মানিকবাবুর মেঘ আসলে অন্য রকম যৌনতার কথা বলে
Manikbabur Megh Review: যে মেঘকে পাগলের মতো ভালোবাসে সে nephophile। ইংরেজি শব্দটি বাঙালির খুব চেনা নয়।
তাহলে তাঁরা কী করবেন এই ২০২৪-এ? অথবা তাঁরা কী করতেন ২০১৯-এ? যাঁরা ১৯৯৭ সালের ভাড়াই ২০১৯-এ দিতেন কিম্বা ২০২৪-এ দিচ্ছেন তাঁরা কী কী করতে পারেন! নিরুপায় হয়েই দিচ্ছেন জানি, তবু জিজ্ঞাসা! যাঁরা পুরনো অভ্যেসের বশবর্তী তাঁরা কি পুরনো অভ্যেসগুলো বদলে ফেলবেন শেষ অবধি?
এটুকু লিখলে কোনও এক পক্ষ নিতে ইচ্ছে করে।
দুর্মর স্মৃতিবিধুরতায় আক্রান্ত বাঙালিদের মধ্যে একদল, যাঁরা যাপন করেন নতুন জীবন অথচ একদা কখনও দেখেছেন ও কাটিয়েছেন পুরনো জীবন, তাঁরা সেই সব ফেলে আসা পুরনো বস্তুনিষ্ঠ অভ্যেসগুলির থেকে নিরাপদ দূরত্বে, সফল নিরাপদ দূরত্বে, অবস্থান করেও তাদের প্রতি কাতর। চল্লিশের আশেপাশে পঞ্চাশের প্রান্তের নর-নারী সব। অতনু ঘোষ বাঙালির স্মৃতি-বিধুরতাকে নিয়ে একটি ছবি বানিয়েছিলেন, কল্পবিজ্ঞানের খোলসে রোম্যান্টিক কমেডিও বলা যায় সেটিকে – ‘অ্যাবি সেন’ (২০১৫)। ২০১৩-র অ্যাবি সেন চালান হয়ে যাচ্ছেন ১৯৮০-তে। ২০১৩-র কলকাতা স্মরণ করছে না শুধু, কালান্তরে গিয়ে বর্তমানের মানুষ অ্যাবি সেন যাপন করছেন ১৯৮০-র জীবন। সময়ের অতীত যাত্রা – মাঝে মাঝে বাঙালি বিশ্বায়িত ভুবনে হাঁস-ফাঁস করতে করতে যা চায়।
আরও পড়ুন- বাংলা সিনেমায় ‘দলিত’ স্বর! যে অভাব পূরণ করল অর্ণ-অনির্বাণ-সোহিনীর অথৈ
‘অ্যাাবি সেন’ ছবির মতো করে নয়, যেহেতু কলকাতার মধ্যে আছে অনেক কলকাতা সেহেতু এখানে এখনও আরও কেউ কেউ থাকতে পারেন – যাঁরা কোনও ক্রমে পুরনো অভ্যেসে আটকে আছেন। তেমন পারদর্শী নন বলে নতুন অর্থনৈতিক জীবনে মানিয়ে নিতে পারেননি, পুরাতনেই টিকে আছেন কোনও রকমে। নিষ্ঠুর সামাজিক ডারউইনবাদীদের যুক্তি মেনে নিলে বলতে হয় তাঁদের বাঁচার অধিকার নেই – যোগ্যতমদেরই তো উদ্বর্তন হয়। তাঁরা অযোগ্য। পুরনো বাংলা মাধ্যমের জীবনবিজ্ঞান বই শিখিয়েছিল তাঁদের ‘সারভাইভাল অফ দ্য ফিটেস্ট’-এর বাংলা হলো যোগ্যতমের উদ্বর্তন।
যাঁরা পুরনো অভ্যেসে বড় হয়ে উঠেও নতুন পৃথিবীতে যথেষ্ট, আধা, সিকি যোগ্যতম তাঁরা মোটামুটি নিরাপদ, ‘সারভাইভ’ করে যাবেন আর নিরাপত্তার মাত্রা অনুযায়ী তাঁরা স্মৃতিবিধুরতায় বিলাস করবেন। সেই স্মৃতিবিলাসের নানা উপাদান – বস্তু, বাক্য। রাতে শুতে যাওয়ার আগে বালিশের পাশের টর্চ, সন্তোষ টেপরেকর্ডারে কম-দামি ক্যাসেটে বাংলা গান, নেতাজি কি ফিরবেন জাতীয় জিজ্ঞাসা । এই সব ফেলে আসা বস্তু ও বাক্যের স্মৃতি থেকে সফল নিরাপদ দূরে অবস্থান করার সৌজন্যে স্মৃতিতে ডুবে থাকার পারদর্শিতা যাঁদের নেই, যাঁদের ওই ওইখানেই অর্থাৎ ২০১৯, ২০২০, ... ২০২৪-এও যাঁদের আটকে থাকতে হয় ১৯৯৭ সালে, তাঁদের মধ্যে কাউকে নিয়ে একটা গল্প লেখা যাক।
তারপর দু-পক্ষকে দাঁড় করানো যাক মুখোমুখি।
একদল ক্রেতা, অন্য পক্ষে সাদা-কালো ফ্রেমে আটকে থাকা সংকটের মধ্যবর্তী একজন।
১৯৯৭ সালে যে ভাড়া দিতেন সে ভাড়াতেই ২০১৯ সালে মাতৃহারা পুরুষটি অসুস্থ বিছানাশায়ী বাবাকে নিয়ে বাড়িটিতে আছেন। বাড়িটি পুরনো, ফ্ল্যাট-প্রোমোটার কবলিত হয়নি। বাড়িওয়ালাও বৃদ্ধ ও সজ্জন। বাড়ির ছাদে বাগান করেছেন ১৯৯৭-র ভাড়াটের আধাবয়সী বিয়ে-থা না-করা ছেলে। সেই ছাদ-বাগানে যেভাবে গাছগুলিকে পরিচর্যা করেন তিনি সেভাবেই বাবাকেও দেখেন। অফিসের কেরানি। ফাইলের ধুলো, ফাইলের স্তূপ অফিসের টেবিলে। ফাইল চলে না।
এই যে কেউ কেউ টিকে থাকছেন ও থাকতে থাকতে শেষ অবধি উচ্ছিন্ন হওয়ার অসহায় অনিবার্যতার মুখোমুখি হচ্ছেন নিও-লিবারেল অর্থনীতির দুনিয়ায়, তাঁদের নিয়ে বাংলায় নয় নয় করে বেশ কিছু ছবি হয়েছে। হল কাঁপানো ছবি নয় – কম বাজেটের অন্যরকম ছবিই বলা যায় সেগুলিকে। যেমন অর্জুন গৌরিসারিয়া আর মৈনাক বিশ্বাস পরিচালিত ‘স্থানীয় সংবাদ’ (২০০৯), তারপর অনিকেত চট্টোপাধ্যায়ের শঙ্কর মুদি (২০১৯); ইন্দ্রদীপ দাশগুপ্তের ‘কেদারা’ (২০১৯)-কেও বলা চলে একরকম করে। কলকাতা শহরের মধ্যে অসম অর্থনৈতিক বিকাশের মধ্যে টিকে থাকা ও মুছে যাওয়ার ভয় নিয়ে উঁকি-মারা মধ্যবিত্ত নিম্ন-মধ্যবিত্ত পরিসর। সেই পরিসরের মানুষেরা নতুন ব্যবস্থায় নিজেদের বেঁচে থাকার ইচ্ছে-অধিকার-অভ্যেসকে কীভাবে প্রতিষ্ঠা করবেন? আদপেই কি প্রতিষ্ঠা করা সম্ভব!
রাগ হতে পারে তাঁদের – প্রচণ্ড রাগ। সেই রাগকে একরকম করে নবারুণ প্রকাশ করেছিলেন তাঁর ‘ফ্যাৎ-ফ্যাৎ’ ‘সাঁই-সাঁই’-এর বাস্তবিক অবাস্তবতায় অথবা অবাস্তব বাস্তবতায়। সেই রাগের প্রকরণ – নুনু কামানের তীব্রতা, ছবিতে দেখে যাঁরা নিরাপদ দূরত্বে সফলতায় বসে সমমর্মী হবার বাসনায় প্রবল আন্দোলিত তাঁরা উপভোগ করেছিলেন নবারুণের বই থেকে বানানো ছবি ‘কাঙাল মালসাট’(২০১৩)। তার ‘বাজার’ হয়েছিল যেমন বাজার হয় স্মৃতি-বিধুরতার।
অন্যরকম শিল্পের, সাহিত্যের, সিনেমার বাজার সফলতা দোষের কেন হবে! তা হওয়া চাই। নাহলে প্রচলিত জনপ্রিয় ছবির পেছনে পুঁজির একরকম নাচ খানিকটা হলেও অন্য অভিমুখে সঞ্চালিত করা অসম্ভব। বৃহৎ পুঁজির যেমন জীবন আছে, তেমন স্বল্প পুঁজির জীবনও আছে। রাগ ছাড়া টিকে থাকা মানুষগুলির আরেকরকম অনুভব হতে পারে – যোগ্য হতে পারছি না বলে বিষণ্ণতা। সেই বিষণ্ণতা যে রাগ তৈরি করে বাংলা সিনেমায় তারও তো সিস্টেম-বিরোধী প্রকাশের পূর্ব ইতিহাস আছে। সেই মানিকবাবুর ভালো নাম সত্যজিৎ — ‘প্রতিদ্বন্দ্বী’ (১৯৭০) সিনেমার রাগী যুবকটির কথা মনে করুন। সেও তো পুঁজি ও পুঁজির প্রচলিত কবল থেকে মুক্তি পেতে স্বাধীন রাগে চন্দ্রাভিযানকে নয় ভিয়েতনামের যুদ্ধ অধিকতর গুরুত্বপূর্ণ বলে মনে করেছিল। সে কি কমিউনিস্ট এই জিজ্ঞাসায় চিহ্নিত করা হয়েছিল তাকে – শেষ অবধি বেছে নিয়েছিল শহরের বাইরে আরেক রকম চাকরি। বেঁচে থাকার জন্য।
রাগ ছাড়া বিষণ্ণতা যদি কাল্পনিক প্রেম ও যৌনতার জন্ম দেয়! অন্যরকম যৌনতা।
‘মানিকবাবুর মেঘ’ আসলে অন্যরকম যৌনতার ছবি।
মেঘের সঙ্গে প্রেম। বাঙালি দর্শক সেটা খুব বলছে না, ভাবছে না। বিধুরতার, স্মৃতিকাতরতার নিরাপদ ফ্রেমে আটকে থাকতে চাইছে।
পোস্টারে নতুন অর্থনীতি কত কিছু ঘোষণা করে – পশুর মতো মানুষকে সওয়ার হতে বলে দু-চাকার প্রবলগতি যানে। লাস্যময়ী পোস্টার দেখে বেচারা মানিকবাবু ট্রামের সেকেন্ড ক্লাসে মুখে লজেন্সমার্কা হজমি ফেলে দেন। তারপর যখন মা-মরা ছেলের বাবা মরে গেল তখন তার মেঘের সঙ্গে অ্যাফেয়ার হল। মানিকবাবু nephophile। যে মেঘকে পাগলের মতো ভালোবাসে সে nephophile। ইংরেজি শব্দটি বাঙালির খুব চেনা নয়।
আবারও বলা যায়, আম বাঙালি দর্শক যদি বাঙালি জীবনের ফেলে আসা বস্তুর বিধুরতায় আটকে না থাকতেন তাহলে ছবির এই ‘মেঘলামি’ তাঁদের আলোচনায় আসত। হয়তো এই ভাবে, এই ভাষায়। “পাগল নাকি! মেঘটাকে মেয়ে ভাবছে। তাকে দেখিয়ে ময়দানে কোট পরে শুয়ে আছে। মেঘ ভাঙা বৃষ্টির জল বালতিতে ধরে সেই জলে ল্যাংটো হয়ে চান করছে। শালা বিকৃতি মাইরি! তারপর ঘুড়ি ওড়াচ্ছে মেঘ লক্ষ্য করে। রাধা-কৃষ্ণের ক্যালেন্ডার দেওয়াল থেকে নামিয়ে ঘুড়িটা মেঘ ছুঁয়েছে ভেবে তাকে দেওয়ালে টাঙিয়ে দিল দেখলি! হি হি! খিক খিক খিক!”
ইন্টালেকচুয়াল বাঙালি বলত, “ ‘আরণ্যক’ আর ‘পুতুল নাচের ইতিকথা’, সঙ্গে রবীন্দ্রনাথের পাঞ্চ। বিভূতিভূষণের আরণ্যকের যুগলপ্রসাদ যেভাবে গাছ লাগিয়ে পৃথিবীতে অরণ্যের সঞ্চার ঘটাতে চাইত এও তেমন। মেঘযৌনতার মূলে এই গাছ-গাছ-গাছ খেলা। গাছ ছাড়া পৃথিবীতে বৃষ্টিসম্ভব গর্ভবতী মেঘ কেমন করে হবে! আর সেই মেঘরমণীর সঙ্গে কল্পিত প্রণয়ের সময় বজ্রাঘাত। মানিক বন্দ্যোপাধ্যায়ের ‘পুতুল নাচের ইতিকথা’ মনে পড়বেই। ‘খালের ধারে প্রকাণ্ড বটগাছের গুড়িতে ঠেস দিয়া হারু ঘোষ দাঁড়াইয়া ছিল। আকাশের দেবতা সেইখানে তাহার দিকে চাহিয়া কটাক্ষ করিলেন।’ মানিক বন্দ্যোপাধ্যায়ের বাক্যটি একটু ঘুরিয়ে দেওয়া যাক, ‘ছাদের উপর গর্জমান মেঘের দিকে মুখ তুলিতেই মেঘরমণী তাহার দিকে চাহিয়া কটাক্ষ করিলেন।’ ‘পুতুল নাচের ইতিকথা’ সঙ্গে মিলটা আপতিক, বেমিলটাই মুখ্য। নিয়তির কটাক্ষে হারু ঘোষের বজ্রাঘাতের সঙ্গে তুলনীয় নয় এই যে মৃত্যু, একে বলা চলে মৃত্যুকে আলিঙ্গন – ‘মরণ রে তুঁহু মম শ্যাম সমান’। রাধাকৃষ্ণের বদলে ঘরের দেওয়ালে ঠাঁই নিয়েছিল মেঘগামী ঘুড়ি। বজ্রাঘাতে মৃত্যুর বদলে একে বরং তাই বলা চলে ঝড়ের রাতের অভিসার, শ্যাম সমান মৃত্যুর আলিঙ্গনে ঢলে পড়া – শ্যাম সমান নয় ‘রাধা সমান’ ‘মেঘ সমান’ মৃত্যু।
আরও পড়ুন- সত্যিই কি ওপেনহাইমার শতাব্দীর সেরা সিনেমা? নাকি…
এই যৌনতার আখ্যান, প্রেমের আখ্যান – মানিকবাবুদের তাতে অধিকার থাক। অধিকার না-দিলেও তাঁরা অধিকার খুঁজে নেবেন। তেমনই অধিকার খুঁজে নেবে মানিকবাবুদের আখ্যান। আছে – কলকাতার ভেতরে আছে মানিকবাবু ও মানিকবাবুর মেঘ, মেঘ মুলুকে যাওয়ার আগে ‘আবোল তাবোল’-এর শতবর্ষে বলি যা মোর চিত্তে জাগে ও লাগে। ‘আবোল তাবোল’ যেমন ছোটোদের বইয়ের খোলসে বড়দের বই তেমনই এ-ছবি স্মৃতি বিধুরতার খোলসে আত্মঘাতী প্রশান্ত যৌনতার ছবি। নিও লিবারেল অর্থনীতি যখন বাঁচতেই দেবে না তখন প্রেম করেই মরে যাব। অ্যালেন গিন্সবার্গের ‘হাউল’-এর মতো বলব না,
“I saw the best minds of my generation destroyed by madness, starving hysterical naked,
dragging themselves through the negro streets at dawn looking for an angry fix,
angelheaded hipsters burning for the ancient heavenly connection to the starry dynamo in the machinery of night,”
এই আত্মহননের ভাষা আরেক রকম।
এই প্রশান্ত আত্মঘাতী যৌনতার ছবিটির ‘সাউন্ড ডিজাইন’ কানে লেগে থাকার মতো। তবে এখনকার অধিকাংশ ছবির মতো সংলাপ মুখরতা নেই বলে সত্যজিতের সঙ্গে তুলনায় না-যাওয়াই ভালো – ক্যামেরার পেছনে সত্যজিতের চোখ ও সত্যজিতের ছবির ক্যামেরার প্রসঙ্গ নাই বা তোলা হলো।
কী দরকার!