কোয়ান্টামের জগতে নোবেল স্বীকৃতি তিন বিজ্ঞানীর হাত ধরে নতুন দিগন্ত

Nobel Prize 2025 in Physics : লেড( LED) , লেসার, এমআরআই স্ক্যানার (MRI Scanner) থেকে শুরু করে আজকের কোয়ান্টাম কম্পিউটার, সবেতেই রয়েছে এই বিষ্ময়কর কোয়ান্টাম মেকানিক্সের অবদান।

জাতিসংঘ এই বছরকে আন্তর্জাতিক কোয়ান্টাম বর্ষ (IYQ2025) হিসেবে ঘোষণা করেছে। জুন মাসের ৯-১৪ তারিখে জার্মানির হেলগোল‍্যাণ্ডে কোয়ান্টাম মেকানিক্সের শতবর্ষ পূর্তিতে হাজির হয়েছিলেন বিশ্বের তাবড় তাবড় বিজ্ঞানী, গবেষকরা। সেই ‘হেলগোল‍্যাণ্ড’, ১৯২৫ সালে যেখান থেকে শুরু হয়েছিল তরুণ হাইজেনবার্গের যাত্রা। এবারের পদার্থবিজ্ঞানে নোবেল পুরষ্কার যেন তারই বহিঃপ্রকাশ। ‘ম্যাক্রোস্কোপিক কোয়ান্টাম মেকানিক্যাল টানেলিং এবং ইলেকট্রিক সার্কিটে এনার্জি কোয়ান্টাইজেশন’ গবেষণার জন্য নোবেল কমিটি এবছর ইউনিভার্সিটি অব ক্যালিফোর্নিয়া বার্কলের প্রফেসর জন ক্লার্ক, ফ্রান্সের মিশেল এইচ ডেভোরেট এবং মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের জন এম মার্টিনিস-কে পুরস্কৃত করেছেন। ঠিক কি করেছেন এই তিন মার্কিন বিজ্ঞানী?

এককথায় বলতে গেলে বিশাল বৈদ্যুতিক সার্কিটে বৃহৎ পরিসরে কোয়ান্টাম টানেলিং এবং শক্তির পরিমাণ নির্ধারণ করার (কোয়ান্টাইজেশন) জন্য তাঁদের ঝুলিতে এসেছে নোবেল। তাঁদের কাজ বুঝতে গেলে আমাদেরকে আগে জানতে হবে কোয়ান্টাম টানেলিং কি?

গোদা বাংলায় বললে সিঁদ কেটে ঘরে ঢোকা। একটি বলকে দেওয়ালের দিকে ছুঁড়ে দিলে কী হবে? বলটি দেওয়ালের সঙ্গে ধাক্কা খেয়ে ফিরে আসবে; ধ্রুপদী বল বিজ্ঞানের ধারণা অনুযায়ী দশবার বলটি ছোঁড়া হলে দশ বারই বলটি দেওয়ালে ধাক্কা খেয়ে ফিরে আসবে। কিন্তু কোয়ান্টাম জগতের নিয়মকানুন বড়ই অদ্ভুত। এই জগতে কোনো ছোট বস্তুকণাকে শক্ত দেওয়ালের দিকে ছুঁড়ে দেওয়া হলে, প্রতিবারই বস্তুকণা দেওয়ালে ধাক্কা খেয়ে যে ফিরে আসবে, তার কোনো নিশ্চয়তা নেই। মাঝে মাঝে বস্তুকণাটি দেওয়াল ভেদ করে অন্যদিকেও চলে যেতেই পারে, কারণ কোয়ান্টামের জগতে বস্তুকণারা শুধুমাত্র কণা নয়, সেই সঙ্গে তরঙ্গও বটে।

আরও পড়ুন

চিকিৎসা বিজ্ঞানে নোবেল: যে অসাধ্যসাধন করে পুরস্কৃত হলেন ত্রয়ী

বস্তুকণা যত ছোট হবে তার কোয়ান্টাম টানেলিংয়ের সম্ভাবনা তত বেশি হবে। বস্তুকণা বড় হলে কোয়ান্টাম টানেলিংয়ের সম্ভাবনা অনেক কমে যায়। সেজন্য আমাদের চারপাশের দৃশ্যমান জগতে কোয়ান্টাম টানেলিং আমরা বিশেষ দেখতে পাই না। এখানেই ক্লার্কদের কৃতিত্ব। তাঁরা দেখিয়েছেন যে শুধুমাত্র ক্ষুদ্র জগতের বেলায় কোয়ান্টামের নিয়ম খাটে না, কিছু ক্ষেত্রে একটু বড় পরিসরেও কাজ করে এই বলবিদ‍্যার নিয়ম। তাত্বিক পদার্থবিদরা হয়ত এর আগে চিন্তাও করতে পারতেন না মাইক্রোস্কোপিক জগতে রাজত্ব করা কোয়ান্টাম বলবিদ‍্যার দর্শনীয় প্রভাব মিলবে ম‍্যাক্রোস্কোপিক জগতে।

নোবেলজয়ী বিজ্ঞানীরা এক বৈদ্যুতিক সার্কিটে পরীক্ষা করে দেখেছেন যে একইসঙ্গে কোয়ান্টাম টানেলিং এবং প্যাকেট প‍্যাকেট আকারে শক্তির পরিবর্তন সম্ভব, পদার্থবিদ্যায় যাকে বলে কোয়ান্টাইজেশন। মজার কথা, তাঁদের এই সার্কিট এত বড় যে একটা ছোট্ট টেবিলে পুরো সেট আপটি রাখা যায়- কোয়ান্টামের নিরিখে এ বিরাট এক আকার। একটু বিশদে তাঁদের কাজের কথা আলোচনা করা যাক।

আশির দশকের মাঝামাঝি সময়ে ক্লার্ক, ডেভোরে এবং মার্টিনিস সুপারকন্ডাক্টর দিয়ে একটি বৈদ্যুতিক সার্কিট তৈরি করেন। সুপারকন্ডাক্টর বা অতিপরিবাহী হলো এমন বস্তু, যেখানে কোনো বিদ্যুৎ বাধা বা রোধ ছাড়াই প্রবাহিত হতে পারে। সার্কিটে এই সুপারকন্ডাক্টরের দুই অংশের মাঝে রাখা হয় খুব পাতলা এক অ-পরিবাহী স্তর। বিজ্ঞানীরা এই কাঠামোকে বলেন জোসেফসন জংশন। তাঁরা এর ভেতর বিদ্যুৎ প্রবাহ পাঠিয়ে পর্যবেক্ষণ করেন, কী ধরনের কোয়ান্টাম পরিস্থিতি তৈরি হয়। তাঁরা লক্ষ্য করেন সুপারকন্ডাক্টরের ভেতর প্রবাহমান আহিত কণা গুলো মিলেমিশে একক কণার মতো আচরণ করে। আপাতদৃষ্টিতে মনে হয়, যেন গোটা সার্কিটটাই একটাই বড় কণা! এই বড় কণার মতো সিস্টেমটি প্রথমে শূন্য ভোল্টেজে দশায় ছিল। এই সময় দশা পরিবর্তনের মতো যথেষ্ট শক্তি সিসটেমের থাকার কথা নয়। কিন্তু তাঁরা দেখতে পান, হঠাৎ করেই সেখানে ভোল্টেজ এসে হাজির- এত পুরোপুরি টানেলিং এফেক্ট! এর ফলে ‘সুইচ অফ থেকে অন’ অবস্থায় চলে গেছে। ক্লার্করা এরই নাম দিয়েছেন ম্যাক্রোস্কোপিক কোয়ান্টাম টানেলিং।

আরও পড়ুন

শতবর্ষে কোয়ান্টাম মেকানিক্স! কেন শতাব্দীর অন্যতম সফল তত্ত্ব এটি?

শুধু তা-ই নয়, দেখা গেল, এই সিস্টেম নিরবিচ্ছিন্ন ভাবে শক্তির শোষণ বা নিঃসরণ করেনা, বরং প্যাকেট প্যাকেট আকারে করে- সেই প্রারম্ভিক কোয়ান্টাম বলবিজ্ঞান‍ের কোয়ান্টার মতো। ক্লার্কদের এই ব্যবস্থা কোয়ান্টাম পদার্থবিদ‍্যার চিরচারিত নিয়ম, শক্তির কোয়ান্টাইজেশন মেনে চলে। সেজন‍্য পুরুস্কার ঘোষণার সময় নোবেল কমিটির চেয়ারম্যান এরিকসন বলেন, 

“শত বছরের পুরনো কোয়ান্টাম পদার্থবিদ্যা এখনও আমাদের নিত্য নতুন চমক দেখাচ্ছে— এটাই সবচেয়ে আনন্দের বিষয়। কোয়ান্টাম পদার্থবিদ্যাই আজকের সব ডিজিটাল প্রযুক্তির মূলভিত্তি।”

সত‍্যি তাই! লেড( LED) , লেসার, এমআরআই স্ক্যানার (MRI Scanner) থেকে শুরু করে আজকের কোয়ান্টাম কম্পিউটার, সবেতেই রয়েছে এই বিষ্ময়কর কোয়ান্টাম মেকানিক্সের অবদান। সেই সঙ্গে কোয়ান্টাম ক্রিপ্টোগ্রাফি, কোয়ান্টাম কম্পিউটার এবং কোয়ান্টাম সেন্সর, এককথায় কোয়ান্টাম যোগাযোগ ব্যবস্থার যুগে পথ হাঁটছি আমরা। সেই পথে যাঁরা আলো দেওয়ার চেষ্টা করেছে, তাঁদেরকেই স্বীকৃতি দিল এবারের সুইডিশ একাডেমি। শতবর্ষ পেরিয়ে আবারও স্বীকৃতি পেল শতাব্দীর সবচেয়ে সফলতম তত্ব।

 

More Articles