কাজের সময়ের সঙ্গে সম্পর্ক নেই দেশের অর্থনৈতিক উন্নতির! আইএলও রিপোর্টে সামনে এল যে সত্য...
70-hour work week at India: দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধোত্তর পর্বে জাপান ও জার্মানের মতো দেশগুলি, তাদের অর্থনীতিকে জাগিয়ে তুলতে এক অদ্ভুত কৌশল নিয়েছিল সে সময়। সেই সময়ে বাসিন্দাদের ৭০ ঘণ্টা করে কাজ করানো হত ওই সব দেশগুলিতে। নারায়ণ...
ভারতীয় কর্মসংস্কৃতি নিয়ে সম্প্রতি ক্ষোভ প্রকাশ করেছিলেন ইনফোসিসের কর্ণধার নারায়ণমূর্তি। ভারতের অগ্রগতির পথে সবচেয়ে বড় বাধা নাকি এ দেশের যুবসম্প্রদায়ের উৎপাদনশীলতা। দিনে বারো ঘণ্টা করে কাজ না করলে নাকি দেশের অর্থনৈতিক প্রগতি কিছুতেই সম্ভব নয়, এমনই দাবি করেছিলেন প্রবীণ এই শিল্পপতি। যা নিয়ে হইচই পড়ে গিয়েছিল গোটা দেশ জুড়ে। সত্যিই কি তাই! ভারতকে বিশ্বের দরবারে পিছিয়ে দিচ্ছে ভারতীয় কর্মীদের তথাকথিত 'আলস্য'। নাকি আসল ছবিটা এর চেয়ে আলাদা?
বিশ্বের প্রায় প্রতিটি কোণায় ছড়িয়ে রয়েছে ভারতীয়েরা। বিশেষত কর্মসূত্রে তো বটেই, বিশ্বের প্রায় প্রতিটি দেশেই প্রবাসী ভারতীয়ের সংখ্যা কম নয়। হিসেব বলছে, সব চেয়ে বেশি গ্লোবালি কাজ করার হিসেবে সপ্তম স্থানে রয়েছে ভারত। ২০১৮ সালের লেবার অর্গানাইজেশন (আইএলও) রিপোর্ট অনুযায়ী, কাজের সময়ের হিসেবে কাতার, কঙ্গো, লেসোথো, ভুটান, গাম্বিয়া ও সংযুক্ত আরব আমিরশাহী এগিয়ে রয়েছে ভারতের থেকে।
সম্প্রতি নারায়ণমূর্তি একটা সাক্ষাৎকারে জানান, ভারতীয় যুবসম্প্রদায়ের উচিৎ সপ্তাহে অন্তত ৭০ ঘণ্টা করে কাজ করা। আর তাতেই দেশ অর্থনৈতিক ভাবে এগোবে। কিন্তু লেবার অর্গানাইজেশনের ওই রিপোর্ট বলছে অন্য কথা। দেশের অর্থনীতি নির্ভর করে সে দেশের জিডিপির উপরে। কিন্তু রিপোর্টে দেখা যাচ্ছে, যেসব দেশে কাজের সময় কম, সে দেশের মাথাপিছু জিডিপি বেশি। দেশের যে দশটি দেশের অর্থনীতি সবচেয়ে উপর দিকে, তার মধ্যে ভারতে সাপ্তাহিক কাজের সময় সবচেয়ে বেশি। আর সেখানেই জিডিপি সবচেয়ে কম। ধরা যাক ফ্রান্স। প্রথম বিশ্বের এই দেশে কাজের সময় সবচেয়ে কম। ফ্রান্সের বাসিন্দারা সপ্তাহে ৩০.১ ঘণ্টা করে কাজ করেন। আর সেই দেশের মাথাপিছু জিডিপির সর্বোচ্চ পরিমাণ ৫৫,৪৯৩ ডলার। যা অর্থনৈতিক ভাবে এগিয়ে থাকার অন্যতম শর্ত বলে মনে করা হয়।
আরও পড়ুন: ৭০ ঘণ্টা কাজের দাবি সত্যিই ন্যায্য? কতক্ষণ কাজ করেন এলন মাস্ক, সুন্দর পিচাইরা?
নারায়ণ মূর্তি উল্লেখ করেছিলেন, দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধোত্তর পর্বে জাপান ও জার্মানের মতো দেশগুলি, তাদের অর্থনীতিকে জাগিয়ে তুলতে এক অদ্ভুত কৌশল নিয়েছিল সে সময়। সেই সময়ে বাসিন্দাদের ৭০ ঘণ্টা করে কাজ করানো হত ওই সব দেশগুলিতে। নারায়ণ মূর্তিও সেই কৌশলের কথাই বলেছেন। বহু শিল্পপতিই সেই ধারণাকে সমর্থন করেছেন। জেএসডব্লিউয়ের চেয়ারম্যান সজ্জন জিন্দল মনে করেন, কম সময় কাজের অভ্যাস আয়ত্ত করা একেবারেই উচিত নয় এ দেশে। টেক মাহিন্দ্রা সংস্থার এমডি ও সিইও গুরনানি একমত হয়েছেন নারায়ণমূর্তির সঙ্গে। তাঁর মতে, নারায়ণমূর্তি শুধু সংস্থার জন্য খাটার কথা বলেননি, নিজেকে কর্মক্ষেত্রে সেরা প্রমাণ করার জন্য নিজের উপরেও কাজ করা দরকার। তাই সংস্থায় যদি ৭০ শতাংশ সময় দেন, তাহলে নিজের উপর কাজ করার জন্য ৩০ শতাংশ সময় দেওয়া প্রয়োজন।
যদিও নারায়ণমূর্তির মতামতের সঙ্গে একমত হতে পারেননি অনেকেই। অনেকেই মনে করেছেন, অতিরিক্ত সময়ে কাজ করতে করতে একসময় কাজের মান পড়তে শুরু করবে, আর সেটা কখনও কোনও সংস্থা বা দেশের জন্য ভালো কথা নয়। আর যে কোনও মানুষের নিজের জন্যও সময় প্রয়োজন বলেও মনে করেছেন অনেকে। ইনফোসিসের প্রাক্তন সিইও মোহনদাস পাই নারায়ণমূর্তিতে সমর্থন করলেও তিনি যে কথা বলেছেন, তা তিরিশের নিচে যাদের বয়স, তাদের ক্ষেত্রে প্রযোজ্য। সপ্তাহে সত্তর ঘণ্টা কাজের সময়ের ব্যাপারে আপত্তি জানিয়েছেন তরুণ অনেক শিল্পপতি। শার্ক ট্যাঙ্ক ইন্ডিয়া খ্যাত এমকিওর ফার্মাসিউটিক্যালসের এগজিকিউটিভ ডিরেক্টর নমিতা থাপরের মতে, এই ধরনের কর্মসংস্কৃতি একজন কর্মীর পরিবার ও তাঁর মানসিক স্বাস্থ্যের পক্ষে ক্ষতিকর।
Halloween shananigans are always fun, kiddos & me made these goodies,@AnupamMittal if we listen to you & other experts about working 70 hour/ week (plus horrendous commute time) will we ever find time for family, creating precious memories & most importantly for mental health ?🙄 pic.twitter.com/0NIkrfII2f
— Namita (@namitathapar) October 31, 2023
ছোট্ট স্টার্ট আপ থেকে বড় বাণিজ্যিক সাফল্যের মুখ দেখেছে মিনত্রা ও কিওরফিটের মতো সংস্থা। ওই দুটি সংস্থার মালিক মুকেশ বনসল জানান, এটা ব্যক্তিগত পছন্দের ব্যপার। তবে কাজের পাশাপাশি স্বাস্থ্য, পরিবার এবং মানসিক শান্তি, সবটাই জরুরি। গুরুত্ব অনুযায়ী জীবনের লক্ষ্য স্থির করা জরুরি বলেই মনে করেন তিনি। পাশাপাশি তিনি এ-ও মনে করিয়ে দেন, যে সব সংস্থা কর্মীদের কাছ থেকে সপ্তাহে ৭০ ঘণ্টা করে কাজের দাবি করেছে ৪০ ঘণ্টার বেতনে, তা কিন্তু নীতিবিরুদ্ধ ও অন্যায়।
আরও পড়ুন:কেন এত কাজ পাগল আমরা!
সব মিলিয়ে ৭০ ঘণ্টা কাজের প্রসঙ্গে রীতিমতো দ্বিধাবিভক্ত শিল্পপতিমহল। বিভিন্ন সংস্থার কর্মীদের মধ্যেও ক্ষোভের ঝড়। এমনিও বহু সংস্থাতেই ওয়ার্কিং আওয়ারস আসলে একটা মিথের মতো। একজন কর্মী আট- ন'ঘণ্টা কাজের জন্য বহাল হলেও তার ওয়ার্কিং আওয়ারস যে কখন বারো-তেরো ঘণ্টার কোঠা পার করে যায়, তা সে নিজেই বুঝতে পারে না। পরিবারের সময়ে হাত পড়ে। নিজের ব্যক্তিগত মুহূর্তে এসে কড়া নাড়তে থাকে অফিস। মানসিক শান্তি এবং স্বস্তি তো এমনিতেই শিকেয়। এই পরিস্থিতিতে নারায়ণমূর্তির এমন মন্তব্য যে কর্মীদের সেই ক্ষোভের আঁচকেই আরও খানিকটা উস্কে দিয়েছে, তা বলাই বাহুল্য।