রাষ্ট্রপতি নির্বাচনের আগে ২০২৪-এর জন্য বিজেপিকে যে বড় চ্যালেঞ্জ ছুড়ে দিলেন মমতা

রাষ্ট্রপতি নির্বাচনে বিরোধী শিবিরের জয়-পরাজয় যাইই হোক, ২০২৪-এর আগেই বিজেপির ঘুম উড়িয়ে দিতে সফল হয়েছে মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়ের দুরন্ত স্ট্র্যাটেজি।

শুধু বাংলায় নয়, এবার জাতীয় স্তরেও বিজেপিকে লড়তে হবে সেই তৃণমূলের সঙ্গেই। এক ঢিলে একাধিক পাখি মেরে তৃণমূল সুপ্রিমো মমতা বন্দ্যোপাধ্যায় গেরুয়া শিবিরকে এই বার্তাই দিতে পেরেছেন।

প্রথমে শত্রুঘ্ন সিনহা, এবার যশবন্ত সিনহা। তৃণমূল কংগ্রেসের গায়ে এতদিন সেঁটে ছিল আঞ্চলিক দলের লেবেল। কিছুদিন আগে আসানসোল লোকসভা কেন্দ্রের উপনির্বাচনে 'বিহারি বাবু' শত্রুঘ্ন সিনহাকে প্রার্থী করে হিন্দি বলয়ে পা রেখেছিল তৃণমূল‌। এবার দেশের রাষ্ট্রপতি নির্বাচনে বিরোধী দলের প্রার্থী হিসেবে তৃণমূল কংগ্রেসের সদ্য-প্রাক্তন সহ-সভাপতি, পূর্বতন বিহার, বর্তমান ঝাড়খণ্ডের যশবন্ত সিনহার নাম প্রস্তাব করে মাস্টারস্ট্রোক দিয়েছিলেন তৃণমূল নেত্রী‌। মমতার প্রস্তাবেই সিলমোহর লাগিয়েছেন বিরোধী নেতারা। ফলে এবার দেশের হিন্দিভাষী এলাকায় তৃণমূলের অবাধ বিচরণের পথ আরও প্রশস্ত হয়ে গেল। হিন্দি বলয়ের সেন্টিমেন্টকে মর্যাদা দিয়ে তৃণমূল এখন প্রকৃত অর্থেই জাতীয় দল। রাষ্ট্রপতি নির্বাচনের ফল যাই-ই হোক, মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়ের এই দূরদর্শিতার প্রভাব ২০২৪-এর লোকসভা নির্বাচনে পড়তে বাধ্য। আর ঠিক সেই কারণেই বিজেপির কপালের ভাঁজের সংখ্যা এক ধাক্কায় অনেকটাই বেড়ে যেতে পারে।

উড়িষ্যার ময়ুরভঞ্জ জেলার বাইদাপোসি গ্রামের দ্রৌপদী মুর্মুকে প্রার্থী করে বিজেপি কৌশলে সম্ভবত টেনে নেবে নবীন পট্টনায়কের বিজেডি-র সমর্থন ৷ উড়িষ্যায় যখন ভারতীয় জনতা পার্টি এবং বিজু জনতা দলের জোট সরকার ছিল, সেসময় দ্রৌপদী মুর্মু মন্ত্রী ছিলেন। হয়তো পাশের রাজ্য ঝাড়খণ্ডে বিজেপি-বিরোধী হেমন্ত সোরেনের ঝাড়খণ্ড মুক্তি মোর্চার আংশিক সমর্থনও হাতিয়ে নিতে পারে বিজেপি তথা এনডিএ। কারণ, ২০১৫ থেকে ২০২১ পর্যন্ত ঝাড়খণ্ডের প্রথম মহিলা রাজ্যপাল ছিলেন দ্রৌপদী মুর্মু। ঝাড়খণ্ডের সরকারের সঙ্গে তাঁর তেমন বিরোধও ছিল না। রাষ্ট্রপতি নির্বাচনের ভোটমূল্যে এখনও পিছিয়ে থাকা বিজেপি হয়তো এই সম্ভাবনার কথা মাথায় রেখেই দ্রৌপদী মুর্মুকে প্রার্থী করে জুয়া খেলতে নেমেছে। রাইসিনা হিলসের দখলদারির দৌড়ে বিজেপি ও তার সহযোগীদের ভোট ৪৮.৯ শতাংশ। সেখানে বিরোধীদের ভোট ৫১.১ শতাংশ। বিরোধীরা এক হলে সমস্যায় পড়তে পারে বিজেপি। তাই সুকৌশলে প্রার্থী বাছাই করেছেন মোদি-শাহ-নাড্ডা। বিরোধী শিবিরের ভোট ম্যানেজ করতে তাই আসরে নামানো হয়েছে দ্রৌপদী মুর্মুকে।

আরও পড়ুন: কে হবেন রাষ্ট্রপতি! বিরোধী ঐক্যের সর্পছিদ্রই বিজেপির পোয়াবারো?

কিন্তু রাষ্ট্রপতি নির্বাচনই তো শেষ নয়। ২০২৪-এর লোকসভা ভোটেও লড়তে হবে বিজেপিকে। দেশের প্রাক্তন অর্থমন্ত্রী যশবন্ত সিনহাকে প্রার্থী করে হিন্দি বলয় তথা গো-বলয়ে মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়ের এভাবে ঢুকে পড়ার মধ্যে তাই সিঁদুরে মেঘ দেখছে গেরুয়া শিবির‍।

বিজেপির বিপদ আরও আছে। আপাতত দু'টি বিপদের কথা উল্লেখ করা যেতে পারে। তৃণমূল সুপ্রিমো মমতা বন্দ্যোপাধ্যায় নিজের দলের সহ-সভাপতির নাম রাষ্ট্রপতি পদপ্রার্থী হিসেবে প্রস্তাব করেছিলেন। দেশের বিজেপি- বিরোধী দলগুলি একবাক্যে তৃণমূল কংগ্রেসের ওই পদাধিকারীকেই প্রার্থী হিসেবে মেনে নিয়েছে। এর ফলে জাতীয় স্তরে এমন এক বার্তা গেছে, যা বিজেপির রক্তচাপ বাড়িয়ে দেওয়ার পক্ষে যথেষ্ট। এটা স্পষ্ট হয়েছে, বিরোধী নেত্রী হিসেবে মমতা বন্দ্যোপাধ্যায় ইতিমধ্যেই নিজেকে গ্রহণযোগ্য করে তুলতে পেরেছেন। তৃণমূল কংগ্রেসের এক জাতীয় স্তরের নেতাকে প্রার্থী হিসেবে সমস্ত বিরোধী রাজনৈতিক দল মেনে নিয়েছে, বিরোধী দলগুলি তাঁকেই ভোট দেবে, বিজেপির বিরুদ্ধে লড়াইয়ে দেশের বিরোধী শিবিরের মুখ তৃণমূল কংগ্রেসের এক নেতা। এইখানেই বিজেপির দুশ্চিন্তা বাড়িয়ে হই হই করে জিতে গিয়েছেন তৃণমূল নেত্রী। মমতা বুঝিয়ে ছেড়েছেন, জাতীয় স্তরেও বিজেপির প্রধান প্রতিপক্ষ তৃণমূলই।

বিজেপির দ্বিতীয় বড় বিপদ, রাষ্ট্রপতি পদে প্রার্থী বাছাই প্রক্রিয়ায় স্পষ্ট ধরা পড়েছে কংগ্রেসের চেয়ারপার্সন সোনিয়া গান্ধী বিরোধী নেত্রীর ভূমিকায় মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়কে কতখানি পছন্দ এবং ভরসা করেন। বিরোধী দলের দু'দফার বৈঠকে একবারও কংগ্রেস নিজেদের প্রার্থীর নাম প্রস্তাব করেনি। অথচ করার সুযোগ ছিল। কিন্তু সোনিয়া গান্ধীর ধারণা হয়েছে, একমাত্র মমতার হাতে নেতৃত্ব থাকলেই বিজেপিকে শক্ত চ্যালেঞ্জের মুখে দাঁড়াতে হবে। ফলে প্রার্থী চূড়ান্ত করার বিষয়ে কংগ্রেস মমতার মতামতকেই গুরুত্ব দিয়েছেন প্রথম থেকে শেষ পর্যন্ত। বিজেপি আশা করেনি কংগ্রেস ও তৃণমূলের মিলমিশ এতখানি মসৃণ হবে। মমতাকে সামনে রেখে বিরোধীদের এই সহমত হওয়া কখনওই সম্ভবপর ছিল না, যদি কংগ্রেস নিজেদের প্রার্থীর নাম প্রস্তাব করে বসত। সেই সুযোগটাই খুঁজছিল বিজেপি। কিন্তু সোনিয়া গান্ধীর পরিণত ভাবনা, বিজেপিকে হতাশ করেছে। মমতাও কৌশলগত কারণে যথাযথ মর্যাদা দিয়েছেন কংগ্রেসকে। এর ফলে গেরুয়া শিবিরের ওই 'কংগ্রেসমুক্ত ভারত' গড়ার স্বপ্নও খানিকটা কষ্টকল্পনাই হয়ে পড়ল।

সব মিলিয়ে এটাই দাঁড়িয়েছে, রাষ্ট্রপতি নির্বাচনে বিরোধী শিবিরের জয়-পরাজয় যাইই হোক, ২০২৪-এর আগেই বিজেপির ঘুম উড়িয়ে দিতে সফল হয়েছে মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়ের দুরন্ত স্ট্র্যাটেজি। আর একই সঙ্গে দেশের বিরোধী শিবির এখনই পেয়ে গেছে বিজেপিকে বধ করার হাতিয়ার, যে অস্ত্রটিকে গেরুয়া শিবির চেনে মমতা বন্দ্যোপাধ্যায় নামে।

 

More Articles