ভূতচতুর্দশী | আজও জেগে ওঠে পেঁচাপেঁচি, চোরাচুন্নি, ঝেঁয়ো পেত্নীর মতো বাঙালি ভূতেরা?
Bhoot Chaturdashi Bengali Ghosts: ভূতচতুর্দশীর ভয়ঙ্কর সেসব ভূত বিশ্বায়নের যুগে আর সাহেবি হ্যালোইনের হাওয়ায় কি ক্রমেই ফিকে হয়ে যাচ্ছে?
ভূত হলেও তো তাদের রি-ইউনিয়নের ইচ্ছে হয়। তাই তারা সকলে মিলে কালীপুজোর আগের দিন দল বেঁধে নেমে আসে পৃথিবীতে। মিশে যায় মানুষদের মধ্যে। আমরা হয়তো দেখতে পাই না কিন্তু তাদের অনুভব করেন কেউ কেউ। হতেও পারে ধরুন, রাতে হাঁটছেন। আপনি বুঝতে পারছেন আপনার পাশাপাশি হাঁটছে অন্য একজন কিন্তু কিছুই দেখতে পারছেন না! সমস্তটাই অনুভব করতে পারছেন। ভূতচতুর্দশীর রাতে বাঙালি তাই একটু বেশিই সাবধানী। গৃহস্থের দুরন্ত ছেলে-মেয়েদের তাই শান্ত রাখার ঔষধ ভূত চতুর্দশী রাত। বাঙালি কার্তিক মাসের কৃষ্ণপক্ষের চতুর্দশীর দিন পালন করে ভূতচতুর্দশী। এই রীতি কিন্তু পাশ্চাত্য দেশেও পালন করা হয়। পাশ্চাত্যে এই রীতিকে বলে — 'হ্যালোইন'। আর কালীপুজোর আগের রাত হচ্ছে বাঙালির ভূতেদের রাত, অশরীরির রাত। ভূতচতুর্দশীর ভয়ঙ্কর সেসব ভূত বিশ্বায়নের যুগে আর সাহেবি হ্যালোইনের হাওয়ায় কি ক্রমেই ফিকে হয়ে যাচ্ছে? অধিকাংশ বাঙালিই কি বাংলার আদি ভূতদের চেনে? এই বাংলার সেই প্রাচীন ভূতদের রোল কল হয়ে যাক তাহলে!
১) নিশি: ভূতদের মধ্যে অন্যতম ভয়ঙ্কর হলো নিশি। অন্যান্য ভূত সাধারণত নির্জন এলাকায় মানুষকে একা পেলে আক্রমণ করে কিন্তু নিশি গভীর রাতে শিকারকে তাঁর প্রিয় মানুষের কণ্ঠে নাম ধরে ডাকে এবং বাইরে বের করে নিয়ে যায়। ব্যাস! নিশির ডাকে সাড়া দিয়ে মানুষ সম্মোহিত হয়ে ঘরের দরজা খুলে বেরিয়ে পড়ে, আর কখনও ফিরে আসে না। লlোককথায় বলে, তারা নিজেরাও নিশি হয়ে যায়। গল্পকাহিনিতেই আছে, কিছু কিছু তান্ত্রিক অন্যের বিরুদ্ধে প্রতিশোধ নেওয়ার জন্য নিশি পুষে থাকেন। তবে, লোককাহিনি অনুসারে নিশিরা কোনও মানুষকে দু'বারের বেশি ডাকতে পারে না।
২) ডাইনি: এক ভয়াবহ কুসংস্কার। ডাইনিরা কোনও আত্মা নয়, জীবিত নারী। কুসংস্কারে, মহিলাদের প্রতি চরম বিদ্বেষ থেকেই অশিক্ষার আড়ালে বলা হতো, বৃদ্ধ মহিলা যারা কালো জাদু বা ডাকিনিবিদ্যাতে পারদর্শী তারাই ডাইনি। ডাইনিরা নাকি গ্রামের ছোট ছোট ছেলে মেয়েদের ধরে নিয়ে তাদের হত্যা করে এবং তাদের হাড়, মাংস ও রক্ত খেয়ে ১০০ বছর বেঁচে থাকে। এই কুসংস্কারের বশে আজও বহু মহিলাকে ডাইনি সন্দেহে হত্যা করা হয় এই দেশে।
আরও পড়ুন- ‘আত্মা’ও কথা বলতে চায়! বিজ্ঞান নয়, বিশ্বাসে ভর দিয়ে ভূত খোঁজেন এই গোয়েন্দারা!
৩) পেত্নী: পেত্নী হচ্ছে সেই মহিলা ভূত যারা অবিবাহিত অবস্থায় মারা গেছেন বা বেঁচে থাকতে যাদের কিছু অতৃপ্ত আশা ছিল। পেত্নী শব্দটি সংস্কৃত প্রেত্নী শব্দ থেকে এসেছে। এসব ভূত সাধারণত যে কোনও আকৃতি ধারণ করতে পারে, এমনকী পুরুষের আকারও। এসব ভূত সাধারণত বেঁচে থাকাকালীন কোনও না কোনও অপরাধ করেছে, তারপর অভিশপ্ত হয়ে পৃথিবীতে বিচরণ করছে। পেত্নীরা সাধারণত ভীষণ বদমেজাজি হয়ে থাকে। আর পেত্নীদের পায়ের পাতাগুলি নাকি পিছনের দিকে।
৪) পেঁচাপেঁচি: এ ধরনের ভূত সচরাচর দেখা যায় না। পেঁচাপেঁচি ভূতের ধারণাটি পেঁচা থেকে এসছে, এর স্ত্রীলিঙ্গ হচ্ছে পেঁচি। এরা জোড়া হয়ে শিকার করে থাকে। বাংলার বিভিন্ন জঙ্গলে এদের দেখা যায় বলে বিশ্বাস করা হয়। জঙ্গলে কিছু দুর্ভাগা ভ্রমণকারীদের পিছু নেয় এরা। লোককাহিনি বলছে, সম্পূর্ণ একাকী অবস্থায় ভ্রমণকারীকে আক্রমণ করে মেরে এরা শিকারের মাংস ছিঁড়ে খায়।
৫) ব্রহ্মদৈত্য: ফেমাস ভূত! এরা সাধারণত কারও ক্ষতি করে না। এরা নাকি আবার ব্রাহ্মণের ভূত, তাই মরার পরেও ধুতি-পৈতার মায়া এদের কাটে না। তবে ব্রহ্মদৈত্য নাকি অত্যন্ত দয়ালু। মানুষের অনেক উপকার করে থাকে তারা।
৬) ঝেঁয়ো পেত্নী: সাধারণত ঝাউগাছে এরা নিজেদের লুকিয়ে রাখে। ভরসন্ধ্যায় পথিক যদি একা একা সেই ঝাউবন বা জঙ্গল পেরোতে যায়, তখন তাকে ধরে ঝাউয়ের মগডালে চড়িয়ে দেয় এই জাতীয় পেত্নীরা।
৭) ডাকিনী: ডাকিনীরা নাকি পাতিহাঁস খেতে খুব ভালোবাসে। থাকে পুকুর বা দিঘির ধারে কোনও তাল বা নারকেল গাছে। রাতদুপুরে মেয়েদের বেশে ঘুরে বেড়ানো এদের অন্যতম অভ্যাস।
আরও পড়ুন- চতুর্দিকে ‘প্রেতে’র ভিড়! রোম খাড়া হয়ে যায় ভারতের ১৪ দিনের এই ভূতমেলায়
৮) স্কন্ধকাটা: এই ভূতেরা মাথাবিহীন হয়ে থাকে। লোককাহিনি বলছে, এরা হলো সেইসব লোকের আত্মা যাদের মৃত্যুর সময় মাথা কেটে গেছে। এই শ্রেণির ভূতেরা সবসময় তাদের হারানো মাথা খুঁজে বেড়ায় এবং অন্য মানুষকে আক্রমণ করে তাদের দাসে পরিণত করে ও মাথা খোঁজার কাজে নিয়োগ করে।
৯) মামদো ভূত: কে বলে ভূতের জাত পাত নেই! ব্রহ্মদৈত্য যখন আছে, মুসলমানরা ভূত হয়ে যাবে কোথায়? মামদো নাকি হিন্দু বিশ্বাস মতে মুসলমান আত্মা।
১০) শাঁকচুন্নি: শাকচুন্নি শব্দটি সংস্কৃত শব্দ শাকচুরনী থেকে এসেছে। এরা হচ্ছে বিবাহিত মহিলাদের ভূত। এই ভূতরা বাঙালি মহিলার মতো শাড়ি পরে, বিবাহিতের মতো হাতে শাঁখা পরে। শাঁকচুন্নিরা সাধারণত ধনী বিবাহিত মহিলাদের ভেতর ভর করে বা আক্রমণ করে যাতে তারা নিজেরা সেই মহিলার মতো জীবনযাপন করতে পারে। লোকগাথা অনুসারে তার আম গাছে বাস করে।
১১) মেছোভূত: এই ভূতেরা মাছ খেতে পছন্দ করে। মেছো ভূত সাধারণত গ্রামের কোনও পুকুর পাড়ে বা লেকের ধারে যেখানে বেশি মাছ পাওয়া যায় সেখানে বাস করে। মাঝে মাঝে তারা রান্নাঘর বা জেলেদের নৌকো থেকেও মাছ চুরি করে খায়। বাজার থেকে কেউ মাছ কিনে গাঁয়ের রাস্তা দিয়ে ফিরলে এরা তার পিছু নেয় এবং নির্জন বাঁশঝাঁড়ে বা বিলের ধারে ভয় দেখিয়ে আক্রমণ করে মাছ ছিনিয়ে নেয়।
১২) চোরাচুন্নি: চোরাচুন্নি অত্যন্ত বদমাইশ ভূত। এরা মানুষের অনিষ্ট করে। সাধারণত কোনও মরে গেলে নাকি চোরাচুন্নি হয়ে যায়। পূর্ণিমার রাতে এরা বের হয় এবং মানুষের বাড়িতে ঢুকে অনিষ্ট করে।
এত ধরনের ভূতের ভিড়ে ভূতচতুর্দশীর রাতে মানুষ কিন্তু একা! ভূত মানুষে মিশে যায়, নাকি মানুষই ধীরে ধীরে ভূত হয়ে যায় বলা মুশকিল। তবে বাঙালির এই ভূতেদের সংরক্ষণ অবশ্যই দরকার। শুধু ভূতচতুর্দশী পালনে অবশ্য তা সম্ভব না। বাংলার লোককথাগুলির পুনর্জন্ম ঘটালে হয়তো বাঙালি ভূতেদের জন্য একখানা হল অব ফেম গড়া যদেতেও পারে।