসির সঙ্গে একটা ছোট কাজ করার সুযোগ হয়েছিল। একদা জেন-এর ছাত্রী অ্যান একদিন Evolutionary Anthropology ডিপার্টমেন্টের একটা বড় ঘরে নিয়ে গিয়ে দেখালেন মাটি থেকে ছাদ পর্যন্ত চার দেওয়াল জোড়া বিশাল বিশাল আলমারি, তার অগুনতি ড্রয়ার ভর্তি নোটবই— জেন্‌ গুডল ও তাঁর সহকর্মীদের সংগ্রহ করা রাশি রাশি ডেটা। একেকটি দেরাজ খুলে দেখছি হাতে লেখা ডকুমেন্টেশন। শিম্পাঞ্জি সমাজের রোমাঞ্চকর সব গল্প, যার অনেকটাই এখন আমরা জানতে পেরেছি জেন-এর দেখানো পথে হেঁটে। কিন্তু ওই খাতাগুলো দেখে ভেবেছি, আরও কত কী জানার বাকি, যা কেবল জেন্‌ দেখেছেন, টুকে রেখেছেন। একটা দেরাজ ভর্তি পুরোনো ভিডিও ক্যাসেট যার অনেকগুলোই চালানোর কোনো রেকর্ড-প্লেয়ার আর পাওয়া যায় না। বিশাল কর্মযজ্ঞের মাধ্যমে অ্যান চেষ্টা করছেন সমস্ত ডেটা ডিজিটাইজ করে আগামীর জন্য সংরক্ষণ করতে। ওই একটি ঘরে যে মণিমানিক্য আছে তা দিয়ে আগামী বহু প্রজন্মের গবেষণার কাজ নিশ্চিত! 

আরও পড়ুন- ১০ হাজার বছর আগে বিলুপ্ত হওয়া ডায়ার উলফ সত্যিই ফিরেছে? জানুন আসল সত্য

একটি খাতা খুলে দেখি তার মধ্যে সোয়াহিলি ভাষায় লেখা নোট। অ্যান ঠাট্টা করে বলেন, তুমি যদি এই ডেটা নিয়ে কাজ করো কোনোদিন, তোমার সোয়াহিলি শিখে আসার দরকার নেই, কাজ করতে করতে অজান্তেই শিখে যাবে এক নতুন ভাষা!  

১৯৭৭ সালে প্রতিষ্ঠিত হয় Jane Goodall Institute, যা বর্তমানে বিশ্বের বৃহত্তম বন্যপ্রাণী সংরক্ষণ সংস্থাগুলোর একটি। জেন্‌ জীবদ্দশায় ৩২টি বই লিখেছেন, যার মধ্যে ১৫টি শিশুদের জন্য। তাঁর উদ্যোগে Roots & Shoots নামের শিক্ষা কার্যক্রম শুরু হয় ১৯৯১ সালে, যা এখন ১২০টি দেশে শিশু ও কিশোরদের বন্যপ্রাণ সংরক্ষণ সম্পর্কে শিক্ষা দেয়।

বন্যপ্রাণ সংরক্ষণের কাজ খুব হতাশাজনক, বিশেষত আজকের দ্রুত পরিবর্তনশীল পৃথিবীর বুকে দাঁড়িয়ে। এর মধ্যেও, জেন্‌ ওঁর শেষ বই The Book of Hope (২০২১)-এ লিখেছেন, মানবজাতির ভবিষ্যৎ নিয়ে তিনি আজও আশাবাদী। এই বার্তা ছড়িয়ে দেওয়ার জন্য জেন্‌ জীবনের শেষ দিন পর্যন্ত দেশ-বিদেশ ঘুরে বক্তৃতা দিতেন, মানুষকে উদ্বুদ্ধ করতেন প্রকৃতি ও বন্যপ্রাণীর সঙ্গে শান্তিপূর্ণ সহাবস্থান বজায় রাখতে। ৯১ বছর বয়সে, এরকমই এক লেকচার ট্যুর করাকালীন ১ অক্টোবর জেন-এর জীবনাবসান হয়। কিন্তু ওঁর চিন্তাভাবনা, ভবিষ্যৎ পরিকল্পনা এখনও ছুটে বেড়াচ্ছে সহস্র উত্তরসূরীর শিরায়-ধমনিতে।  

ডিউকের ওই গ্রন্থাগার প্রমাণ ঘরটায় ঘুরতে ঘুরতে ভেবেছিলাম, জেন্‌ গুডল-এর সঙ্গে কোনোদিন দেখা তো হবে না, ওঁর কাজের সঙ্গে আরেকটু বেশি সময় কাটিয়ে সেই শখ পূর্ণ করে নিই!

দেখা একবার হয়েছিল। শিকাগোর এক কনফারেন্সে, জেন্‌ ওঁর বক্তৃতা শেষ করে নেমেছেন। গুটিগুটি পায়ে আলাপ করতে গেছি, তখন ওকে ঘিরে ধরেছে নানা দেশ থেকে আসা ছাত্রছাত্রীরা। জিজ্ঞেস করলেন, আমি কোন দেশে কাজ করি। ভারত শুনে বললেন, পরের মাসেই ওঁর ভারতভ্রমণ। একটু থেমে, ওরঁ সিগনেচার চোখ চিকচিকে হাসি দিয়ে বলেছিলেন— "Indian women are very strong primates!"

সব বক্তৃতার শুরুতে জেন্‌ শিম্পাঞ্জিদের প্যান্ট-হুট নামের একটা ডাক নকল করে সভায় উপস্থিত সকলকে বলতেন, "তোমরা যে যে প্রজাতি নিয়ে কাজ করো সেই প্রজাতির একটা ডাক ডাকো!" অদ্ভুত এক ক্যাকোফোনির মাধ্যমে তখন সৃষ্টি হত ক্যামেরাড্রির সিম্ফনি। আজ গগনবিদারি প্যান্ট-হুট সমেত তোমায় সেলাম জানাই, জেন্‌ গুডল! 

লেখক পরিচিতি: শ্রীজাতার কাজ প্রাইমেটদের মন ও ভাষার বিবর্তন নিয়ে। বাঁদর, শিম্পাঞ্জি, শিশু আর প্রাপ্তবয়স্ক মানুষ কীভাবে ইঙ্গিতের মাধ্যমে মনের ভাব প্রকাশ করে, তাই শ্রীজাতার গবেষণার বিষয়। 

More Articles