কেন নোবেলজয়ী নার্গিসকে ভয় পায় ইরান?

Narges Mohammadi: জাতীয় নিরাপত্তাবিরোধী কার্যকলাপ ও রাষ্ট্রবিরোধী প্রোপাগান্ডা ছড়ানোর অভিযোগে তাঁর বিরুদ্ধে মোট ৩১ বছরের কারাদণ্ড দেওয়া হয়েছে।

নোবেল শান্তি পুরস্কারপ্রাপ্ত মানবাধিকারকর্মী নার্গিস মহাম্মদিকে ফের গ্রেফতার করেছে ইরানের নিরাপত্তা ও পুলিশ বাহিনী। শুক্রবার ইরানের পূর্বাঞ্চলীয় শহর মাশহাদে এক স্মরণসভা থেকে তাঁকে আটক করা হয়। এই খবর নিশ্চিত করেছে প্যারিসভিত্তিক ‘নার্গিস ফাউন্ডেশন’, নার্গিসের ভাই মেহদি মোহাম্মদির বরাতে। যে স্মরণসভা থেকে নার্গিসকে গ্রেফতার করা হয়েছে, সেটি ছিল ইরানের সুপরিচিত মানবাধিকার আইনজীবী খোসরো আলিকোরদির স্মরণে আয়োজিত। সম্প্রতি নিজের কার্যালয় থেকে তাঁর মরদেহ উদ্ধার হয়েছিল। মানবাধিকার নিয়ে কাজ করা একজন আইনজীবীর স্মরণসভা থেকেই আরেক মানবাধিকারকর্মীকে গ্রেফতার, এই ঘটনাই ইরানের বর্তমান রাষ্ট্রচরিত্রকে স্পষ্ট করে তোলে।

দ্য গার্ডিয়ান জানায়, নার্গিসের স্বামী ও প্যারিসপ্রবাসী সাংবাদিক তাঘি রাহমানিও গ্রেফতারের বিষয়টি নিশ্চিত করেছেন। সামাজিক যোগাযোগমাধ্যম এক্সে তিনি লেখেন, মাশহাদে ওই স্মরণসভা থেকেই নার্গিসকে আটক করা হয়েছে। তাঁর সঙ্গে গ্রেফতার হয়েছেন ইরানের আরেক শীর্ষ মানবাধিকারকর্মী সেপিদেহ বাহলিয়ান।

নার্গিস মোহাম্মদি ২০২৩ সালে নোবেল শান্তি পুরস্কারে ভূষিত হন। কিন্তু সেই সম্মান গ্রহণের জন্য নরওয়েতে যাওয়ার অনুমতি দেয়নি তেহরান প্রশাসন। তাঁর যমজ সন্তান আলি ও কিয়ানা মায়ের হয়ে পুরস্কার গ্রহণ করেন এবং বিশ্ববাসীর সামনে নার্গিসের বার্তা পড়ে শোনান। নোবেল কমিটি সম্মান জানাতে অনুষ্ঠানে একটি চেয়ার ফাঁকা রেখেছিল। এটি একটি প্রতীকী প্রতিবাদ, যা ইরানের রাষ্ট্রব্যবস্থাকে অস্বস্তিতে ফেলেছিল।

আরও পড়ুন

“মওত মুবারক হো মীনা”, প্রিয় বন্ধুর মৃত্যুতে কেন শুভেচ্ছা জানিয়েছিলেন নার্গিস?

গত দুই দশকের অধিকাংশ সময় নার্গিস কাটিয়েছেন তেহরানের কুখ্যাত এভিন কারাগারে। জাতীয় নিরাপত্তাবিরোধী কার্যকলাপ ও রাষ্ট্রবিরোধী প্রোপাগান্ডা ছড়ানোর অভিযোগে তাঁর বিরুদ্ধে মোট ৩১ বছরের কারাদণ্ড দেওয়া হয়েছে। তেরো বার গ্রেফতারও হয়েছেন তিনি। তবু কারাগার থেকেও থামেনি তাঁর প্রতিবাদ।

২০২৪ সালের নভেম্বরে নার্গিসের ডান পায়ের নিচের অংশে অস্ত্রোপচার করা হয়। একটি টিউমারসদৃশ ক্ষত অপসারণ করা হয়েছিল, যা ক্যানসার হওয়ার আশঙ্কা তৈরি করেছিল। অস্ত্রোপচারের পর তাঁর সাজা তিন সপ্তাহের জন্য স্থগিত করা হয়। ধারণা করা হচ্ছিল, চিকিৎসা শেষে তাঁকে ফের কারাগারে পাঠানো হবে। কিন্তু সে সময় আর তাঁকে জেলে ফেরানো হয়নি। এই অবস্থায় আবার তাঁর গ্রেফতার প্রমাণ করে, অসুস্থতাও ইরানের কাছে কোনো মানবিক বিবেচনার জায়গা তৈরি করে না।

কারাগারেই থেকেও নার্গিস ছিলেন উচ্চকণ্ঠ। তিনি লিখেছিলেন, জেলখানার জানালার ছোট ফাঁকটুকুই তাঁর গোটা পৃথিবী। সেখান থেকেই তিনি তেহরানের উত্তরের পাহাড়, গাছ আর ফুল দেখেন। সেই দৃশ্যই তাঁকে মুক্ত ইরানের স্বপ্ন দেখায়। তাঁর ভাষায়, রাষ্ট্র যত শাস্তিই দিক, স্বাধীনতা কেড়ে নিলেও তাঁর সংকল্প আরও দৃঢ় হবে— ইরানে গণতন্ত্র আনতেই হবে।

ইরানে নারীর অধিকারের প্রশ্নে নার্গিস ছিলেন প্রথম সারির কণ্ঠস্বর। ১৯৭৯ সালের ইসলামিক বিপ্লবের পর থেকে ইরানে হিজাব বাধ্যতামূলক। ধর্ম নির্বিশেষে সব নারীকে মাথা ঢেকে রাখতে হবে, এই আইন কার্যকর করেন তৎকালীন শীর্ষ ধর্মীয় নেতা। অথচ তার আগেই, ১৯৩০-এর দশকে ইরানের শাহ হিজাব নিষিদ্ধ করেছিলেন এবং উল্টো নির্দেশ ছিল হিজাব পরলে তা খুলিয়ে দিতে হবে।

ইসলামিক বিপ্লবের পর নারীদের স্টেডিয়ামে ঢোকাও নিষিদ্ধ করা হয়। আইন অনুযায়ী কোথাও ফুটবল খেলা দেখায় বাধা নেই, কিন্তু বাস্তবে মেয়েরা স্টেডিয়ামে ঢুকলেই আটক করা হয়। এই দ্বিচারিতাই ইরানের রাষ্ট্রব্যবস্থার বৈশিষ্ট্য।২০১৮ সালে চিনের এক সঙ্গীতশিল্পী ইরানে কনসার্ট চলাকালীন হিজাব পরতে বাধ্য হন। এমনকি বিদেশি নারীদের ক্ষেত্রেও এই আইন শিথিল নয়। শীর্ষ ধর্মীয় নেতাই দেশের সেনাবাহিনী, বিচার বিভাগ ও রাষ্ট্রীয় প্রচারযন্ত্রের সর্বময় নিয়ন্ত্রক। ফলে নারীর পোশাক থেকে শুরু করে মতপ্রকাশ, সবই রাষ্ট্রীয় নজরদারির আওতায়।

আরও পড়ুন

নারীর অধিকারের লড়াইয়ে বারবার জেল, সেই অদম্য নার্গিসকেই এবার শান্তির নোবেল

প্রসঙ্গত, ২০২২ সালের সেপ্টেম্বরে মাহসা আমিনির মৃত্যু ইরানকে নাড়িয়ে দিয়েছিল। পোশাকবিধি না মানার অভিযোগে আটক হওয়ার পর পুলিশের হেফাজতেই তাঁর মৃত্যু হয়। এই ঘটনার পর ইরানের মেয়েরা রাস্তায় নেমে হিজাব পুড়িয়ে প্রতিবাদ জানান। বহু পুরুষও তাঁদের পাশে দাঁড়ান। পরিস্থিতি এমন পর্যায়ে পৌঁছায় যে পুলিশকে রাস্তায় টহল বন্ধ করতে হয়। এই আন্দোলনের সময় পাশ্চাত্য সংবাদমাধ্যমে একাধিক সাক্ষাৎকার দিয়েছিলেন নার্গিস। এরপরই তাঁর উপর আরও কড়াকড়ি আরোপ করা হয়। টেলিফোনে কথা বলা, সাক্ষাৎকার দেওয়া সবই নিষিদ্ধ করা হয় তাঁর জন্য।

নার্গিস শুধু ইরানের নারীদের নয়, দেশের সব নাগরিকের মানবাধিকার ও স্বাধীনতার পক্ষে লড়াই করেছেন। ২০২২ সালে এভিন কারাগার থেকে পাঠানো এক চিঠিতে তিনি বন্দি নারীদের উপর যৌন ও শারীরিক নির্যাতনের বিবরণ দেন। এই চিঠিই রাষ্ট্রকে সবচেয়ে বেশি আতঙ্কিত করে। রাষ্ট্র আসলে ভয় পায় এই কণ্ঠস্বরগুলোকে। ভয় পায়, যদি নার্গিসদের চিৎকারে বাকিদের ঘুম ভেঙে যায়। তাই তাঁদের গ্রেফতার, নীরবতা চাপিয়ে দেওয়া, কখনও মানসিক ভারসাম্যহীন বলে দেগে দেওয়া— এই সবই রাষ্ট্রীয় কৌশল।

বিশ্বজুড়েই আজ সাধারণ মানুষের অধিকার সংকুচিত হচ্ছে। নারীর উপর হিংসা বাড়ছে, কর্তৃত্ববাদ শক্তিশালী হচ্ছে। ইরানে হিজাব আইন, ফিলিস্তিনে লাগাতার আক্রমণ, ইউরোপ ও আমেরিকায় বর্ণবাদ, ভারতে ধর্মীয় ফ্যাসিবাদের উত্থান— সবই একই প্রবণতার অংশ। এই পরিস্থিতিতে নার্গিস মহাম্মদির গ্রেফতার শুধু ইরানের ঘটনা নয়। এটি বিশ্বব্যাপী মানবাধিকারের সংকটের প্রতীক। প্রশ্ন থেকেই যায়, এই অহিংস প্রতিবাদ যদি দমন করা হয়, যদি ন্যায়বিচারের পথ বন্ধ হয়ে যায়, তাহলে মানুষ কি অন্য পথ খুঁজতে বাধ্য হবে না? কারাগারের জানালা দিয়ে পাহাড় দেখেই যে নারী মুক্তির স্বপ্ন বুনেছেন, তাঁকে বারবার বন্দি করা যায়। কিন্তু সেই স্বপ্নকে বন্দি করা কি আদৌ সম্ভব?

More Articles