মন্ত্রীরা চড়তেন নিয়ম করে, বাঙালির প্রিয় অ্যাম্বাসাডার যতটা পথ পেরিয়ে এল

কখনো হলুদ কালো রংয়ের পাবলিক ট্যাক্সি, আবার কখনো সাদা রঙের প্রাইভেট কার, সে যুগে হিন্দুস্তান মোটরসের তৈরি অ্যাম্বাসাডরের  জুড়ি মেলা ভার ছিল কয়েক দশক। সাধারণ মানুষ থেকে নেতামন্ত্রী, অ্যাম্বাসাডারই ছিল প্রথম পছন্দ।

একটা সময় এই গাড়িটির নাম ছিল 'কিং অফ দা ইন্ডিয়ান রোড', যার বাংলা তর্জমা করলে হয়, 'ভারতের পথের রাজা'। ভারতে এমন কোন মানুষ নেই, যিনি এই গাড়িটি চোখে দেখেননি। বাঙালিদের ক্ষেত্রে তো এটি বহন করে একটা আলাদা ইমোশন। ষাট কিংবা সত্তরের দশকে বিদেশি গাড়ি তৈরির কোম্পানিগুলিকে কড়া টক্কর দেওয়ার জন্য তৈরি হয়েছিল এই গাড়িটির। কখনো হলুদ কালো রংয়ের পাবলিক ট্যাক্সি, আবার কখনো সাদা রঙের প্রাইভেট কার, সে যুগে হিন্দুস্তান মোটরসের তৈরি অ্যাম্বাসাডরের  জুড়ি মেলা ভার ছিল কয়েক দশক। সাধারণ মানুষ থেকে নেতামন্ত্রী, অ্যাম্বাসাডারই ছিল প্রথম পছন্দ।

নব্বইয়ের দশকে অর্থনীতির আগল খোলার আগে পর্যন্ত এই গাড়ির চাহিদা ছিল তুঙ্গে। ভারতের অটোমোবাইল ইন্ডাস্ট্রিতে অন্যতম মাইলফলক হিন্দুস্থান মোটরসের উত্তরপাড়া ফ্যাক্টরি থেকে তৈরি হওয়া এই সাদা গাড়ি। এটি ছিল মূলত রাজনীতিবিদদের এক নম্বর পছন্দ। বিধান রায়, জ্যোতি বসু থেকে শুরু করে বুদ্ধদেব ভট্টাচার্য, সকলেই ছিলেন এই গাড়ির সওয়ারি। বাংলা এবং হিন্দি সিনেমাতেও এই গাড়ির যথেচ্ছ ব্যবহার হয়েছে। এমনকি, সে যুগে গাড়ির দৌড়েও ভালোভাবে সফল ছিল এই 'কিং অফ দা ইন্ডিয়ান রোডস' নব্বইয়ের দশকের পর থেকে এই গাড়ির পচন শুরু হলেও, এই প্রজন্মের কাছেও অ্যাম্বাসাডর কিংবা ট্যাক্সির কদর রয়েছে। কলকাতার রাস্তায় এখনো হলুদ ট্যাক্সি দেখা যায়, তবে সাদা অ্যাম্বাসাডর সংখ্যায় খুবই কম।

বর্তমানে এটি ভিন্টেজ গাড়ির তকমাধারী হলেও, ভারতের প্রাচীন ঐতিহ্যকে সেই আগের মতো ধরে রাখতে এই গাড়িটি জুড়ি মেলা ভার। আমাদের সকলের সঙ্গেই ছোটবেলার সঙ্গেই অ্যাম্বাসাডর গাড়ি যেন একেবারে ওতপ্রোতভাবে জড়িত। পায়ের সামনে বিশাল জায়গা বিশিষ্ট এই গাড়ি যেমন ছিল শক্তপোক্ত গঠনের, তেমনি ছিল আরামদায়ক। তবে আজকের দিনে আমরা যে অ্যাম্বাসাডর বা ট্যাক্সি এখনো পর্যন্ত দেখতে পাই তার গঠন কিন্তু একদিনে তৈরি হয়নি। দীর্ঘ বেশ কিছু বছর ধরে পরিবর্তন হয়েছে তার রং, তার গঠন এবং তার ইঞ্জিনের দক্ষতা। চলুন ইতিহাসের সরণি বেয়ে ফিরে যাওয়া যাক অতীতে আর দেখা যাক কিভাবে মার্কিন যুক্তরাজ্য থেকে ভারতের মাটিতে নিজের জায়গা তৈরি করে নিল অ্যাম্বাসাডর।


হিন্দুস্তান ল্যান্ডমাস্টার (১৯৫৪-১৯৫৮)

ভারতের অ্যাম্বাসাডর এর গল্পটা প্রথম শুরু হয় হিন্দুস্তান ল্যান্ডমাস্টার থেকেই। গাড়ি হিসেবে সেই যুগে ল্যান্ডমাস্টার ছিল ভারতের জন্য একটা মাইলস্টোন। ভারতে ঠিক সেইসময় ল্যান্ড মাস্টার নিয়ে আসা হয়েছিল, যে সময় ব্রিটেনে ফিয়াট কোম্পানির ১১০০ মিলিসেন্ট্রো লঞ্চ হয়েছে। ডিজাইন থেকে শুরু করে স্পেসিফিকেশন সবকিছুই যেন এই দুই গাড়ির একই রকম। শুধু একটি বিদেশি মডেল, অন্যটি একেবারে দেশি! যারা মূলত ড্রাইভার রেখে গাড়ি চালাতে পছন্দ করতেন, তাদের জন্য ল্যান্ড মাস্টার ছিল সেকালের প্রথম পছন্দ। এই ল্যান্ডমাস্টার গাড়িতে পাওয়া যেত ১.৫ লিটারের ৪ সিলিন্ডার সাইড ভালভ ইঞ্জিন। হিন্দুস্তান মোটরসের তরফ থেকে এই ল্যান্ড মাস্টার গাড়ির কয়েকটি এমন এডিশন লঞ্চ করা হয়েছিল যেখানে, সেই গাড়ির গঠনের মধ্যে লক্ষ্য করা গিয়েছিল কাঠের ব্যবহার। আদতে, মরিস অক্সফোর্ড সিরিজ ২ এর আদলে তৈরি করা হয়েছিল এই হিন্দুস্তান ল্যান্ডমাস্টারকে। যদিও পরবর্তীতে হিন্দুস্তান ল্যান্ডমাস্টারকে সরিয়ে দিয়ে অ্যাম্বাসাডরের পরের এডিশনকে মার্কেটে নিয়ে আসে হিন্দুস্তান মোটরস।

হিন্দুস্তান অ্যাম্বাসাডর MK-1 (১৯৫৮-১৯৬২)

হিন্দুস্তান অ্যাম্বাসাডর MK-1, এই গাড়িটি ছিল বর্তমান যুগের অ্যাম্বাসাডরের প্রথম রূপ। হিন্দুস্তান ল্যান্ড মাস্টার যখন তৈরি হওয়া বন্ধ হয়, সেই সময় থেকেই চালু হয় অ্যাম্বাসাডর MK-1। ১৯৫৮ সালের মাঝামাঝি নাগাদ হিন্দুস্তান মোটরসের উত্তরপাড়ার কারখানা থেকে উৎপাদন শুরু হয় এই নতুন অ্যাম্বাসাডরের। সাইড ভালভ একেবারে ল্যান্ডমাস্টারের মত থাকলেও, পরিবর্তন আসে এই গাড়ির ডিজাইন এবং অন্যান্য বেশ কিছু বৈশিষ্ট্যের ক্ষেত্রে। বডি ডিজাইন, ফ্রন্ট ডিজাইন, নতুন গ্রিল ডিজাইন, নতুন ডিজাইনের বনেট, এবং সর্বোপরি নতুন ডিজাইনের টেল, সব দিকেই পরিবর্তন আনা হয়েছিল এই নতুন গাড়িতে। এই গাড়ির টেল ফিন ডিজাইনটি ২০১৪ পর্যন্ত একইরকমভাবে বাঁচিয়ে রেখেছিল হিন্দুস্তান মোটরস। যদিও প্রথমদিকে এই গাড়িটির নাম ছিল শুধুমাত্র অ্যাম্বাসাডর। পরবর্তীতে যখন ১৯৬০ সালে এই গাড়ির সাইড ভালভ ইঞ্জিন সরিয়ে ওভারহেড ভালভ ইঞ্জিন ব্যবহার করা হয়, তখন এর সাথে যুক্ত হয় MK-1। তারপর থেকেই এই অ্যাম্বাসাডর গাড়িতে ব্যবহার হতে শুরু হয় Winged OHV ব্যাজ।

আরও পড়ুন-স্মৃতি উসকে ফিরছে বাঙালির ভরসা অ্যাম্বাসাডর, ঘুম কাড়বে নতুন লুক!


কিছুটা পরিবর্তন নিয়ে আসা হয় এই গাড়ির ডিজাইন এবং কন্ট্রোল প্যানেলেও। নতুন ডিজাইনের স্টিয়ারিং হুইল আসে, তার সাথে পরিবর্তন হয় ড্যাশবোর্ড। এতদিন পর্যন্ত মেটালের ড্যাশবোর্ড থাকলেও এবার থেকে ব্যবহৃত হতে শুরু হয় কাঠের ড্যাশবোর্ড। এই ধরনের গাড়িতেই সর্বশেষ ব্যবহার করা হয়েছিল সিমাফোর ইন্ডিকেটর লাইট। পরবর্তীতে, এই সিমাফোর ইন্ডিকেটর তুলে দিয়ে নিয়ে আসা হয় ফেন্ডার মাউন্টেড সাইড ইন্ডিকেটর, যার ব্যবহার শুরু হয় এর পরবর্তী অ্যাম্বাসাডর ভার্সন থেকে।


হিন্দুস্তান অ্যাম্বাসাডর MK-2 (১৯৬২-১৯৭৫)

হিন্দুস্তান অ্যাম্বাসাডর MK-2 নামটি দেওয়া হয় তখন থেকে, যখন আগের অ্যাম্বাসাডর গাড়িতে MK-1 নামটি ব্যবহার হওয়া শুরু হয়। এই নতুন লঞ্চ হওয়া গাড়িটি ছিল আগের MK-1 এর পরিবর্তিত একটি ভার্সন। এই গাড়িতে অনেক নতুন ফিচার ব্যবহার করা হয়েছিল এবং আগের থেকে এই গাড়িটি ছিল আরো বেশি আরামদায়ক। নতুন গাড়িতে একই রকম বডি প্যানেল এবং একই রকম ডিজাইন থাকলেও, পরিবর্তনশীল ফ্রন্ট গ্রিল এবং ড্যাশবোর্ড এর ক্ষেত্রে। নতুন MK-2 মডেলে আগের ডিজাইনের ফ্রন্ট গ্রিল সরিয়ে দেওয়া হয়েছিল এবং ব্যবহার করা হয়েছিল মরিস মিনি গাড়িতে ব্যবহার হওয়া বিশেষ ডিজাইনের ফ্রন্ট গ্রিল।

নতুন গাড়ির কাঠের তৈরি ড্যাশবোর্ডের ক্ষেত্রে আনা হয়েছিল কিছু পরিবর্তন। নতুন কিছু ডায়াল নিয়ে আসা হয়েছিল এই ড্যাশবোর্ড এর উপর। তবে ডিজাইন এবং স্পেস মোটামুটি অপরিবর্তিত ছিল। তবে এই নতুন ভার্সনে একটা বড় পরিবর্তন ছিল। এই নতুন MK-2 গাড়িতে ব্যবহার করা হয়েছিল টু-টোন অপশন, যার সাথেই সাইডে ছিল ক্রোম ড্রাইভিং ট্রিম। আফটারমার্কেট অ্যাপ্লিকেশনের ক্ষেত্রে এই ফিচারটি হয়ে উঠেছিল অত্যন্ত জনপ্রিয়।

হিন্দুস্তান অ্যাম্বাসাডর MK-3 (১৯৭৫-১৯৭৯)

১৯৭৫ সালে MK-2 কে পরিবর্তন করে মার্কেটে আসে MK-3। একটা লম্বা সময় পর্যন্ত ভারতীয় মার্কেটে সবথেকে জনপ্রিয় গাড়ি হিসেবে টিকে ছিল হিন্দুস্তান অ্যাম্বাসাডর MK-2। নতুন MK-3 গাড়িতে তেমনভাবে ফিচার এর দিক থেকে কোন পরিবর্তন নিয়ে আসা হয়নি। এক্সটেরিয়র ডিজাইন প্রায় আগের গাড়ির মতোই ছিল। শুধু পরিবর্তন করা হয়েছিল ফ্রন্ট গ্রিলে। এবারেও মরিস মিনি গাড়ির মতই একটি ফ্রন্ট গ্রিল ডিজাইন ব্যবহার করা হয়েছিল MK-3 গাড়িতে। পাশাপাশি, হেডল্যাম্পের নিচে গোলাকৃতি ইন্ডিকেটর ব্যবহার করা হয়েছিল। এতদিন পর্যন্ত যে সমস্ত গাড়ি মার্কেটে আসছে সেখানে একটি ইউনিট এর মধ্যেই ফ্রন্ট গ্রিল এবং ফ্রন্ট ইন্ডিকেটর ব্যবহার করা হতো। নতুন MK-3 থেকে পরিবর্তন হলো বিষয়টা। দুটি আলাদা আলাদা ইউনিটে ভাগ করে দেওয়া হল এই দুটি জিনিসকে।

ফ্রন্ট এবং রিয়ার বাম্পার ওভার রাইডার যদিও তৈরি করা হয়েছিল মেটাল দিয়েই। বাম্পার ওভার রাইডার পরিবর্তিত না হলেও, কিছু পরিবর্তন আনা হয়েছিল ড্যাশবোর্ডে। নতুন ড্যাশবোর্ডে ছিল একেবারে মর্ডান ডিজাইন এবং ব্যবহার করা হয়েছিল চারটি নতুন গেজ। MK-3 ছিল অ্যাম্বাসাডর এর প্রথম গাড়ি যেখানে, টু ট্রিম লেভেল ব্যবহার করা হয়েছিল - স্ট্যান্ডার্ড এবং ডিলাক্স।

হিন্দুস্তান অ্যাম্বাসাডর MK-4 (১৯৭৯-১৯৯০)

MK-3 গাড়িটি খুব একটা বেশি সময়ের জন্য মার্কেটে টিকে থাকতে পারেনি। তার জায়গা নিয়ে হাজির হয় MK-4। হিন্দুস্তান মোটরসের এই গাড়িতে ব্যবহার করা হয়েছিল একেবারে নতুন ফেস ডিজাইন এবং ব্যবহৃত হয়েছিল অনেক ছোট আকৃতির গ্রিল। এই MK-4 ডিজাইনের পরে আর ক্লাসিক অ্যাম্বাসাডরের কোনো পরিবর্তন আসেনি। ২০১৪ পর্যন্ত ভারতে যে অ্যাম্বাসাডর তৈরি করা হতো, তাতে সব সময়ই ব্যবহার করা হতো এই একই ডিজাইন। নতুন করে ডিজাইন করা ফ্রন্ট গ্রিল, চৌকো পার্কিং ল্যাম্প, চেকার্ড ফ্ল্যাগ ডিজাইনের ফ্রন্ট লুক সহ আরো কিছু পরিবর্তন আনা হয়েছিল MK-4 গাড়িতে।

এই নতুন অ্যাম্বাসাডর গাড়িতে ব্যবহার করা হয়েছিল ফ্রন্ট লিপ স্পয়লার। এই গাড়ির বাম্পার এর ঠিক নিচে ব্যবহার করা হয়েছিল একটি অ্যাম্বার ইন্ডিকেটর লাইট। এছাড়াও পরিবর্তন করা হয়েছিল ইন্টেরিয়ার এবং ড্যাশবোর্ড এর ক্ষেত্রে। তবে সব থেকে বড় বিষয়টি ছিল এই গাড়ির ইঞ্জিন। MK-4 ছিল ভারতের প্রথম অ্যাম্বাসাডর, যেখানে আনা হয়েছিল একটি ডিজেল ইঞ্জিন অপশন। এতদিন পর্যন্ত শুধুমাত্র পেট্রোল চালিত ইঞ্জিন দেওয়া হতো অ্যাম্বাসাডর গাড়িতে। কিন্তু, মধ্যবিত্তের চাহিদার কথা ভেবে, প্রথমবারের জন্য অ্যাম্বাসাডর MK-4 গাড়িতে নিয়ে আসা হয় ডিজেল ইঞ্জিন অপশন। ১.৫ লিডারের বিএমসি বি-সিরিজের ৩৭ বিএইচপি ক্ষমতা বিশিষ্ট একটি ইঞ্জিন ব্যবহার করা হয়েছিল এই অ্যাম্বাসাডর গাড়িতে। সেই যুগের অন্যান্য ডিজেল চালিত গাড়ির থেকে অনেকটাই ভালো পারফর্মেন্স দিয়েছিল এই বিশেষ ইঞ্জিনটি। পাশাপাশি পেট্রোলের থেকে ডিজেলের দাম সেই সময় অনেকটাই কম ছিল। তাই মধ্যবিত্তের কাছে ডিজেল অপশন অনেকেই সুবিধাজনক হয়ে ওঠে, এবং বিক্রিও বাড়ে ততোধিক।

হিন্দুস্তান অ্যাম্বাসাডর নোভা (১৯৯০-১৯৯৯)

এই নোভা ডিজাইনের গাড়িটিই আজকের যুগের অ্যাম্বাসাডর অথবা ট্যাক্সি। দুটি ইঞ্জিন অপশন এর সাথে ১৯৯০ সালে লঞ্চ হওয়া এই গাড়িতে ছিল বেশ কিছু মডার্ন এবং অ্যাডভান্স ফিচার। এই গাড়িটিতে প্রথমত ছিল ১.৫ লিটারের ৫৫ বিএইচপি ক্ষমতা বিশিষ্ট একটি পেট্রোল ইঞ্জিন, এবং তার পাশাপাশি ছিল ২ লিটারের ৩৭ বিএইচপি ক্ষমতা বিশিষ্ট ডিজেল ইঞ্জিন। ইঞ্জিন ক্যাপাসিটির দিক থেকে MK-4 এর তুলনায় কোনো পরিবর্তন ছিল না নোভা মডেলটিতে। তবে, MK-4 মডেলের দাম অত্যন্ত বেশী ছিল। এই কারণে মধ্যবিত্ত সাধারণ মানুষ এই গাড়ি কিনতে পারতেন না। তাদের কথা ভেবেই MK-4 এর একটি ইকনোমিক্যাল এবং সস্তা ভার্সন নিয়ে আসে হিন্দুস্তান মোটরস। কস্ট কাটিং করার জন্য এতদিন পর্যন্ত যে ধরনের গ্রিল ব্যবহার করা হতো, সেটা পাল্টে দিয়ে একেবারে সাধারণ গ্রিল ব্যবহার করা শুরু হয়। ওভার রাইডার বাম্পার সরিয়ে দেওয়া হয় এবং সেই জায়গায় নিয়ে আসা হয় রাবার বাম্পার। অ্যাম্বার ইন্ডিকেটর সরিয়ে দেওয়া হয় এবং সেই জায়গায় হেড ল্যাম্পের নিচে নিয়ে আসা হয় অ্যাম্বার পার্কিং লাইট এবং ইন্ডিকেটর ইউনিট।

MK-3 এর মত গোল ডিজাইন আবারো ফিরিয়ে আনা হয়, তবে এবারের ডিজাইনটি অনেক বেশি ছোট এবং অনেকটাই চোঙাকৃতি। ১৯৯২ সালে নোভা গাড়িতে ব্যবহার করা হয় ইসুজু কোম্পানির পেট্রোল ইঞ্জিন। এই ইঞ্জিন আসার পরে গাড়ির দাম আরো একটু কমে যায়। ১.৮ লিটারের পেট্রোল ইঞ্জিন নিয়ে আসার ফলে জনসাধারণের কাছে আরো বেশি আকর্ষণীয় হয়ে ওঠে নোভা। ৭৫ বিএইচপি ক্ষমতার ফোর সিলিন্ডার ইউনিট এবং ফাইভ স্পিড ম্যানুয়াল গিয়ার বক্স নিয়ে আসা হয় মারুতি সুজুকির সঙ্গে টক্কর দেওয়ার জন্য। তবে তেমন একটা লাভ হয়নি। ফাইভ স্পিড ম্যানুয়াল গিয়ার বক্স ইউনিট শুধুমাত্র ভিআইপি মডেলে নিয়ে আসা হয়েছিল। কিন্তু, সাধারণ মানুষের বাজেটে এই ভিআইপি মডেল কোনভাবেই আসতে পারতো না। সেই জায়গা থেকেই অনেকটা ছোট ইঞ্জিনের এবং অনেক বেশি রেস্পন্সিভ গাড়ি তৈরি করে মার্কেট দখল করতে শুরু করে মারুতি সুজুকি। মারুতি সুজুকির গাড়িগুলি অ্যাম্বাসাডরের থেকে হয়ে ওঠে অনেক বেশি জনপ্রিয়। ১.৮ লিটারের ইসুজু ইঞ্জিন কখনোই তেমন একটা জনপ্রিয়তা পায়নি ভারতের মার্কেটে।

হিন্দুস্তান অ্যাম্বাসাডর গ্র্যান্ড/ ক্লাসিক/ এনকোর (২০০০-২০১৪)

নোভা মডেলের সময় থেকেই ভারতীয় মার্কেটে আস্তে আস্তে পিছিয়ে পড়তে শুরু করেছিল হিন্দুস্তান মোটরসের অ্যাম্বাসাডর। এই পরিস্থিতি থেকে তাদের পুরনো ব্র্যান্ডকে আবারো ফিরিয়ে আনার চেষ্টা করে ২০০০ সালে হিন্দুস্তান মোটরস লঞ্চ করে হিন্দুস্তান অ্যাম্বাসাডর গ্র্যান্ড। বাম্পার ইমপ্রুভমেন্ট, উন্নত মানের ইন্টেরিয়র ডেকোরেশন, প্লাস্টিক ড্যাশবোর্ড, এয়ারকন্ডিশনিং সিস্টেম, হালকা বাদামী রঙের ইন্টেরিয়ার ডেকোরেশন, পাওয়ার স্টিয়ারিং, ১.৮ লিটারের ইসুজু পেট্রোল ইঞ্জিন, সবকিছু নিয়ে ক্লাসিক ছিল ২০০০ এর প্রথম দিককার একটি জনপ্রিয় গাড়ি। কিন্তু ধীরে ধীরে এই গাড়িটির জনপ্রিয়তাও কমতে শুরু করে।

জাপানি গাড়ি নির্মাতা সংস্থা সুজুকি, ভারতীয় সংস্থা মারুতির সঙ্গে একসাথে মিলে এমন কিছু গাড়ি তৈরি করতে শুরু করে যা সেই যুগে একের পর এক মাইলস্টোন হাসিল করতে থাকে। কয়েক বছর যাবৎ গ্র্যান্ড এবং ক্লাসিক চলার পর, ২০১৩ সালে হিন্দুস্তান মোটরস লঞ্চ করে অ্যাম্বাসাডর এনকোর। এই এনকোর গাড়িতে পাওয়া যাচ্ছিল BS-4 ইঞ্জিন, এবং ৫ স্পিড গিয়ার বক্স। তবে, ইঞ্জিন এবং এমিশন টেকনোলজি ভালো হলেও, গাড়িটি জনপ্রিয়তা পায়নি, কারণ সেই সময়ে যে সমস্ত গাড়ি মার্কেটে রয়েছে তাদের থেকে অনেকটাই ধীরে ধীরে চলত অ্যাম্বাসাডর এনকোর। ২০১৩-১৪ আর্থিক বছরে মাত্র ২৫০০ ইউনিট গাড়ি বিক্রি করেছিল হিন্দুস্তান মোটরস, এবং সেগুলো কোনোভাবেই প্রাইভেট গাড়ি নয়, কলকাতা এবং দিল্লির মত শহরে মূলত ট্যাক্সি হিসেবে ব্যবহার হতো সেই সমস্ত গাড়ি। এতটাই কমে গিয়েছিল জনপ্রিয়তা, যে অবশেষে বন্ধ করতে হয় প্রোডাকশন। ২০১৪ সালে তালা পড়ে উত্তরপাড়া কারখানায়।

অ্যাম্বাসাডর ২.০

ভারতীয় পথের রাজাকে আবারো ফিরিয়ে আনার জন্য এবার তৎপর হিন্দুস্তান মোটরস। তাদের সাথেই আছে ফরাসি গাড়ি নির্মাতা কোম্পানি পিউজো। ৩০ বছর আগে দিলীপ ছাবারিয়া প্রতিষ্ঠিত একটি ডিজাইন হাউসের হাতে সঁপে দেওয়া হয় নতুন অ্যাম্বাসাডরের ডিজাইন তৈরির দায়িত্ব। সম্প্রতি এই নতুন ডিজাইনের কিছু ফার্স্ট লুক সামনে এসেছে নেট দুনিয়ার। অ্যাম্বাসাডরকে আধুনিক করে তোলার জন্য ডিজাইনে বেশ কিছু পরিবর্তন আনা হয়েছে। আগে যেখানে অ্যাম্বাসাডরের সামনে থাকত হরাইজনটাল গ্রিল, সেখানেই এবার থাকবে ক্রোমের ফ্রেম। গোল হেডলাইট এর বদলে এলইডি হেডলাইট ব্যবহার করা হবে। বনেটের আকৃতি অনেকটা আগের মত থাকলেও, পরিবর্তন হবে চেহারায়। আগে যেখানে থাকতো চারটি দরজা, সেখানেই এবার থাকবে দুটি। গাড়ির চাকার মেকওভার হচ্ছে। মাল্টি স্পোক স্টিল রিম ব্যবহার করা হবে নতুন চাকায়। ২০১৪ সালে উৎপাদন বন্ধ হবার আগে বেশ কয়েকবার এই গাড়ির মডেলে পরিবর্তন করা হলেও, কোনভাবেই আধুনিক গাড়ির সঙ্গে সেই সমস্ত মডেল পাল্লা দিতে পারত না। তবে এবারের মডেল অনেকাংশেই আলাদা। বিএমডব্লিউ কোম্পানির একাধিক গাড়ির আদল নিয়ে আসার চেষ্টা করা হয়েছে নতুন ডিজাইনে। থাকছে আধুনিক ইলেকট্রিক ভেহিকেল সিস্টেম এবং ইভি সাপোর্টেড ইঞ্জিন। আগে যেখানে শুধুমাত্র ট্যাক্সি হিসেবে দেখা যেত এই গাড়িটিকে, সেখানেই মডার্ন লুকের মাধ্যমে সকলকে চমকে দিতে প্রস্তুত 'অ্যাম্বি'।

More Articles