এসআইআর: ভোটের আগে 'ব্র‍্যান্ড মমতা'র হাতে চাঁদ?

Mamata Banerjee and the SIR Issue: একদম তৃণমূল স্তরে বার্তা দেওয়ার, সংগঠিত করার সুযোগ পাচ্ছেন মমতা বন্দোপাধ্যায়। একসময় মমতা বন্দোপাধ্যায়ই ছিলেন কেন্দ্রীয় সরকারের বিরুদ্ধে প্রতিবাদী মুখ— 'দিদি মানে প্রতিবাদের প্রতীক।'

বিরোধিতাই তাঁর পরিচয়। তিনি বিদ্রোহিনী, এই তাঁর ব্র‍্যান্ড ইমেজ। শাসকের আসনে বসেও, কাঙ্খিত ফল পেতে তাঁকে বারবার এই ইমেজ সামনে রেখে রাজপথে নামতে হয়েছে। এসআইআর সেই রাজনীতিতেই সাম্প্রতিকতম সংযোজন। বিশ্লেষকরা বলছেন, ভোটের আগে রাজ্যের মুখ্যমন্ত্রী মমতা বন্দ্যোপাধ্যায় তাঁর চেনা জোব্বাটা গায়ে চাপানোর সুযোগ পেলেন নির্বাচন কমিশনের আকস্মিক এসআইআর ঘোষণার কারণেই।

গত ১ নভেম্বর পশ্চিমবঙ্গের রাজ্য নির্বাচন কমিশন এই বিশেষ ভোটার তালিকা সংশোধনের ঘোষণা করে। মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়ের অভিযোগ, এই পুরো কাজটা গোপনে করা হচ্ছে। তিনি বলছেন, এর আসল উদ্দেশ্য হলো বাংলার ভোটার তালিকায় নিজেদের মতো করে বদলে ফেলা। এই নিয়ে নভেম্বরের প্রথম সপ্তাহেই কেন্দ্র ও রাজ্য নির্বাচন কমিশনের বিরুদ্ধে সরব হয়েছেন মুখ্যমন্ত্রী। তৃণমূলের মূল বার্তা এখন খুব স্পষ্ট— দিল্লি চায় বাংলার মানুষকে বঞ্চিত করতে, কিন্তু যে কোনো মূল্যে তা প্রতিহত করা হবে।। এই বক্তব্যের মধ্যেই পুরোনো সেই মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়কে পাওয়া যাচ্ছে— যিনি এক সময় নন্দীগ্রাম সিঙ্গুরে দরিদ্র কৃষকদের ভরসা হয়ে উঠেছিলেন। সেই ছবি বদলে দিয়েছিল নাগরিক মনন। এখন তিনিই কেন্দ্রীয় সরকারের বিরুদ্ধে দাঁড়িয়ে বলছেন, বাংলার অধিকার রক্ষা করো। তৃণমূলের দাবি, কেন্দ্রীয় সংস্থাগুলির মাধ্যমে রাজ্য সরকারের ভাবমূর্তি নষ্ট করার চেষ্টাই চলছে। এই পরিস্থিতিতে এসআইআর হয়ে উঠেছে নতুন এক রাজনৈতিক যুদ্ধক্ষেত্র, ভোটার অধিকার রক্ষাকে সামনে রেখে আসলে চলছে নিজেকে আরও একবার প্রমাণ করার লড়াই।

মমতার দাবি, এসআইআর প্রক্রিয়াটি অত্যন্ত তড়িঘড়ি করে চালানো হচ্ছে। সাধারণত এই ধরনের ভোটার তালিকা সংশোধনের কাজ দু'বছর ধরে চলে। কিন্তু এবার মাত্র কয়েক সপ্তাহের মধ্যেই শেষ করার নির্দেশ দেওয়া হয়েছে। তিনি বলছেন, “এটা পরিকল্পিত ভাবে কিছু নাম বাদ দেওয়ার ফাঁদ।” অন্যদিকে, নির্বাচন কমিশনের পক্ষ থেকে জানানো হয়েছে— এই প্রক্রিয়া স্বচ্ছ ও নিরপেক্ষ। প্রত্যেক ভোটারকেই তথ্য যাচাই করার সময় ও সুযোগ দেওয়া হচ্ছে। বিজেপিও তৃণমূলের অভিযোগ মানতে নারাজ। রাজ্য বিজেপি নেতৃত্বের দাবি, তৃণমূল অযথা আতঙ্ক ছড়াচ্ছে। নির্বাচন কমিশনের কাজ সম্পূর্ণ নিয়মমাফিক হচ্ছে। বিজেপির পক্ষ থেকে বলা হয়েছে, তৃণমূল এই ইস্যু বানিয়ে 'ভয় দেখানোর রাজনীতি' করছে। তারা দাবি করেছে, সব কিছু নিয়মমাফিক চলছে এবং ভোটার তালিকা সংশোধনের প্রতিবারই হয়।

আরও পড়ুন

এসআইআর বিরোধী আন্দোলন কি তৃণমূলকে শক্তি বাড়াতে সাহায্য করবে?

৪ নভেম্বর কলকাতায় মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়ের নেতৃত্বে একটি এসআইআর বিরোধী মিছিল হয়। মিছিলে থেকেই তিনি বলেন, “বাংলার ভোটাধিকার ছিনিয়ে নিতে দেবে না তৃণমূল। ভোটার তালিকা থেকে একজন মানুষের নামও বাদ পড়লে আমি রাস্তায় নামব।” মিছিলের প্রথম সারিতে ছিলেন বিভিন্ন ধর্মগুরুরা—হিন্দু পুরোহিত, মুসলিম ইমাম, শিখ গুরু, খ্রিস্টান ও বৌদ্ধ ধর্মগুরু। এই দৃশ্যের মধ্যেই ছিল একটি বড় রাজনৈতিক বার্তা— বিভেদের রাজনীতি নয়, ঐক্যের ডাক। হাতে সংবিধান নিয়ে হাঁটছিলেন মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়। পাশে ছিলেন তৃণমূলের শীর্ষ নেতারা। এই আনন্দোলনের ছবিটি স্পষ্ট করে দিল এই লড়াইটি স্রেফ  রাজনৈতিক লড়াই হিসেবে তুলে না ধরে সংবিধান এবং অধিকার রক্ষার আন্দোলন মানুষের সামনে রাখতে চাইছেন মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়।

এসআইআর আন্দোলনের মাধ্যমে মমতা বন্দ্যোপাধ্যায় কি অভয়া কাণ্ডে ক্ষতিগ্রস্ত ইমেজ পুবরুদ্ধার করতে চাইছেন? এই প্রসঙ্গে সাংবাদিক  স্নিগ্ধেন্দু ভট্টাচার্য বলেন, “আমার মনে হয় না অভয়া কাণ্ডে তৃণমূল খুব বড় কোনো ধাক্কা খেয়েছিল। শুরুতে কিছুটা চাপ অবশ্যই এসেছিল, কিন্তু পরে তারা পরিস্থিতি সামলে নিতে পেরেছে। অভয়া আন্দোলনের যে দুর্বলতা গুলো ছিল, সেটাও ক্রমে প্রকাশ্যে আসে। ফলে সেই আন্দোলন তেমন বড় ক্ষতি করতে পারেনি।” তিনি আরও বলেন, “তবে গত ২০১১ সাল থেকে শাসন নিয়ে যে এক ধরনের অসন্তোষ তৈরি হয়েছে, আর হিন্দুত্ব নিয়ে যে রাজনীতির চলছে— এসআইআর ইস্যু সেই দু'টোকেই মোকাবিলা করতে তৃণমূলকে অনেকটা সাহায্য করছে।” স্নিগ্ধেন্দু ভট্টাচার্যের মতে, “মমতা বন্দ্যোপাধ্যায় স্বভাবতই রাস্তায় নামতে ভালোবাসেন, তিনি রাস্তার রাজনীতিতে স্বচ্ছন্দ। এসআইআর তাঁকে আবার জনতার রাজনীতিতে নামার, বিরোধী সুর তোলার সুযোগ দিয়েছে। প্রতিরক্ষার জায়গা থেকে এখন তিনি আক্রমণাত্মক ভূমিকা নিতে পারছেন। বিধানসভা নির্বাচন যখন সামনে, তখন রাজ্য সরকারের কাজকর্মের বদলে এখন আলোচনার কেন্দ্রবিন্দু হয়ে উঠেছে এসআইআর। ফলে তৃণমূল কিছুটা হলেও স্বস্তি পেয়েছে— এতে কোনো সন্দেহ নেই।”

সামনে রাজ্যের নির্বাচন। এই মুহূর্তে রাজনীতির সবচেয়ে বড় আলোচ্য বিষয় হয়ে উঠেছে এসআইআর। এই ইস্যুকে ঘিরেই নতুন রাজনৈতিক ন্যারেটিভ গড়ে উঠছে বাংলায়। এই প্রেক্ষাপটে মমতা বন্দ্যোপাধ্যায় এবং অভিষেক বন্দ্যোপাধ্যায় দু’জনেই নিজেদের তুলে ধরছেন প্রতিরোধকারীর ভূমিকায়। গত ১৫ বছর ধরে রাজ্যে তৃণমূল সরকার ক্ষমতায় আছে। এই সময়ের মধ্যে দুর্নীতি, চাকরির কেলেঙ্কারি, আইনশৃঙ্খলা সমস্যা নিয়ে রাজ্যের বিরোধীরা ক্রমাগত আক্রমণ শানিয়েছে। এই পরিস্থিতিতে তৃণমূলের ন্যারেটিভ কী হবে তা নিয়ে সংশয় ছিল রাজনৈতিক মহলে, এখন এসআইআর-কে সাপে বর মনে করছে অনেকেই। বিশ্লেষকদের পর্যবেক্ষণ, মমতার এই অবস্থান নিজের 'ইমেজ রিসেট' করার চেষ্টাও বটে।

আরও পড়ুন

‘ভোট চুরি’ বা এসআইআর! নির্বাচন কমিশনের সেম-সাইড গোল?

দীর্ঘদিন ক্ষমতায় থাকলে ব্র্যান্ড ইমেজ ম্লান হয়, এ কথা অস্বিকার করার উপায় নেই। ঠিক যেমনটা হয়েছিল বুদ্ধদেব ভট্টাচার্যের ক্ষেত্রে। সময় এবং পরিস্থিচি অনুযায়ী অবস্থান নিতে না পারার কারণেই সরে যেতে হয়েছিল তাঁকে। ২০২৬ নির্বাচন মমতা বন্দোপাধ্যায়ের চর্তুর্থ পরীক্ষা। এত দীর্ঘ সময় ক্ষমতার কেন্দ্রে থাকার পর প্রতিষ্ঠান বিরোধীতা যে তৈরি হবে তা বাস্তব ঘটনা। ফলে কিছুটা ভাবমূর্তী ম্লান হয়েছিল মমতারও, আর ঠিক সে সময়ই এসআইআর এর মতো রাজনৈতিক জটিলতা মমতার হাতে ব্র্যান্ড ইমেজ রিসেট 'বাটন'টি যেন তুলে দিয়েছে। একদম তৃণমূল স্তরে বার্তা দেওয়ার, সংগঠিত করার সুযোগ পাচ্ছেন মমতা বন্দোপাধ্যায়। একসময় মমতা বন্দোপাধ্যায়ই ছিলেন কেন্দ্রীয় সরকারের বিরুদ্ধে প্রতিবাদী মুখ— 'দিদি মানে প্রতিবাদের প্রতীক।' এখন এসআইআর ইস্যু নিয়ে মমতা বন্দ্যোপাধ্যায় যেন আবার আগের সেই রূপে ফিরেছেন— জনগণের রক্ষক, আর বাইরের চাপের বিরুদ্ধে বাংলার কণ্ঠস্বর হিসেবে নিজেকে তুলে ধরেছেন।

রাজনৈতিক বিশ্লেষকদের মতে, যেহেতু এই ইস্যুটি একে বারে সরাসরি সাধারণ মানুষের সঙ্গে যুক্ত, তাই তৃণমূল নতুন করে নিজেদের চাঙ্গা করার সুয়োগ পাচ্ছে। নাগরিকের ভোটাধিকার প্রশ্নের মুখে পড়লে স্বাভাবিক ভাবেই সংশয় তৈরি হয়। সেই সংশয় বামেরা এসআইআর নিয়ে যতটা শক্তি প্রয়োগ করছেন তাতে আর যাই হোক ন্যারেটিভ বিল্ডিং হয় না, বরং মমতা বন্দোপাধ্যায় সরাসারি নির্বাচন কমিশন ও কেন্দ্রকে চ্যালেঞ্জ ছুড়ে দিয়ে প্রচারের কেন্দ্রে থাকতে চাইছেন। এভাবে তিনি আবার নিজের 'প্রতিষ্ঠান বিরোধী' ভাবমূর্তি তুলে ধরছেন— যে ভাবমূর্তি তাঁকে একসময় বাংলার সবচেয়ে জনপ্রিয় নেত্রী বানিয়েছিল।

যদিও বিরোধী শিবির থেকে উঠছে একের পর এক প্রশ্ন। তাদের অভিযোগ, তৃণমূল সরকার এতদিন ধরে রাজ্যের প্রশাসন ও নির্বাচনী প্রক্রিয়াকে নিজের নিয়ন্ত্রণে রেখেছে। আর এখন যখন মানুষের মধ্যে অসন্তোষ বাড়ছে, তখন সেই ব্যর্থতা ঢাকতেই মুখ্যমন্ত্রী এই ইস্যুকে সামনে এনে গল্প সাজাচ্ছেন। বিরোধীরা এখন দাবি করছে, রাজ্যে ভোটের স্বচ্ছতা নষ্ট করেছে তৃণমূল নিজেরাই। ভোটের সময় হিংসা, বুথ দখল, ভুয়ো ভোটার— সবই ঘটেছে তৃণমূলের শাসনকালে। তাই এখন ভোটার তালিকার স্বচ্ছতার কথা বলা আসলে ভণ্ডামি ছাড়া কিছু নয়। বিরোধীদের মতে, এসআইআরকে ঘিরে মুখ্যমন্ত্রীর প্রতিবাদ আসলে একটি রাজনৈতিক কৌশল। দুর্নীতি, নিয়োগ কেলেঙ্কারি ও প্রশাসনিক ব্যর্থতা নিয়ে যে ক্ষোভ তৈরি হয়েছে, সেখান থেকে মানুষের মনোযোগ ঘোরাতেই এই আন্দোলনকে সামনে আনা হয়েছে।

More Articles