ঠিক সিনেমার ক্লাইম্যাক্স! মহারাষ্ট্রের রাজনৈতিক পরিণতি নিয়ে টানটান উত্তেজনা
পরিস্থিতি আরও জটিল করেছেন শিবসেনার সঞ্জয় রাউত। এক ট্যুইটে চরম পরিণতির ইঙ্গিত দিয়েছেন। রাজ্যের বর্তমান রাজনৈতিক সংকটের মধ্যেই মহারাষ্ট্র বিধানসভা ভেঙে দেওয়ার ইঙ্গিত দিয়েছেন রাউত।
মহারাষ্ট্রে বেমক্কা ভেন্টিলেশনে চলে গেল 'মহাবিকাশ অঘাড়ি' সরকার। জটিল রাজনৈতিক আবর্তে পাক খাচ্ছে মহারাষ্ট্র। কোনও নীতি, আদর্শ বা উদ্ধব ঠাকরের বিশেষ কোনও সিদ্ধান্তের কারণে কিন্তু সরকারের এই টলোমলো অবস্থা নয়। খোদ শিবঠাকুরের আপন সেনা-রাই নিজেদের স্বার্থে নিজেদের ঘর তছনছ করছে। কিছুই অসম্ভব নয়, পরবর্তী সময় হয়তো দলও বদলে ফেলতে পারে সৈনিকরা। ঠাকুর-দেবতাদের সেনা-ই যদি এমন সব কাণ্ড ঘটায়, তাহলে কেই-ই বা ভরসাযোগ্য!
মুম্বই সিনেমার ক্লাইম্যাক্সের ধাঁচেই টানটান উত্তেজনা মহারাষ্ট্রজুড়ে। সরকারের বাঁচা-মরা বিতর্কের মাঝেই ঢুকে পড়েছে করোনা। জানা গিয়েছে, করোনা-আক্রান্ত হয়েছেন মহারাষ্ট্রের মুখ্যমন্ত্রী উদ্ধব ঠাকরে এবং রাজ্যপাল ভগৎ সিংহ কোশিয়ারি। ঠাকরে মন্ত্রিসভার বৈঠক করবেন ভার্চুয়ালি, ওদিকে, রাজ্যপাল সরাসরি ভর্তি হয়েছেন হাসপাতালে।
নাটকের পর নাটক। একদিকে বিপাকে পড়া সরকার বাঁচাতে তড়িঘড়ি বৈঠক করছেন মুখ্যমন্ত্রী উদ্ধব ঠাকরে। বৈঠকে হাজির শরিক এনসিপি এবং কংগ্রেসের নেতারা। শিন্ডের গোঁসা ভাঙানোর চেষ্টা করেছিলেন ঠাকরে। কিন্তু, তাতে চিঁড়ে ভেজেনি। তারপরেই বিধানসভার দলনেতার পদ থেকে একনাথ শিন্ডেকে সরিয়ে দিয়েছেন উদ্ধব।
আরও পড়ুন: মহারাষ্ট্রে সরকার ভাঙতে চাইছে বিজেপি? শিবসেনার অন্তর্দ্বন্দ্বে যে জল্পনা উঠে আসছে
'বিদ্রোহী' নেতা একনাথ শিন্ডেও বসে নেই। রাতারাতি গুজরাতের সুরাত থেকে সদলবলে উড়ে গিয়েছেন অসমের গুয়াহাটি। সেখানে একটি বিলাসবহুল হোটেলকে কার্যত দুর্গ বানিয়ে রয়েছেন শিন্ডেবাহিনী। হোটেলে এসে শিন্ডের সঙ্গে দেখা করে গিয়েছেন অসমের মুখ্যমন্ত্রী হিমন্ত বিশ্বশর্মা। বিজেপির শীর্ষ স্তরের নির্দেশ না থাকলে হিমন্ত ওই হোটেলে পা-ই রাখতেন না। ফলে শিন্ডের মাথায় বিজেপি-র যে হাত রয়েছে, তা স্পষ্ট। জল্পনা তুঙ্গে, তাহলে কি এবার শিন্ডে ও তাঁর অনুগামীরা গেরুয়া শিবিরের পথেই পা বাড়াচ্ছেন। গুয়াহাটির পাঁচতারা হোটেলে হিমন্ত বিশ্বশর্মার উপস্থিতি একাধিক জল্পনা তৈরি করেছে। এদিকে, শিবসেনা মুখপাত্র সঞ্জয় রাউত দাবি করেছেন, 'একনাথ তাঁদের সঙ্গেই আছেন। শিন্ডে এক জন শিবসৈনিক। সকালেই কথা হয়েছে ওঁর সঙ্গে। মুখ্যমন্ত্রীকে জানিয়েছি।’
শিন্ডেও পাল্টা বৈঠক ডেকেছেন। পদচ্যুত হতেই ট্যুইটে একনাথ শিন্ডে দাবি করেছেন, এখনও তিনি শিবসেনাতেই রয়েছেন। কোনও পরিস্থিতিতেই কিংবা ক্ষমতার লোভে তিনি বালাসাহেব ঠাকরের আদর্শের সঙ্গে বেইমানি করবেন না। পাশাপাশি হুঙ্কার দিয়েছেন, '৪০ নয়, শিবসেনা এবং নির্দল মিলিয়ে ৪৬ জন বিধায়ক রয়েছেন আমার সঙ্গে। আসার কথা আরও ৪ বিধায়কের।'
ওদিকে শরিক কংগ্রেস এবং এনসিপি-ও ময়দানে নেমে পড়েছে। কংগ্রেসের পরিষদীয় দলনেতা বালাসাহেব থোরাটের সঙ্গে দেখা করেছেন সদ্য-নিযুক্ত এআইসিসি পর্যবেক্ষক কমল নাথ। তিনি বলেছেন, 'টাকার খেলায় ঝাড়খণ্ড এবং মধ্যপ্রদেশের মতো মহারাষ্ট্রেও যে ধরনের রাজনীতি শুরু হয়েছে তা ভারতের সংবিধানের পরিপন্থী। এ ধরনের রাজনীতি মাথাচাড়া দিলে গণতন্ত্রের ভবিষ্যতের জন্য বিপজ্জনক নজির স্থাপন করবেই।' কংগ্রেস বলছে, তাদের বিধায়করা ঠিক আছেন। শিবসেনা নিজেদের বিধায়কদের সামলে নিক।
পাশাপাশি, মহারাষ্ট্রের 'আয়রন-ম্যান' তথা এনসিপি প্রধান শরদ পাওয়ারের বাসভবনে মহারাষ্ট্রের স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী দিলীপ ওয়ালসে পাতিল বৈঠক করেন। সেখানে ছিলেন মহারাষ্ট্রের মন্ত্রী বালাসাহেব পাতিলও। সব মিলিয়ে রাজনৈতিক মহল কৌতূহলি, কোন দিকে গড়াবে জল?
অন্যদিকে পরিস্থিতি আরও জটিল করেছেন শিবসেনার সঞ্জয় রাউত। এক ট্যুইটে চরম পরিণতির ইঙ্গিত দিয়েছেন। রাজ্যের বর্তমান রাজনৈতিক সংকটের মধ্যেই মহারাষ্ট্র বিধানসভা ভেঙে দেওয়ার ইঙ্গিত দিয়েছেন রাউত। তিনি ট্যুইটে লিখেছেন, 'মহারাষ্ট্রে হঠাৎ চালু হওয়া রাজনৈতিক সংকট বিধানসভা ভেঙে দেওয়ার দিকে যাচ্ছে।'
কী হতে পারে মহারাষ্ট্রের রাজনৈতিক ভবিষ্যৎ, রাষ্ট্রপতি নির্বাচনের প্রাক্কালে এই প্রশ্নই বড় হয়ে দেখা দিয়েছে।
১) আপাতত যা পরিস্থিতি, তাতে এটা নিশ্চিত, একনাথ শিন্ডেকে শিবসেনা ফিরিয়ে আনতে না পারলে আচমকা ভেন্টিলেশনে যাওয়া মহারাষ্ট্রে সরকারের অকাল-মৃত্যু নিশ্চিত। শোনা যাচ্ছে, শিন্ডে নাকি নতুন শিবসেনা গঠন করে বিজেপির সঙ্গে জোট করবে।
২) শিন্ডের দাবি, শিবসেনা এবং নির্দল মিলিয়ে তাঁর সঙ্গে ৪৬ জন বিধায়ক রয়েছেন। আসার কথা নাকি আরও ৪ বিধায়কের। ওদিকে বিজেপির বিধায়ক সংখ্যা ১১৩, অন্যান্য ৫ জন। ১টি আসন শূন্য। মহারাষ্ট্র বিধানসভায় ম্যাজিক ফিগার ১৪৫। বিজেপি এবং শিন্ডের দাবি অনুসারে আপাতত ৪৬ বিধায়ক থাকলে এবং শিন্ডে বিজেপির পাশে দাঁড়ালে সেই সংখ্যা দাঁড়াবে ১৫৯, যা সরকার গঠনের জন্য যথেষ্ট।
৩) তেমন হলে মহারাষ্ট্রে ফিরবে বিজেপি। তবে পরিস্থিতি সেইদিকে গড়ালে উদ্ধব ঠাকরে বিধানসভা ভেঙে দেওয়ারই সুপারিশ করবেন।
৪) সরকার পড়ে গেলে অথবা মহাজোট ভেঙে গেলে মহারাষ্ট্র বিধানসভার অন্তর্বর্তী নির্বাচন অবশ্যম্ভাবী।
৫) একনাথ শিন্ডে যদি নতুন শিবসেনা গঠন করেন তাহলে নতুন দল নিয়ে তাঁকে ভোটে যেতে হবে। শিন্ডে যত বড় নেতাই হোন, মহারাষ্ট্রে ঠাকরে-দের প্রভাব অনেক বেশি। সেক্ষেত্রে শিন্ডের এককভাবে সরকার গড়ার দাবিদার হওয়ার সম্ভাবনা কম৷ কোনও জোটে তাঁকে যেতেই হবে। শিন্ডের প্রথম পছন্দ নিশ্চিতভাবেই বিজেপি। তবে ২০-২৫ আসন নিয়ে বিজেপি জোটে শিন্ডে কতটা গুরুত্ব পাবেন, সেটাও প্রশ্ন।
৬) কংগ্রেসের ৪৪ জন বিধায়ক ঐক্যবদ্ধ। একজনও বিজেপি বা শিন্ডের সঙ্গে যাবেন না। নির্বাচন হলে শিন্ডের সঙ্গে জোটেও যাবে না কংগ্রেস।
৭) এখন দেখার বিজেপি এনসিপি ভাঙতে পারে কি'না৷ শিবসেনার পর বিজেপি পাওয়ারের দলেও ভাঙ্গন লাগাতে পারলে মহারাষ্ট্রের রাজনীতি অন্য খাতে বইবে৷ একচ্ছত্র ক্ষমতা নিয়ে ফিরবে বিজেপি।
৮) পরিস্থিতির জল যেদিকে গড়াচ্ছে, শিন্ডে এবং তাঁর অনুগামীরা শিবসেনার ঝাঁকে না মিশলে মহারাষ্ট্রে অকাল ভোটই হবে। বিজেপি-শিন্ডে জোটকে কিছুতেই সরকার গড়তে দেবে না শিবসেনা, এনসিপি বা কংগ্রেস। বিজেপির সরকার গঠন আটকানোর একমাত্র পথ, বিধানসভা ভেঙে দেওয়া৷ এই ইঙ্গিত ইতিমধ্যেই দিয়েছেন শিবসেনার সঞ্জয় রাউত।
৯) আর রাজনৈতিক মহলের অভিমত, মহারাষ্ট্রে মধ্যবর্তী নির্বাচন হলে বিজেপি জোট বা 'মহাবিকাশ অঘাড়ি' কেউই সংখ্যাগরিষ্ঠতা পাবে না। ফের শুরু হবে ঘোড়া কেনাবেচা। ফলে আগামী দিনেও মহারাষ্ট্রে শক্তপোক্ত সরকারের আশা বড়ই ক্ষীণ।