বড়দিনে নাহুম'সকে কখনও ভুলবে না কলকাতা

Nahoum and sons bakery: ভারতের প্রাক্তন ক্রিকেট অধিনায়ক সৌরভ গাঙ্গুলীও নাহুম'সের বড় ভক্ত। তাঁর জন্য একবার নাহুম'স ক্রিকেট ব্যাটের আদলে ফ্রুট কেক তৈরি করে দিয়েছিল।

নিউ মার্কেটের গোলকধাঁধায় ভিড় ঠেলে এগোলে হঠাৎই আপনার নাকে আসবে মাখন, চিনি আর দারুচিনির একটা মায়াবী গন্ধ। সেই সুগন্ধ অনুসরণ করে এগিয়ে গেলে আপনি পৌঁছে যাবেন এমন এক দরজায়, যা আপনাকে বর্তমান কলকাতা থেকে সরাসরি একশো তেইশ বছর আগের এক শহরে নিয়ে যাবে। দোকানটির নাম— ‘নাহুম অ্যান্ড সন্স’ (Nahoum & Sons)। ​কলকাতার বুকে টিকে থাকা শেষ ইহুদি বেকারি, যা কেবল একটি খাবারের দোকান নয়, বরং শহরের এক জীবন্ত ইতিহাস।

২৪ ডিসেম্বর সকাল থেকে নিউ মার্কেটের এফ-২০ ব্লকের সামনে মানুষের লম্বা লাইন পড়ে। ​মজার ব্যাপার হলো, লাইনে দাঁড়ানো অনেক মানুষই একে অপরকে চেনেন না, কিন্তু বছরের পর বছর এই একই দিনে লাইনে দাঁড়াতে দাঁড়াতে তাঁদের মধ্যে যেন এক ধরণের অঘোষিত বন্ধুত্ব তৈরি হয়ে গিয়েছে। অনেকেই বলেন, “নাহুমসের কেক ছাড়া আমাদের ক্রিসমাস শুরুই হয় না।” কিন্তু এর সূত্রপাত হলো কীভাবে?

বাগদাদ থেকে আসা ইহুদি যুবক নাহুম ইজরায়েল মোর্ডেকাই যখন কলকাতায় এই ব্যবসা শুরু করেছিলেন তখন এই দোকানটি ছিল না, তিনি বাড়ি বাড়ি গিয়ে কেক আর পনির বিক্রি করতেন। ১৯০২ সাল। গ্রাহকদের প্রশংসা আর ক্রমবর্ধমান চাহিদার উপর ভিত্তি করে নিউ মার্কেটে প্রতিষ্ঠা করা হলো 'নাহুম অ্যান্ড সন্স'। কিন্তু, বর্তমানে যেখানে নাহুম'স অবস্থিত, গোড়ায় কিন্তু সেখানে ছিল না। ১৯১৬ সালে স্থানান্তর হয় নিউ মার্কেটের (তৎকালীন হগ মার্কেট) বর্তমান ঠিকানায়। তারপর বংশ পরম্পরায় এই ঠিকানাতেই চলতে থাকে নাহুম'সের রমরমা ব্যবসা।

রমরমিয়ে চলে নাহুমসের ব্যবসা, প্রতিটি পদ বিক্রি হয়ে যায় মুহূর্তেই 

নাহুম'সের দীর্ঘ ইতিহাসে সবচেয়ে বড় পরিবর্তন আসে ২০১৩ সালে, যখন দোকানের সুপরিচিত মুখ, নাহুম পরিবারের তৃতীয় প্রজন্ম ডেভিড নাহুম মারা যান। এরপর দোকানের হাল ধরেন তাঁর ভাই আইজ্যাক নাহুম। আইজ্যাক পেশায় একজন চার্টার্ড অ্যাকাউন্ট্যান্ট এবং বহু বছর ধরে ইংল্যান্ডে ছিলেন। কিন্তু পরিবারের ঐতিহ্য বাঁচাতে তিনি ফিরে আসেন। বর্তমানে তিনি ইজরায়েল ও কলকাতার মধ্যে যাতায়াত করে ব্যবসা পরিচালনা করেন। আইজ্যাকের ছেলে অ্যাডাম নাহুম, যিনি পেশায় জেরুজালেমের একজন চিকিৎসক, তিনিও এখন ব্যবসার দিকে নজর রাখছেন। ১২৩ বছর ধরে বংশ পরম্পরায় চলছে এই বেকারি। এক শতাব্দী ধরে এরকম রমরমা ব্যবসা সচরাচর খুব একটা চোখে পড়ে না। কিন্তু, এক শতাব্দীর যাত্রার পরেও কল্লোলিনীর কাছে নাহুম'স কেন অনন্য? 

ব্যবসার প্রতিদিনের কাজকর্ম দেখাশোনা করেন জেনারেল ম্যানেজার জগদীশ চন্দ্র হালদার। তিনি গত ৪৯ বছর ধরে এই দোকানের সঙ্গে যুক্ত। যখন কাজ শুরু করেন, তখন তিনি ছিলেন কিশোর। আজ তিনি প্রবীণ। নাহুম'সের কর্মচারীরা শুধু কাজ করেন না, তাঁরা এই পরিবারের অংশ হয়ে যান। বর্তমানে যাঁরা সেখানে পরিবেশন করেন, তাঁদের মধ্যে অনেকেরই বাবা বা ঠাকুরদা এই দোকানে কাজ করতেন। এখানে খাবারের সঙ্গে সঙ্গে ঐতিহ্যের প্রতি শ্রদ্ধাও বিক্রি হয়। এই যে বংশপরম্পরায় আনুগত্য, এটাই নাহুমসকে অন্যান্য কর্পোরেট বেকারি থেকে আলাদা করে রাখে।

নাহুম'সে পুরনো রেসিপি অনুসারেই তৈরি হওয়া বিভিন্ন ডেসার্ট

নাহুম'স অনন্য, কারণ- তারা সময়ের সঙ্গে বদলায়নি। যেখানে চারপাশের দুনিয়া প্রযুক্তিতে ভাসছে, সেখানে নাহুম'স আজও লোহার বড় ওভেনে কেক বেক করে। তাদের মেহগনি কাঠের শো-কেসগুলোর বেলজিয়াম কাঁচ বা ইতালীয় সিলিং—সবই ইতিহাসের এক একটি অংশ। তারা আজও বিজ্ঞাপনে ১ টাকাও খরচ করে না, কারণ তাদের বিশ্বাস—“We’re good because we’re old, and we’re old because we’re good.”

শহরের অলিতে গলিতে আজ আধুনিক ক্যাফে আর মাল্টিন্যাশনাল চেইন বেকারি। কিন্তু নাহুম'সের বিশেষত্ব হলো তার ‘অপরিবর্তনশীলতা’। ১২৩ বছর ধরে নাহুম'স, তার আভিজাত্য বজায় রেখে চলেছে। এখনও নাহুম'সে পুরনো নির্ভেজাল রেসিপি অনুসারেই তৈরি হয় বিভিন্ন ডেসার্ট। নাহুম'সের বিশেষত্ব হলো তাঁদের ‘সিক্রেট ফ্যামিলি রেসিপি’। অনেক আধুনিক বেকারি আজকাল খরচ কমাতে মার্জারিন বা কৃত্রিম সুগন্ধি ব্যবহার করে, কিন্তু নাহুম'স আজও শতাব্দীপ্রাচীন ফর্মুলায় অনড়।

শুধুমাত্র রেসিপিই নয়, বদল হয়নি আরও অনেককিছুরই। দোকানের ভেতরে ঢুকতেই যে বড় বড় মেহগনি বা সেগুন কাঠের শো-কেসগুলোর দিকে চোখ যায়, সেগুলি ১৯১৬ সালে কেনা আসবাব। দোকান শুরুর সময় যে আসবাবপত্র ছিল, আজও তা বদলানো হয়নি। এমনকি দোকানের ক্যাশ কাউন্টারটিও সেই পুরনো আমলের। কাঁচের যে শো-কেসগুলো দেখতে পাওয়া যায়, সেগুলি সাধারণ কাঁচ নয়। এগুলি হলো বেলজিয়াম গ্লাস (Belgium Glass), যা ১৯১৬ সালে আনা হয়েছিল। এক শতাব্দী পেরিয়ে গেলেও এই কাঁচের ঔজ্জ্বল্য ম্লান হয়নি। বর্তমান প্রজন্মের মালিকরা বারবার আধুনিক এসি বা নিয়ন আলোর কথা ভাবলেও, দোকানের ‘ওল্ড ওয়ার্ল্ড চার্ম’ নষ্ট হওয়ার ভয়ে তাঁরা পিছু হটেছেন। তাদের মতে, লোকে এখানে শুধু কেক খেতে আসে না, শৈশব ফিরে পেতে আসে।

নাহুম'সের সেই 'ওল্ড ওয়ার্ল্ড চার্ম’

​দোকানের ওপরের সিলিং বা ছাদটি লক্ষ্য করলে দেখবেন, সেখানে আজও পুরনো আমলের কাঠের বিম দেখা যায়। দোকানের ভেতরে কোনও এসি (Air Conditioner) নেই, কারণ মালিকদের মতে, এসির হাওয়া ফ্রেশ কেকের ওপরের টেক্সচার বা গঠন নষ্ট করে দিতে পারে। তাই আজও পুরনো আমলের বিশাল ফ্যানগুলোই গ্রাহকদের ভরসা।

নাহুম'সের ওয়ালনাট কেক

নাহুমসের প্রতিটি পদই অনন্য, তবে তার মধ্যেও কয়েকটি পদ বিশেষ জনপ্রিয়—
​রিচ ফ্রুট কেক: এটি নাহুমসের মুকুট। এটি এমন এক কেক যা কোনও প্রিজারভেটিভ ছাড়াই দীর্ঘদিন ভালো থাকে। এর স্বাদ ও ঘনত্ব আজও অপরিবর্তিত। শোনা যায়, নাহুমসের ফ্রুট কেকের ময়েশ্চার বা আর্দ্রতা কেবল অ্যালকোহল থেকে আসে না; এর গোপন রহস্য লুকিয়ে আছে কিসমিস এবং অন্যান্য ড্রাই ফ্রুটস ভেজানোর বিশেষ পদ্ধতিতে। এই রেসিপিটি নাহুম'সের প্রতিষ্ঠার সময় থেকে একই আছে।

চিজ পাফ : নোনতা পদের মধ্যে এটি কিংবদন্তি। ​নাহুম'সের সবচেয়ে জনপ্রিয় নোনতা খাবার হলো ‘চিজ পাফ’। কিন্তু এর আসল নাম ছিল ‘সামবুসাক’ (Sambusak)। এটি একটি ঐতিহ্যবাহী ইহুদি পদ। বাগদাদ থেকে আসা ইহুদিরা এই খাবারটি কলকাতায় এনেছিলেন। মূল রেসিপিতে এর ভেতরে মশলাদার মাংস বা পনির থাকতো। ​কিন্তু কলকাতার মানুষের রুচি অনুযায়ী নাহুম'স পরিবার এর বিবর্তন ঘটিয়ে, একে আজকের ‘চিজ পাফ’-এ পরিণত করেছে। আজও এর ভেতরে যে চিজ ব্যবহার করা হয়, তা কোনও সাধারণ ব্র্যান্ডের চিজ নয়, বরং তাঁদের নিজস্ব গোপন পদ্ধতিতে তৈরি করা এক বিশেষ ধরনের পনির।

নাহুম'সের কাস্টার্ড ক্রিম রোল

এবং সঙ্গে রয়েছে লেমন টার্ট, যার মধ্যে টক-মিষ্টির এক অদ্ভুত ভারসাম্য থাকে, যা মুখে দিলেই মিলিয়ে যায়। এবং ব্রাউনি ও রাম বল, এতে থাকে চকোলেটের বিশুদ্ধতা আর ঐতিহ্যের মিশেল।​

টক-মিষ্টি লেমন টার্ট

এই জাদুকরী দোকানটিকে ঘিরে এমন অনেক তথ্য আছে, যা হয়তো অনেকেরই অজানা—

নাহুমস কেবল সাধারণ মানুষের নয়, ব্রিটিশ রাজপরিবারেরও পছন্দের তালিকায় ছিল। ​শোনা যায়, ১৯২১ সালে যখন প্রিন্স অফ ওয়েলস (পরবর্তীতে রাজা অষ্টম এডওয়ার্ড) কলকাতা সফরে এসেছিলেন, তাঁর বিকেলের চায়ের টেবিলে নাহুম'স থেকে বিশেষ পেস্ট্রি পাঠানো হয়েছিল।

ব্রিটিশ আমলের ভাইসরয় লর্ড লিটন থেকে শুরু করে আধুনিক যুগের রাজনৈতিক ব্যক্তিত্ব— নাহুমসের ভক্ত সবাই। বলা হয়, একসময় দিল্লির রাইসিনা হিলসেও নাহুম'স থেকে কেক যেত।

এমনকি স্বাধীনতার পরেও ভারতের প্রথম প্রধানমন্ত্রী জওহরলাল নেহরু যখনই কলকাতায় আসতেন, তাঁর সফরের মেনুতে নাহুম'সের মাটন প্যাটিস এবং রিচ ফ্রুট কেক রাখার চেষ্টা করা হতো।

প্লাম কেক

 ১৯৬৬ সালে যখন ক্যান্টারবেরির আর্চবিশপ জেফ্রি ফিশার কলকাতা সফরে আসেন, তাঁকে নাহুমসের ফ্রুট কেক পরিবেশন করা হয়েছিল। তিনি খেয়ে বলেছিলেন, “এটি আমার জীবনের শ্রেষ্ঠ ফ্রুট কেক।”

মুখ্যমন্ত্রী বিধানচন্দ্র রায় থেকে শুরু করে মহানায়িকা সুচিত্রা সেন—নাহুমসের ফ্রুট কেক সবার অন্দরমহলে একসময় রাজত্ব করেছে। বিখ্যাত সংগীতশিল্পী ও অভিনেতা অঞ্জন দত্ত আজও নিউ মার্কেট গেলে নাহুম'স থেকে রাম বল কেনা কোনও মতেই বাদ দেন না।

নাহুম'সের রাম বল;  ছবি: অর্ক দেব

​ভারতের প্রাক্তন ক্রিকেট অধিনায়ক সৌরভ গাঙ্গুলীও নাহুম'সের বড় ভক্ত। তাঁর জন্য একবার নাহুম'স ক্রিকেট ব্যাটের আদলে ফ্রুট কেক তৈরি করে দিয়েছিল।

দোকানের ক্যাশ কাউন্টারে যে কাঠের টাকা রাখার বাক্সটি রয়েছে, সেটি প্রায় ১১০ বছরের পুরনো। আজও সেটিই ব্যবহৃত হয়।

আরও পড়ুন - নস্টালজিয়ায় ছেদ! নাহুমসের মেনু থেকে কেন চিরতরে হারাল এই পদ?

২০২৪-এর শুরু থেকে নাহুম'স তাদের মেনু থেকে সব চিকেন প্যাটি ও চিকেন রোল সরিয়ে নিয়েছে। কারণ হিসেবে জানানো হয়েছে, কলকাতায় উপযুক্ত ‘কোশার’ (Kosher) মাংস সরবরাহকারীর অভাব। ইহুদি নিয়ম অনুযায়ী নির্দিষ্ট ধর্মীয় বিধান মেনে জবাই করা মাংস ছাড়া তারা কিছু বিক্রি করতে নারাজ।

বর্তমানে নাহুম'সে বিক্রি করা হয় চিজ প্যাটি ও ভেজিটেবল প্যাটি

বহু দশক ধরে নিউ মার্কেটের অন্যান্য দোকানের মতো রবিবার দোকান বন্ধ থাকত নাহুম'স। কিন্তু বর্তমানে তারা তাদের আদি ধর্মীয় ঐতিহ্য অনুযায়ী ‘সাবাত’ (Sabbath) পালন করতে শনিবার দোকান বন্ধ রাখে এবং রবিবার দুপুর পর্যন্ত খোলা রাখে। তারা মুনাফার চেয়ে ঐতিহ্যকে বেশি গুরুত্ব দেয়।

নাহুম'স কোনও গ্ল্যামারাস পেস্ট্রি শপ নয়। এটি কলকাতার সেই পুরনো অভিজাত চেহারা, যা আজও ধুলোবালি আর ভিড়ের মধ্যে নিজের রাজকীয়তা নিয়ে দাঁড়িয়ে আছে। আপনি যদি ইতিহাসের স্বাদ পেতে চান, তবে এক বিকেলে নিউ মার্কেটের এফ-২০ ব্লকে পৌঁছে যান। এক কামড় রিচ ফ্রুট কেক আপনাকে মনে করিয়ে দেবে—সব কিছু বদলে গেলেও ঐতিহ্য কখনও পুরনো হয় না। যে শহরে প্রতিদিন নতুন নতুন রেস্তোরাঁ খোলে আর বন্ধ হয়, সেখানে নাহুম'স ১২৩ বছর ধরে তার একই স্বাদ আর আভিজাত্য নিয়ে মাথা উঁচু করে দাঁড়িয়ে আছে। ​কলকাতার বুকে টিকে থাকা শেষ ইহুদি বেকারি, যা কেবল একটি খাবারের দোকান নয়, বরং শহরের এক জীবন্ত ইতিহাস।

More Articles