বাইজি গলি থেকে মুম্বই শাসন! ভারতের প্রথম দুই মহিলা সুরকারকে ভুলেছে সিনেমা

First Female Music Directors of Bollywood: জদ্দানের মা দলীপা বাই ছিলেন এলাহাবাদের নামকরা নর্তকী। ফলে গানবাজনা যে জদ্দানের রক্তে থাকবে, তাতে আর সন্দেহে কী!

আপনার প্রিয় পাঁচ সুরকারের নাম মনে করুন তো? শচীন কর্তা বা পঞ্চমকে নিশ্চয়ই বাদ দেননি তালিকা থেকে! কিংবা সলিল চৌধুরী! এ আর রহমান তো আলবাত আছেনই! অথবা হাল আমলের শান্তনু মৈত্র কিংবা বিশাল-শেখর? কিন্তু এই সব তালিকায় মেয়েদের নাম মনে পড়ছে কি তেমন করে?

না, সুরের ভুবনে বিশেষত সুরকারদের এই মায়াজগতে মহিলাদের আনাগোনা নিতান্তই হাতে গোনা। কেন? সুরবোধের অভাব! তাই যদি হবে, তবে এত বড় বড় মহিলা সঙ্গীতশিল্পী, তাঁদের জগৎজোড়া খ্যাতি! কই! সেখানে তো পিছিয়ে নেই মেয়েরা। নাকি এর নেপথ্যে রয়েছে অন্য পুরুষতান্ত্রিক বোধ, যা চিহ্নিত করে দিয়ে এসেছে মেয়েদের গণ্ডি। তার বাইরে বেরোতে চাওয়া তাই প্রতিস্পর্ধা। যে নারী রাঁধে এবং চুল বাঁধে, জাগতিক কোনও বিষয়েই নেতৃত্ব দেওয়া কিংবা পরিচালনার ভার সামলানো কি আর তাঁর পক্ষে মুখের কথা! তাই সুরকারদের অঙ্গুলিহেলনে গান গাওয়ার অধিকার পেয়েছেন মহিলা সঙ্গীতশিল্পীরা। তবে সুরের জাদুতে গায়ককে চালনা করার ক্ষমতা তাঁকে তেমন করে দেয়নি বোধহয় এই পিতৃতান্ত্রিক সমাজ! তবে কি সুরের জগতে অর্ধেক আকাশটুকু অধরাই থেকে গিয়েছে মেয়েদের জন্য?

একেবারেই নয়। সেখানেও প্রদীপ জ্বেলেছেন মেয়েরা। ভেঙেছেন স্টিরিওটাইপ। শুধুমাত্র যে সলতেটুকু উসকে দিয়েছেন তাই নয়, স্বমহিমায় আলোও ছড়িয়েছেন তাঁরা। তবে সেই ধারা কেন পরবর্তীকালে একই ভাবে বজায় থাকল না, তা একেবারেই অন্য প্রশ্ন।

যে ভারতীয় সিনেমার গৌরবে চারপাশে এত কথা, এত উদযাপন; একটা সময় সেই সিনেমার জগৎটাকে কিন্তু 'ভদ্দরলোকের জায়গা' বলে ঠাওর করা হত না। একটা সময় নাটক, থিয়েটারে নারী সাজতেন পুরুষ অভিনেতারাই। পরবর্তী কালে পতিতাপল্লীর মেয়েদের তুলে এনে সেই জায়গাটা দেওয়া হল পর্দায়। ফলে সম্ভ্রান্ত পরিবারের মেয়েদের সিনেমায় আসা যে অধঃপতনেরই নামান্তর তা বলাই বাহুল্য। আজও অবশ্য সিনেমায় সকলে ‘নামে’নই, ওঠেন হাতেগোনা। স্বাভাবিক ভাবেই সেই সময়ে দাঁড়িয়ে সুরকার হওয়ার কাজটা সহজ ছিল না মোটেও। আর সেই বন্ধ দরজার সামনে এসে দাঁড়িয়েছিলেন দুই নারী।

আরও পড়ুন- “মওত মুবারক হো মীনা”, প্রিয় বন্ধুর মৃত্যুতে কেন শুভেচ্ছা জানিয়েছিলেন নার্গিস?

সেটা তিরিশের দশক। একজনের জন্ম বিখ্যাত এক নর্তকীর গর্ভে। নাচ-গানের পরিমণ্ডলে বড় হওয়ার দৌলতে ছোট থেকেই শাস্ত্রীয় সঙ্গীত শিক্ষার শুরু। অন্যজন অবশ্য একেবারে বিপরীত মেরুর বাসিন্দা। রক্ষণশীল পার্সি পরিবারে ছোট থেকেই শেখা শুরু হয়েছিল শাস্ত্রীয় সঙ্গীতের চর্চা। এই দুই মেরুর বাসিন্দাকে এক সুতোয় বেঁধে দিল ১৯৩৫ সালে মুক্তি পাওয়া 'জওয়ানি কি হাওয়া' নামে একটি ছবি। সেই ছবিতে প্রথমবার জুটি বাঁধলেন দুই নারী। ভারতীয় সিনেমা পেল তার প্রথম মহিলা সঙ্গীত পরিচালক জদ্দান বাই ও সরস্বতী দেবীকে। 

জদ্দানের মা দলীপা বাই ছিলেন এলাহাবাদের নামকরা নর্তকী। ফলে গানবাজনা যে জদ্দানের রক্তে থাকবে, তাতে আর সন্দেহে কী! পরবর্তীকালে বড় বড় ওস্তাদের কাছে তালিমও নেন তিনি। ইতিমধ্যে কলোম্বিয়া গ্রামাফোন কোম্পানিতে গজল রেকর্ড করে বেশ নাম করে ফেললেন জদ্দান। দেশের বিভিন্ন কোণা থেকে অনুষ্ঠানের ডাক আসছে প্রায়শই। ততদিনে বেতারেরও চেনা নাম জদ্দান। ১৯৩৩ সালে লাহোরের প্লে আর্ট ফটো কোম্পানি থেকে ডাক পেলেন অভিনয়ের। ‘রাজা গোপীচাঁদ’ নামে ছবিতে অভিনয় দিয়ে বলিউডে পা রাখলেন জদ্দান।

এদিকে, সরস্বতী দেবী যেন সম্পূর্ণ অন্য গ্রহের বাসিন্দা। জন্মের পর বাবা-মা নাম রেখেছিলেন খুরশিদ। ছোট বেলায় শাস্ত্রীয় সঙ্গীতে হাতেখড়ি, আর পাঁচটা ধনী পার্সি পরিবারে যেমন হয়। তবে ধ্রুপদী সঙ্গীত ছাড়া কিছুই চেনে না সেই মেয়ে। সারদা সঙ্গীত বিদ্যালয়ে বিষ্ণু নারায়ণ ভাটখণ্ডের কাছে শুরু হল তালিম। পরে লখনউয়ের ম্যারিস কলেজ অব মিউজিক থেকে ধ্রুপদী সঙ্গীত নিয়ে পড়াশোনা শেষ করেন খুরশিদ। বাজাতে পারতেন সেতার, দিলরুবার মতো বেশ কিছু বাদ্যযন্ত্র। তখন রীতিমতো অনুষ্ঠান করে বেড়াচ্ছেন তিনি। বম্বের ইন্ডিয়ান ব্রডকাস্টিং কোম্পানিতে বোনেদের সঙ্গে একটি অনুষ্ঠান করতেন খুরশিদ। সেখানে বেশ জনপ্রিয়তা পায় 'হোমি সিস্টারস'।

একদিন সেই গানের হাত ধরেই এসে পড়লেন সিনেমার আঙিনায়। তবে রক্ষণশীল পরিবার থেকে সিনেমাজগতে পা রাখার কাজটা মোটেও সহজ ছিল না। বিতর্ক এড়াতে নাম বদলালেন খুরশিদ। ভারতীয় সঙ্গীতজগৎ পেল তার সুরের সরস্বতীকে। একবার থিওসফিক্যাল সোসাইটির এক অনুষ্ঠানে তাঁর গান শুনে মুগ্ধ হলেন বম্বে টকিজের কর্মকর্তা হিমাংশু রাই। হিমাংশুর সঙ্গে সরস্বতীর পরিচয় করিয়ে দিলেন হরিন্দ্রনাথ চট্টোপাধ্যায়। সরস্বতীর সঙ্গীত প্রজ্ঞায় মুগ্ধ হিমাংশু দিন কয়েকের মধ্যেই সিনেমায় গান করার প্রস্তাব নিয়ে হাজির হলেন তাঁর দরজায়। খালি হাতে ফিরতে হল না হিমাংশুকে। বাকিটা ইতিহাস..

তবে সঙ্গীত পরিচালক হিসেবে সরস্বতী দেবীদের কাজটা আজকের সুরকারদের মতো সহজ ছিল না মোটেই। কারণ তাঁদের সুর করা গানে যাঁরা গলা দিয়েছেন, তাঁরা পেশাদার গায়ক-গায়িকা ছিলেন না কেউই। অভিনেতা-অভিনেত্রীদেরকেই গড়েপিটে নিতে হত তাঁকে। সরস্বতী দেবীদের সুরে তাই গান গেয়েছেন অশোক কুমার, দেবীকা রানি বা লীলা চুটনিসের মতো অভিনেতারা। তাঁদের দিয়েই একের পর এক দুর্দান্ত হিট সব গান সফল ভাবে গাইয়ে নিতে পেরেছিলেন সরস্বতী দেবী। 'পড়োসন' ছবির 'এক চতুর নর' গানটি তো সকলেই শুনেছেন। কিশোর কুমার ও মান্না দে-র কণ্ঠে সেই গান যেন কিংবদন্তি। মজার কথা, সেই 'চতুর নর' গানটি কিন্তু 'পড়োসন' ছবিতে রিমেক করা হয়েছিল। আদতে এই গানটির সুরস্রষ্টা ছিলেন সরস্বতী দেবী। ১৯৪১ সালে অশোক কুমার অভিনীত 'ঝুলা' ছবিতে তাঁর কণ্ঠেই প্রথমবার ব্যবহৃত হয়েছিল গানটি। পরে অবশ্য 'পড়োসন' ছবির মাধ্যমেই তা বেশি জনপ্রিয় হয়।

শুধু 'ঝুলা'-ই নয়, এরপর একের পর এক ছবিতে সুর দিয়েছেন সরস্বতী দেবী। জীবন নাইয়া, ঝুমরো, অচ্ছুত কন্যা, জন্ম ভূমি, ইজ্জত, জীবন প্রভাত, প্রেম কাহানি, সাবিত্রী, ভাবী, নির্মলার মতো একাধিক ছবির সঙ্গীত পরিচালনার ভার ছিল তাঁর উপরেই। ভারতীয় ধ্রুপদী সঙ্গীতকে দক্ষতার সঙ্গে ব্যবহার করেছেন তৎকালীন মূলধারার ছবিতে। এরই মধ্যে ১৯৪০ সালে মারা গেলেন বম্বে টকিজের হিমাংশু রাই। ভেঙে গেল বম্বে টকিজ। সে সময় সরস্বতী দেবী কাজ করতে লাগলেন প্রযোজক শশধর মুখোপাধ্যায়ের সঙ্গে। পঞ্চাশের দশকে ফের খ্যাতির আলো এসে পড়ল সরস্বতী দেবীর মুখে। মুখে। হাবিব আলি মহম্মদের সঙ্গে তাঁর গাওয়া গজল দু'টি খুবই জনপ্রিয় হয়েছিল সেসময়।

আরও পড়ুন- ‘সাড়ে চুয়াত্তর’-এর দজ্জাল গিন্নির আড়ালে রয়ে গেলেন দুঃসাহসী মলিনা দেবী

তবে এত প্রতিভা, এত খ্যাতি সত্ত্বেও শেষ জীবনটা কার্যত অবহেলা আর অস্বীকৃতিতে কেটেছিল সরস্বতী দেবীর। বাস থেকে পড়ে কোমরের হাড় ভাঙে তাঁর। দীর্ঘদিন ভর্তি ছিলেন হাসপাতালে। খোঁজ নেয়নি বলিউড। ১৯৮০ সালে মারা যান ভারতীয় সিনেমার প্রথম মহিলা সঙ্গীত পরিচালক। সকলের অগোচরেই 'নেই' হয়ে গিয়েছিলেন অসামান্য এই সঙ্গীত প্রতিভা।

তবে জদ্দানবাইয়ের গল্পটা কিন্তু এমন ছিল না। এলাহাবাদের বাইজি পরিবারের পরম্পরা মেনে 'তওয়াইফ' হয়ে যে জীবন শুরু হয়েছিল, তাকে অন্যমাত্রায় তুলে নিয়ে গিয়েছিলেন তিনি। বাল্যবিধবা দলীপা বহু হাত ঘুরে এসে পৌঁছেছিলেন বারাণসী। সেখানে এসে শুরু হয় বাইজি জীবন। পরে মিয়াজান হুসেনকে বিয়ে করেন দলীপা, জন্মান জদ্দান। মাত্র পাঁচ বছর বয়সে বাবাকে হারানোর পর বাধ্য হয়েই ঢুকতে হয়েছিল 'তওয়াইফ' জীবনে। তবে শুধুমাত্র 'তওয়াইফ' হয়ে থাকতে জন্মাননি জদ্দান। প্রতিভার ডানায় ভর করে একাধিক ক্ষেত্রে খ্যাতি অর্জন করেন তিনি। ছোট থেকেই বড় বড় ওস্তাদের থেকে ধ্রপদী সঙ্গীতের তালিম নেওয়া শুরু করেন জদ্দান। গানের গলাই নয়, কথা বলত পায়ের ঘুঙুরও। অভিনয় করতে করতেই নিজের প্রযোজনা সংস্থা খোলেন জদ্দান। তাঁর হাত ধরেই খুব কম বয়সে অভিনয় জীবনে হাতেখড়ি হয়েছিল মেয়ে নার্গিসের। পরে ছবি পরিচালনার কাজেও হাত পাকান জদ্দান। 

ভারতীয় সিনেমার আঙিনায় সুরনির্মাতা হিসেবে মেয়েদের জন্য সেদিন নতুন এক দরজা খুলে দিয়েছিলেন সরস্বতী দেবী ও জদ্দান বাই। নীতা সেন, অসীমা মুখোপাধ্যায়, বাঁশরী লাহিড়ী, বিজনবালা ঘোষ দস্তিদার, অরুন্ধতী দেবীর মতো বাংলা ছবির সুরকারদের কথা তো কবেই চাপা পড়ে গিয়েছে ইতিহাসের নিচে। আজও ভারতীয় সিনেমার দুনিয়ায় নিঃসন্দেহে মহিলা সুরনির্মাতার অভাব রয়েছে। সঙ্গীত পরিচালনার দায়িত্বে আজও মেয়েদের অংশগ্রহণ হাতে গোনা। কেন, সেই প্রশ্নটা অবশ্যই ভাবায়! তবু জসলিন রয়্যাল, রচিতা অরোরা বা স্নেহা খানউইলকরের মতো যে কটি হাতে গোনা নাম বলিউডে সুর বাঁধার স্বপ্ন দেখতে পারছেন, তাঁদের জন্য রাস্তার কিছুটা পাথর যে একা হাতে সরিয়ে গিয়েছিলেন সরস্বতী দেবী ও জদ্দানবাই, তা না মানলেই নয়।

 

More Articles