মাচাদো: শান্তির মুখোশে সাম্রাজ্যবাদী ছায়া পুতুল

Maria Corina Machado: মারিয়া কোরিনা মাচাদোর অর্থনৈতিক নীতি ও পরিকল্পনা কেবল ভেনেজুয়েলার রাজনীতিক ব্যবস্থার পরিবর্তন নয়, বরং লাতিন আমেরিকার ঐতিহাসিক অর্থনৈতিক নিওলিবারেল মডেলের পুনরাবৃত্তি।

আবার একবার 'নোবেল শান্তি পুরস্কার'-এর রাজনৈতিক উদ্দেশ্য বিশ্ব দরবারে উন্মুক্ত। লাতিন আমেরিকার দেশ ভেনেজুয়েলার দক্ষিণপন্থী বিরোধী নেত্রী মারিয়া কোরিনা মাচাদো-কে ১২৫তম নোবেল শান্তি পুরস্কার দেওয়া হলো। নরওয়েজিয়ান নোবেল কমিটি মাচাদো-কে পুরস্কার দেওয়ার কারণ হিসেবে বলেছে, তিনি গত কয়েকবছর ধরে ভেনেজুয়েলায় গণতান্ত্রিক অধিকার, বিচার বিভাগের স্বাধীনতা, এবং মুক্ত নির্বাচন প্রতিষ্ঠার জন্য কাজ করছেন, এমনকি ভয়-হামলা ও হয়রানি সত্ত্বেও। ২০২৪ সালে সেদেশে নির্বাচনের সময় ভোট পর্যবেক্ষণ কর্মসূচি গড়ে তোলার মতো শান্তিপূর্ণ ও নাগরিক উদ্যোগগুলোর মাধ্যমে মাচাদো এবং তাঁর অনুগামীরা নির্বাচনকে স্বচ্ছ করার চেষ্টা করেছেন। “বুলেট নয়, ভোট” এই নীতি মাচাদো সবসময় সামনে রেখেছেন— অর্থাৎ হিংসার পরিবর্তে নির্বাচন ও নাগরিক অংশগ্রহণই তিনি শান্তিপূর্ণ পরিবর্তনের রাস্তা মনে করেন।

কেমন গণতান্ত্রিক মারিয়া কোরিনা মাচাদো?
চলতি শতকের গোড়াতে প্রত্যক্ষ রাজনীতিতে প্রবেশের মুহূর্তে তিনি স্বাক্ষর করেছিলেন কুখ্যাত ‘কারমোনা ডিক্রি’-তে, যে ডিক্রি রাতারাতি সংবিধান বাতিল করে, পার্লামেন্ট ও আদালত ভেঙে দেয়, এবং গণতান্ত্রিক প্রতিষ্ঠানগুলোকে বিলুপ্ত ঘোষণা করে। “কারমোনা ডিক্রি" ছিল ২০০২ সালের ভেনেজুয়েলার ব্যর্থ অভ্যুত্থান চলাকালে ব্যবসায়ী পেদ্রো কারমোনা কর্তৃক জারি করা এক ঘোষণাপত্র, যা সামরিক সমর্থনে প্রেসিডেন্ট হুগো শাভেজকে অপসারণের পর প্রকাশিত হয়। এতে সংবিধান বাতিল, জাতীয় সংসদ ও আদালত বিলুপ্ত, এবং সব রাষ্ট্রীয় ক্ষমতা কারমোনার হাতে ন্যস্ত করা হয়েছিল। এটি ছিল ভেনেজুয়েলার গণতন্ত্র ধ্বংসের এক কুখ্যাত দলিল, যার মাধ্যমে জনগণের ভোটে নির্বাচিত সরকারের বৈধতা ধ্বংস করে এক স্বঘোষিত শাসন প্রতিষ্ঠার চেষ্টা হয়েছিল, যার পেছনে মাচাদোর সক্রিয় ভূমিকা অস্বীকার করার উপায় নেই। তিনি আসলে শান্তির প্রতীক নন, বরং লাতিন আমেরিকায় অস্থিরতা, হস্তক্ষেপ ও সাম্রাজ্যবাদের দীর্ঘ ইতিহাসের এক ধারাবাহিক চরিত্র। হুগো শাভেজ ও নিকোলাস মাদুরোর বামপন্থী সরকারের পতন ঘটাতে তিনি বহু বছর ধরে ওয়াশিংটনের সঙ্গে হাত মিলিয়ে নানা পদক্ষেপ করে চলছেন। বিদেশি গণমাধ্যমে নিজের প্ল্যাটফর্ম ব্যবহার করে তিনি দাবি করেছিলেন “ভেনেজুয়েলাকে মুক্ত করতে” বিদেশি সামরিক হস্তক্ষেপ প্রয়োজন। ট্রাম্প প্রশাসনের আমলে যখন হোয়াইট হাউস “শাসন পরিবর্তন” নীতি প্রকাশ করে, মাচাদো ছিলেন সেই নীতির প্রধান মুখপাত্র। ট্রাম্প যখন ক্যারিবিয়ান সাগরে যুদ্ধজাহাজ পাঠালেন, অর্থনৈতিক অবরোধ জারি করলেন, এবং ভেনেজুয়েলার সম্পদ জব্দ করলেন— তখন মাচাদো প্রকাশ্যে সেই পদক্ষেপকে স্বাগত জানালেন। তিনি ঘোষণা করেছিলেন, যুক্তরাষ্ট্রের যেকোনো “মুক্তি অভিযানে” তিনি থাকবেন ভেনেজুয়েলার প্রতিনিধি হিসেবে। অর্থাৎ, নিজের দেশের সার্বভৌমত্বকে তিনি “উপহার” হিসেবে সপেঁ দিতে প্রস্তুত ছিলেন।

আরও পড়ুন- ট্রাম্প-পুতিন-আম্বানি, ত্রয়ীর মধ্যে মিলটা কোথায়?

মারিয়া কোরিনা মাচাদো যে নীতি ও কর্মকাণ্ডে লিপ্ত ছিলেন তা ভেনেজুয়েলার রাজনৈতিক, অর্থনৈতিক ও সামাজিক সংকটের সঙ্গে সরাসরি সম্পর্কিত। তিনি শুধু একজন বিরোধী নেতা নন, বরং ওয়াশিংটনের কৌশলগত লক্ষ্য বাস্তবায়নে সক্রিয় ভাবে অংশ নিয়েছিলেন। ২০১৭ সাল থেকে যুক্তরাষ্ট্র ভেনেজুয়েলার সরকারকে লক্ষ্য করে নানা অর্থনৈতিক নিষেধাজ্ঞা আরোপ শুরু করেছিল। এতে সরকারের ব্যাংক অ্যাকাউন্ট জব্দ, তেল ও আর্থিক লেনদেনের উপর বিধিনিষেধ, এবং বিদেশে ভেনেজুয়েলার সম্পদের উপর নিয়ন্ত্রণ জোরদার করা হয়। মাচাদো এই নিষেধাজ্ঞার পক্ষে লড়েছিলেন, জানতেন যে এর সরাসরি প্রভাব পড়বে সাধারণ মানুষ— গরিব, শ্রমজীবী জনগণের উপর। কিন্তু তিনি এই দুঃখ ও সংকটকে রাজনৈতিক অস্ত্র হিসেবে ব্যবহার করেছেন। দেশের জনগণের দৈনন্দিন ভোগান্তি, খাদ্য ও ওষুধের অভাবকে আন্তর্জাতিক প্রচারণায় তুলে ধরে সরকারকে অক্ষম এবং জনগণকে “উদ্ধারের জন্য” বিদেশি হস্তক্ষেপের প্রয়োজনীয়তা দেখানোর কৌশল অনুসরণ করেছিলেন।

২০১৯ সালে ওয়াশিংটনের সমর্থনে হুয়ান গুয়াইদো নিজেকে “অন্তর্বর্তী প্রেসিডেন্ট” ঘোষণা করেন। মাচাদো এই পরিকল্পনায় সক্রিয়ভাবে যুক্ত ছিলেন। এ সরকার মূলত মার্কিন নীতি ও পরিকল্পনার একটি পুতুলনাট্য, যার হাতে বাস্তব ক্ষমতা ছিল না। কিন্তু আন্তর্জাতিকভাবে, বিশেষ করে যুক্তরাষ্ট্র ও তার মিত্রদের কাছে এটি বৈধতা পেয়েছিল। গুয়াইদো ও তার দল বিদেশে ভেনেজুয়েলার অর্থনৈতিক সম্পদ লুট করছিল— যেমন ব্যাংক অ্যাকাউন্ট, তেল রফতানির আয়, কর্পোরেট বিনিয়োগ— তবে দেশজুড়ে সাধারণ মানুষ, বিশেষত শিশুরা, ক্ষুধা ও রোগে ভুগছিল। মাচাদোর উপস্থিতি এবং সমর্থন এই পুতুল সরকারের “নৈতিক ভিত্তি” তৈরিতে সাহায্য করেছিল। মাচাদো জানতেন, মানুষের দৈনন্দিন ভোগান্তি আন্তর্জাতিক মনোযোগ আকর্ষণ করে এবং সরকারের বিরুদ্ধে চাপ সৃষ্টি করে। তাই তিনি সেই সংকটকে রাজনৈতিক মাধ্যম হিসেবে ব্যবহার করেছেন। সাধারণ মানুষের দুর্ভোগকে হুমকি হিসেবে তুলে ধরার মাধ্যমে তিনি আন্তর্জাতিক হস্তক্ষেপের প্রয়োজনীয়তা প্রমাণের চেষ্টা করেছেন, যা অনেকের দৃষ্টিতে একটি “মানবিক অঙ্গীকারের আড়ালে রাজনৈতিক ও অর্থনৈতিক দখলের” কৌশল ছিল।

মারিয়া কোরিনা মাচাদোর বিদেশনীতি সম্পূর্ণরূপে প্রতিক্রিয়াশীল এবং সরাসরি ওয়াশিংটনের স্বার্থের সঙ্গে জড়িত। মাচাদো ঘোষণা করেছিলেন যে ক্ষমতায় এলে ভেনেজুয়েলার দূতাবাস পুনরায় জেরুজালেমে খোলা হবে। এটি নিছক এক কূটনৈতিক পদক্ষেপ নয়; বরং এটি ইজরায়েল ও প্যালেস্টাইনের সংঘাতের প্রেক্ষাপটে সরাসরি রাজনৈতিক অবস্থান। জেরুজালেম বর্তমানে ইজরায়েলের নিয়ন্ত্রণাধীন, যেখানে অধিকাংশ ফিলিস্তিনি জনগণ বসবাস করে, এবং আন্তর্জাতিকভাবে এই শহরকে কেন্দ্র করে রাজনৈতিক ও মানবিক সংবেদনশীলতা অত্যন্ত উঁচু। দূতাবাস স্থাপন করা মানে ইজরায়েলের দখলকে বৈধতা দেওয়া এবং ফিলিস্তিনি জনগণের মানবাধিকার লঙ্ঘনের সঙ্গে সরাসরি সমর্থন প্রকাশ করা। মাচাদো স্পষ্টভাবে ইসরায়েলের বিরুদ্ধে আন্তর্জাতিক সমালোচনা উপেক্ষা করেছেন। প্যালেস্টাইনে হাসপাতাল ধ্বংস, শিশুদের হত্যা, স্কুল ও বাড়ি ধ্বংস— এসব ঘটনায় ইজরায়েল সবসময় ‘আত্মরক্ষা’ বলে দাবি করে। মাচাদো এই রাষ্ট্রের সঙ্গে সম্পর্ক জোরদার করার প্রতিশ্রুতি দিয়েছেন, যা বোঝায় যে তিনি এমন সামরিক আগ্রাসন ও মানবিক লঙ্ঘনকে রাজনৈতিক ও কূটনৈতিক সমর্থন দেবেন। এটি ভেনেজুয়েলার বিদেশনীতিকে একেবারে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র এবং ইজরায়েলের স্বার্থের প্রতি আনুগত্যপূর্ণ করে তোলে। এমন অবস্থান গ্রহণের মাধ্যমে মাচাদো ভেনেজুয়েলার স্বাধীন কূটনীতিকে উপেক্ষা করছেন। মধ্যপ্রাচ্যের সংবেদনশীল পরিস্থিতিতে জেরুজালেমকে স্বীকৃতি দেওয়া এবং ইজরায়েলের কর্মকাণ্ডকে সমর্থন করা লাতিন আমেরিকার অন্যান্য দেশগুলোর সঙ্গে দ্বন্দ্ব সৃষ্টি করতে পারে। পাশাপাশি, এটি ভেনেজুয়েলার মুসলিম ও আরব জনগোষ্ঠীর মধ্যে তীব্র অসন্তোষের জন্ম দিতে পারে। মাচাদোর এই নীতির একটি উদ্দেশ্য হল যুক্তরাষ্ট্র এবং পশ্চিমা দেশগুলোর সমর্থন ও স্বীকৃতি অর্জন করা। ইজরায়েল-যুক্তরাষ্ট্র জোটের প্রতি আনুগত্য প্রকাশ করে তিনি নিজের অবস্থানকে “আন্তর্জাতিক নিরাপত্তা ও নীতি সমর্থক” হিসেবে উপস্থাপন করছেন। এটি প্রমাণ করে যে তাঁর বিদেশনীতি জাতীয় স্বার্থের পরিবর্তে আন্তর্জাতিক শক্তির আগ্রাসী ও প্রতিক্রিয়াশীল কৌশলের সাথে মিলিত। চূড়ান্তভাবে বলা যায়, মাচাদোর এই বিদেশনীতি একধরনের প্রতিক্রিয়াশীল, প্রভাবশালী দেশনির্ভর কূটনীতি, যেখানে মানবাধিকারের প্রশ্ন, আঞ্চলিক সংবেদনশীলতা, এবং সাধারণ মানুষের নিরাপত্তা তুচ্ছ। তিনি রাষ্ট্রীয় স্বার্থকে ছাড় দিয়ে এমন নীতিতে জড়িত হয়েছেন যা আন্তর্জাতিক হুমকি ও বৈষম্যের স্বীকৃতি দেয়। ফলে তার নীতির বাস্তব প্রভাব হতে পারে ভেনেজুয়েলার কূটনীতি আরও পরনির্ভরশীল হওয়া, আঞ্চলিক সম্পর্কের জটিলতা বৃদ্ধি, এবং আন্তর্জাতিকভাবে মানবিক দায়বদ্ধতা হ্রাস।

আরও পড়ুন- প্যালেস্টাইনের স্বীকৃতি ও ট্রাম্পের শান্তি পরিকল্পনা: আদতে রাজনৈতিক প্রহসন?

মারিয়া কোরিনা মাচাদোর অর্থনৈতিক নীতি ও পরিকল্পনা কেবল ভেনেজুয়েলার রাজনীতিক ব্যবস্থার পরিবর্তন নয়, বরং লাতিন আমেরিকার ঐতিহাসিক অর্থনৈতিক নিওলিবারেল মডেলের পুনরাবৃত্তি। ১৯৯০-এর দশকে লাতিন আমেরিকার বহু দেশে বিশ্বব্যাংক, আন্তর্জাতিক মুদ্রা তহবিল এবং মার্কিন কর্পোরেট নীতির প্রভাবে বেসরকারিকরণ, খোলা বাজার এবং সরকারি ব্যয় হ্রাসের নীতি চালু হয়েছিল। সেই নীতি আঞ্চলিক অর্থনীতিকে “উন্মুক্ত” করেছিল, কিন্তু তার ফলাফল ছিল বিপরীতমুখী। ব্যাপক বেকারত্ব, খাদ্য ও ওষুধের দাম বৃদ্ধি, স্বাস্থ্য ও শিক্ষাব্যবস্থা ধ্বংসপ্রায়, সামাজিক বৈষম্য বাড়া, এবং জনগণের উপর সম্পূর্ণ ভোগান্তি চাপানো। লাতিন আমেরিকানরা ভালো ভাবে জানে যে এই “মুক্ত বাজারের নীতি” গরিব ও মধ্যবিত্তের উপর কী ভয়ঙ্কর প্রভাব ফেলে। মাচাদো বিভিন্ন ভাষণে প্রতিশ্রুতি দিয়েছেন যে, নিকোলাস মাদুরো সরকারের পতনের পর ভেনেজুয়েলার তেল, জল, খনিজ সম্পদ এবং অবকাঠামো সরাসরি বেসরকারি কর্পোরেশনগুলোর হাতে তুলে দেওয়া হবে। অর্থাৎ, রাষ্ট্রীয় মালিকানাধীন গুরুত্বপূর্ণ সম্পদগুলো বিদেশি বা স্থানীয় বৃহৎ কর্পোরেশনের নিয়ন্ত্রণে চলে যাবে। এটি অর্থনৈতিক স্বাধীনতার বড় একটি ক্ষতি, কারণ জাতীয় সম্পদ জনগণের কল্যাণে ব্যবহারের পরিবর্তে মুনাফার জন্য নিয়ন্ত্রিত হবে।

এই ধরণের নীতি সাধারণ মানুষের জন্য সরাসরি ভোগান্তির কারণ হবে। চাকরি নিশ্চয়তা কমে যাবে, বেসরকারিকরণের কারণে মূল্যবৃদ্ধি হবে এবং স্বাস্থ্য ও শিক্ষা ব্যবস্থায় বৈষম্য বাড়বে। ভেনেজুয়েলার জনগণ নতুন করে লাতিন আমেরিকার নিওলিবারেল অভিজ্ঞতা দেখবে— যেখানে অর্থনীতি উন্মুক্ত হলেও তার ফলপ্রসূ সুবিধা শুধুমাত্র ব্যবসায়ী ও কর্পোরেট প্রতিষ্ঠানগুলোর কাছে সীমাবদ্ধ থাকে, আর সাধারণ মানুষ দারিদ্র্য ও অনিশ্চয়তার মধ্যে পড়ে। এই পরিকল্পনা শুধু অর্থনৈতিক বিষয় নয়, এটি রাজনৈতিক শক্তি পুনর্বিন্যাসের একটি অংশ। রাষ্ট্রীয় সম্পদ বেসরকারি কর্পোরেশনের হাতে তুলে দেওয়া মানে সরকারের ক্ষমতা সীমিত করা, জনগণের উপর রাষ্ট্রীয় নিয়ন্ত্রণ কমানো, এবং বিদেশি কর্পোরেশনের স্বার্থকে মূল ভিত্তি বানানো। মাচাদো এবং তাঁর সমর্থকরা এটিকে “উন্নয়ন ও পুনর্গঠন” বলে উপস্থাপন করেন, কিন্তু বাস্তবে এটি ভেনেজুয়েলার জনগণের জন্য নতুন নিওলিবারেল নিপীড়নের সূত্রপাত। এটি গরিব এবং শ্রমজীবী জনগণকে আরও দুর্বল করবে, বৈষম্য বাড়াবে এবং সামাজিক অচলাবস্থা তৈরি করবে। সুতরাং, তার প্রতিশ্রুতি এবং নীতিগত পরিকল্পনা শুধুমাত্র ভেনেজুয়েলার অর্থনৈতিক সংস্কার নয়, বরং একটি পুঁজিবাদী ও বেসরকারিকৃত সমাজ গঠনের প্রস্তাব, যা লাতিন আমেরিকার নিওলিবারেল অভিজ্ঞতার সঙ্গে অভিন্ন।

২০১৪ সালে মাচাদো ছিলেন “লা সালিদা” আন্দোলনের অন্যতম সংগঠক। "লা সালিদা" আন্দোলন, যা ভেনেজুয়েলায় সংঘটিত হয়েছিল, তা কেবল একটি 'শান্তিপূর্ণ প্রতিবাদ' ছিল না। এটি ছিল প্রেসিডেন্ট নিকোলাস মাদুরোর নির্বাচিত সরকারকে ক্ষমতাচ্যুত করার লক্ষ্যে পরিচালিত একটি সুসংগঠিত সহিংস অভিযান, যা 'গুয়ারিম্বা' কৌশল নামে পরিচিত। গুয়ারিম্বা কৌশল অনুসারে, বিক্ষোভকারীরা গুরুত্বপূর্ণ রাস্তাগুলো দীর্ঘস্থায়ীভাবে অবরোধ করত এবং এই অবরোধকে কার্যকর রাখতে চরম সহিংসতা ব্যবহার করত। এর মূল উদ্দেশ্য ছিল দেশের স্বাভাবিক জীবনযাত্রা সম্পূর্ণরূপে স্তব্ধ করে দিয়ে একটি রাজনৈতিক অচলাবস্থা তৈরি করা। আন্দোলনকারীরা আবর্জনা এবং টায়ার ব্যবহার করে 'ফায়ার ব্যারিকেড' তৈরি করত, যা সাধারণ মানুষের চলাচল সম্পূর্ণভাবে বন্ধ করে দিত এবং কর্মজীবী মানুষের জীবন বিপন্ন করত। এই আন্দোলনে সহিংসতা শুধু সড়ক অবরোধে সীমাবদ্ধ ছিল না। আন্দোলনকারীরা সরাসরি আক্রমণাত্মক হয়ে উঠেছিল। অবরোধের প্রতিবাদকারী বা সরকারের সমর্থক সন্দেহে অনেক সাধারণ নাগরিক এবং শ্রমজীবী মানুষ আক্রান্ত হন। বাইক চালক এবং সরকারি কর্মীদের পুড়িয়ে মারার বা মারাত্মক ভাবে জখম করার অভিযোগও উঠেছিল। এই 'প্রতিরোধের' নামে হাসপাতাল ও অ্যাম্বুলেন্সে হামলা চালানো হয়েছিল, যা স্বাস্থ্যসেবাকে পুরোপুরি অচল করে দেয়। বিশেষভাবে উল্লেখ্য, কিউবান চিকিৎসকরা, যারা ভেনেজুয়েলার দরিদ্র অঞ্চলে স্বাস্থ্যসেবা প্রদান করতেন, তাদের চিকিৎসা কেন্দ্রগুলিতে অগ্নিসংযোগ এবং তাদের উপর হামলার চেষ্টা করা হয়েছিল। খাদ্য ও নিত্যপ্রয়োজনীয় সামগ্রী বহনকারী ট্রাকগুলো ধ্বংস করা হয়, যা দেশের বিভিন্ন অংশে ওষুধ ও খাদ্যের চরম সংকট তৈরি করেছিল। এই সহিংস কার্যক্রমে প্রায় ৪৩ জনেরও বেশি মানুষ নিহত হয়েছিল। সেই সময়ে মারিয়া কোরিনা মাচাদো এই চরম সহিংসতাকে টেলিভিশনে প্রকাশ্যে সমর্থন করে এটিকে "মুক্তির সংগ্রাম" বলে আখ্যা দিয়েছিলেন, যা স্পষ্ট করে যে এই আন্দোলনের লক্ষ্য ছিল গণতান্ত্রিক প্রক্রিয়ার মাধ্যমে পরিবর্তন নয়, বরং সহিংস উপায়ে ক্ষমতা দখল করা। এই আন্দোলন দেশের অর্থনীতিতে চরম স্থবিরতা এনেছিল এবং ভেনেজুয়েলার রাজনীতিতে এক গভীর বিভেদ তৈরি করে, যেখানে মাচাদোর ভূমিকা ছিল সরকারকে উৎখাত করতে চরমপন্থী সহিংসতাকে উস্কে দেওয়া। সেই মাচাদো নোবেল শান্তি পুরস্কার পেয়েছেন।

আরও পড়ুন- ১৯৪৮ থেকে ২০২৫ : কীভাবে গড়ে উঠল ইজরায়েল-আমেরিকার অটুট সম্পর্ক

ডোনাল্ড ট্রাম্প যখন “আমেরিকা ফার্স্ট” নীতিকে সামনে রেখে একদিকে অভিবাসীদের প্রতি নিষ্ঠুরতা দেখিয়েছেন— শিশুদের খাঁচায় বন্দি করা, পরিবার বিচ্ছিন্ন করা, মধ্য আমেরিকার শরণার্থীদের ‘অপরাধী’ আখ্যা দেওয়া— অন্যদিকে তিনি লাতিন আমেরিকার দেশগুলোতে “স্বৈরাচারবিরোধী অভিযান” চালানোর নামে সামরিক প্রস্তুতি নিয়েছিলেন। ভেনেজুয়েলাকে তিনি ঘোষণা করেছিলেন “একটি মাদকচক্রের রাষ্ট্র”, এবং ২০২০ সালে মার্কিন নৌবাহিনী ক্যারিবিয়ান সাগরে যুদ্ধজাহাজ পাঠিয়েছিল “অ্যান্টি-নার্কোটিকস মিশন”-এর নামে। সেই সময় মাচাদো প্রকাশ্যে ট্রাম্পের পদক্ষেপকে “সাহসী” ও “সিদ্ধান্তমূলক” বলে প্রশংসা করেছিলেন। তিনি বলেছিলেন, “মাদুরো শাসন যে অপরাধী, তা বিশ্বকে বোঝাতে ট্রাম্প সঠিক পথে এগোচ্ছেন।”মাচাদো বলেছিলেন,মাদুরো শাসনের বিরুদ্ধে মার্কিন সামরিক চাপকে “প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা” হিসেবে সমর্থন করছি, যা ভেনেজুয়েলার জনগণের সার্বভৌমত্ব পুনরুদ্ধার করার পথে একটি পদক্ষেপ। এই প্রশংসা নিছক রাজনৈতিক সৌজন্য নয়— এটি ছিল স্পষ্ট সমর্থন মার্কিন সামরিক ও অর্থনৈতিক হস্তক্ষেপের প্রতি। মাচাদো বুঝতেন যে, এই হস্তক্ষেপের অর্থ ভেনেজুয়েলার উপর আরও নিষেধাজ্ঞা, খাদ্য ও ওষুধ সংকট, এবং গরিব মানুষের জন্য দুর্ভোগ। তবুও তিনি সেগুলোকে “স্বাধীনতার মূল্য” বলে আখ্যা দিয়েছিলেন। এই অবস্থান থেকেই বোঝা যায়, তিনি যে “গণতন্ত্র” ও “স্বাধীনতা”র কথা বলেন, তা আসলে বিদেশি শক্তির কর্তৃত্বে পরিচালিত এক নতুন নির্ভরশীলতার পরিকল্পনা।

অন্যদিকে, ট্রাম্প প্রশাসনের অভ্যন্তরে লাতিন আমেরিকার নীতির মূল উদ্দেশ্য ছিল মার্কিন কর্পোরেট প্রভাব পুনঃপ্রতিষ্ঠা। ভেনেজুয়েলার তেল, খনিজ সম্পদ ও প্রাকৃতিক গ্যাসের উপর পুনরায় নিয়ন্ত্রণ অর্জনের পরিকল্পনা— এটিই ছিল সেই নীতির কেন্দ্রবিন্দু। মাচাদো ছিলেন এই পরিকল্পনার “স্থানীয় মুখ” বা রাজনৈতিক মাধ্যম। তিনি প্রতিশ্রুতি দিয়েছিলেন যে মাদুরো পতনের পর ভেনেজুয়েলার অর্থনীতি “উন্মুক্ত বাজারের নীতিতে” পরিচালিত হবে, বিদেশি বিনিয়োগকারীদের পূর্ণ প্রবেশাধিকার দেওয়া হবে, এবং রাষ্ট্রীয় মালিকানাধীন সম্পদগুলো বেসরকারি কর্পোরেশনের হাতে তুলে দেওয়া হবে।

মারিয়া কোরিনা মাচাদো ২০১৯ সালের ২৩ জানুয়ারি ভেনেজুয়েলায় অনুষ্ঠিত এক জনসমাবেশে বলেছিলেন, “ভেনেজুয়েলা মুক্তির এক ধাপ দূরে, তারপর আমরা কিউবা ও নিকারাগুয়ার মুক্তির জন্য এগিয়ে যাব।” এই বক্তব্যে মাচাদো তার রাজনৈতিক লক্ষ্য ও কৌশল স্পষ্ট করেছেন। তিনি ভেনেজুয়েলার রাজনৈতিক পরিবর্তনকে কেবল একটি দেশীয় ইস্যু হিসেবে দেখেন না, বরং এটি লাতিন আমেরিকার অন্যান্য সমাজতান্ত্রিক সরকারের বিরুদ্ধে একটি বৃহত্তর আন্দোলনের অংশ হিসেবে দেখেন। বিশেষ করে, কিউবা ও নিকারাগুয়া— যেখানে সমাজতান্ত্রিক সরকার রয়েছে— সেগুলোর বিরুদ্ধে তার অবস্থান স্পষ্ট। তিনি মনে করেন যে, ভেনেজুয়েলায় সফল হলে, এই আন্দোলন কিউবা ও নিকারাগুয়াতেও ছড়িয়ে পড়বে। মাচাদোর এই বক্তব্য তাঁর রাজনৈতিক দর্শন ও আন্তর্জাতিক কৌশলকে প্রতিফলিত করে। এটি কেবল ভেনেজুয়েলার অভ্যন্তরীণ রাজনীতি নয়, বরং লাতিন আমেরিকার বৃহত্তর রাজনৈতিক পরিবর্তনের লক্ষ্যে তাঁর দৃষ্টিভঙ্গি ও উদ্দেশ্যকে চিহ্নিত করে।

এই পুরস্কার স্পষ্ট করে দেখায়, নোবেল কমিটি আজ শান্তির নয়, বরং সাম্রাজ্যবাদের রাজনৈতিক অভিলাষ পূরণের মঞ্চে পরিণত হয়েছে। যে ব্যক্তি বিদেশি সামরিক হস্তক্ষেপ চেয়েছে, সহিংস আন্দোলনে নেতৃত্ব দিয়েছে, এবং নিজের দেশের দরিদ্র জনগণকে নিষেধাজ্ঞার শিকার বানিয়েছে— তাঁকে “শান্তির দূত” বলে পুরস্কৃত করা নিছক পরিহাস। মারিয়া কোরিনা মাচাদো প্রকৃতপক্ষে লাতিন আমেরিকায় ওয়াশিংটনের এক ছায়াপুতুল, আর তাঁর নোবেল পুরস্কার— এই যুগের সাম্রাজ্যবাদী রাজনীতির আরেক নিঃশব্দ স্বীকৃতি।

More Articles