কাফালা ব্যবস্থা: শেষ হচ্ছে সৌদির আধুনিক দাসত্ব?

Saudi Arabia Ends 50-Year-Old Kafala System : শ্রমিকরা নিজেদের চাকরি বদলাতে পারতেন না, কাজ ছাড়তে বা অন্য জায়গায় যেতে পারতেন না নিয়োগকর্তার অনুমতি ছাড়া। ফলে অনেক সময় শ্রমিকরা ভয়, শোষণ ও অনিশ্চয়তার মধ্যে কাজ করতেন।

৫০ বছর পর সৌদি আরবের বিতর্কিত 'কাফলা' তথা শ্রমব্যবস্থার অবসান ঘটছে। এই ব্যবস্থার কারণে এতদিন ধরে লক্ষ লক্ষ বিদেশি শ্রমিক নিয়োগকর্তার সম্পূর্ণ নিয়ন্ত্রণে থেকে কাজ করতেন। এবার সেই শ্রমব্যবস্থা ভেঙে, সরকার ঘোষণা করেছে নতুন শ্রমনীতির। এর ফলে বিদেশি কর্মীরা আরও বেশি স্বাধীনতা ও অধিকার পাবেন।

‘কাফালা’ শব্দের অর্থ স্পনসরশিপ বা দায়িত্ব নেওয়া। এই ব্যবস্থায় সৌদি আরব ও গাল্ফ দেশগুলিতে বিদেশি শ্রমিকদের ভিসা, কাজ, এমনকি দেশে ফেরার অনুমতিও নির্ভর করত এক জন নিয়োগকর্তা বা 'কাফিল'-এর উপর। অর্থাৎ, শ্রমিক নিজের চাকরি বদলাতে পারতেন না, কাজ ছাড়তে বা অন্য জায়গায় যেতে পারতেন না নিয়োগকর্তার অনুমতি ছাড়া। ফলে অনেক সময় শ্রমিকরা ভয়, শোষণ ও অনিশ্চয়তার মধ্যে কাজ করতেন। নানা মানবাধিকার সংস্থা এই ব্যবস্থাকে 'আধুনিক দাসত্বের' সঙ্গে তুলনা করেছে। ১৯৫০-এর দশক থেকে সৌদি আরব-সহ মধ্যপ্রাচ্যের বিভিন্ন দেশে এই কাফালা ব্যবস্থা চালু ছিল।

নতুন সিদ্ধান্তে কী বদলাচ্ছে?

সৌদি সরকারের নতুন সিদ্ধান্তে এখন থেকে বিদেশি শ্রমিকরা নিজের কাজ পরিবর্তন করতে পারবেন নিয়োগকর্তার অনুমতি ছাড়াই। তাঁরা চাইলে দেশ ছাড়ার ভিসাও নিজে থেকেই নিতে পারবেন, আগের মতো আর 'এক্সিট পারমিট' নেওয়ার দরকার হবে না। তাছাড়া, শ্রমিকদের জন্য চুক্তি-ভিত্তিক নিয়োগ ব্যবস্থা চালু হচ্ছে, যেখানে তাঁদের অধিকার, নিরাপত্তা ও কাজের শর্ত আরও স্পষ্টভাবে নির্ধারণ করা থাকবে। সরকারের হিসাব অনুযায়ী, এই সিদ্ধান্তের ফলে প্রায় ১৩ মিলিয়ন (১ কোটি ৩০ লাখ) বিদেশি শ্রমিক উপকৃত হবেন।

আরও পড়ুন

অন্তরঙ্গতাই উপার্জন, অন্তরঙ্গতাই ভয়: শহরের মহিলা সেবাশ্রমিকদের রোজনামচা

নতুন নিয়মে শ্রমিকরা—

• আগের চাকরি ছেড়ে অন্য কোম্পানিতে যোগ দিতে পারবেন 

• নির্দিষ্ট সময়ের চুক্তি শেষ হওয়ার পর নিজের ইচ্ছা মতো নতুন চাকরি নিতে রবেন

• প্রয়োজনে পরিবারের সঙ্গে দেশে যেতে পারবেন নিয়োগকর্তার অনুমতি ছাড়া

• অভিযোগ জানাতে পারবেন সরকারের শ্রম মন্ত্রণালয়ে, যাতে তাঁদের সমস্যার দ্রুত সমাধান হয়

উল্লেখ্য, সৌদি আরবের অর্থনীতি বহু বছর ধরে বিদেশি শ্রমিকদের উপর নির্ভরশীল। বাংলাদেশ, ভারত, পাকিস্তান, নেপাল ও ফিলিপাইন থেকে লক্ষ লক্ষ মানুষ কাজ করতে যান সেখানে। কিন্তু কাফালা ব্যবস্থার কারণে তাঁদের অনেকেই শোষণের শিকার হয়েছেন। পাসপোর্ট আটক রাখা, বেতন আটকে দেওয়া, অতিরিক্ত সময় কাজ করানো, এমন নানা অভিযোগ ছিল।

এই সংস্কার সৌদি সরকারের 'ভিশন ২০৩০'-এর অংশ। দেশটি তেলের উপর নির্ভরতা কমিয়ে নতুন শিল্প, পর্যটন ও প্রযুক্তি খাতে রূপান্তর আনতে চায়। এজন্য আধুনিক শ্রমনীতি খুব প্রয়োজন ছিল। সরকারের দাবি, এই পরিবর্তন শ্রমবাজারকে আরও প্রতিযোগিতামূলক ও মানবিক করবে।

আরও পড়ুন

স্বাধীন কাজের ইন্দ্রজালে কীভাবে প্রতারিত হচ্ছেন গিগ শ্রমিকেরা?

তবে মানবাধিকার সংগঠনগুলো বলছে, আইনের বদলই শেষ কথা নয়। বাস্তবে এই নিয়ম ঠিকভাবে প্রয়োগ করা এবং শ্রমিকদের সচেতন করাই সবচেয়ে বড়ো চ্যালেঞ্জ। অনেক শ্রমিকই হয়ত জানবেন না, তাঁদের নতুন অধিকার কীভাবে ব্যবহার করবেন। ভাষাগত বাধা, ভয় বা তথ্যের অভাবে তাঁরা পুরনো নিয়মের মধ্যেই থেকে যেতে পারেন। আরেকটি চ্যালেঞ্জ নিয়োগকর্তাদের মানসিকতা। যারা এতদিন পুরনো শ্রমনীতি মানতেন, তাঁদের অনেকে হয়ত নতুন নিয়ম সহজে মানবেন না। তাই সরকারের পক্ষ থেকে কড়া নজরদারি, তদারকি ও প্রচার চালানো জরুরি।

জাতিসংঘ ও বিভিন্ন মানবাধিকার সংস্থা সৌদি আরবের এই সিদ্ধান্তকে ঐতিহাসিক বলে বর্ণনা করেছে। তাদের মতে, এটি মধ্যপ্রাচ্যে শ্রমিক অধিকার রক্ষায় নতুন যুগের সূচনা করবে।বাংলাদেশ-সহ শ্রম রফতানিকারক দেশগুলিও এই পরিবর্তনে স্বস্তি পেয়েছে। কারণ এতদিন সৌদি আরবে কর্মরত প্রবাসীদের অধিকাংশই অভিযোগ জানাতে পারতেন না। এখন তাঁদের জন্য আইনি পথ অনেক সহজ হবে।

৫০ বছর পর সৌদি আরবের কাফালা ব্যবস্থার পরিসমাপ্তি শ্রমিক জীবনে বড় পরিবর্তন আনতে পারে। এই সিদ্ধান্ত বাস্তবে কার্যকর হলে বিদেশি শ্রমিকদের জীবন অনেক সহজ ও সম্মানজনক হবে। তবে আইন বদল যতই গুরুত্বপূর্ণ হোক, আসল সাফল্য নির্ভর করবে বাস্তব প্রয়োগ ও শ্রমিকদের সচেতনতার উপর। এই পরিবর্তন শুধু সৌদি আরব নয়— পুরো গাল্ফ অঞ্চলে মানবাধিকারের ইতিহাসে নতুন অধ্যায়ের সূচনা করতে পারে।

More Articles