দিল্লি বিস্ফোরণ: সন্দেহভাজনদের থেকে পাওয়া রেড়ির বীজেই লুকিয়ে প্রাণঘাতী জৈব মারণাস্ত্র?
Ricin Poison: এটি শরীরে ঢুকলে শ্বাসযন্ত্র, পাকস্থলী ও লিভার মারাত্মক ভাবে ক্ষতিগ্রস্ত হয়। বিষ প্রয়োগের কয়েক ঘণ্টার মধ্যেই জ্বর, কাশি, বুকে ব্যথা, বমি বমি ভাব ও শ্বাসকষ্ট শুরু হয়।
সম্প্রতি, গুজরাট পুলিশের অপরাধ দমন বিভাগ, এ টি এস দিল্লি বিস্ফোরণের তিনজন সন্দেহভাজনকে গ্রেফতার করে, যাদের মধ্যে একজনের কাছে মেলে ৪ কেজি রেড়ির বীজ, যেটি রাইসিন নামক প্রাণঘাতী মারণাস্ত্রের উৎস। এটি, বর্তমান বিশ্বের অন্যতম একটি প্রাণঘাতী জৈব রাসায়নিক হিসেবে পরিচিত।
কী এই রাইসিন?
এটি একটি মারাত্মক জৈব বিষ, যার কোনো রঙ বা গন্ধ নেই; সামান্য কয়েক দানা আমাদের শরীরে কোনোভাবে প্রবেশ করলেই ৩৬ থেকে ৭২ ঘণ্টার মধ্যে মৃত্যু নিশ্চিত। সাধারণত, ক্যাস্টর বা রেড়ির বীজ থেকে তেল নিষ্কাশনের পর যে অবশেষ পড়ে থাকে, তাতে পাওয়া যায় রাইসিন; যার একটি অণুতে দু'টি প্রোটিন শৃঙ্খল, ডাইসালফাইড বন্ধনের সাহায্যে সংযুক্ত থাকে: একটি A-শৃঙ্খল (RT-A), অপরটি B-শৃঙ্খল (RT-B)। প্রথমটির জন্য রাইসিন বিষাক্ত হয়।
রেড়ির বীজ থেকে তেল বের করার সময় চাপ ও তাপ দেওয়া হয়; রাইসিন খুব বেশি তাপ সহ্য করতে পারে না, প্রায় ৮০–৯০°C তাপমাত্রায় ভেঙে গিয়ে তেল (অর্থাৎ লিপিড অংশ) আলাদা হয়ে যায়, আর প্রোটিন নষ্ট হয়ে বীজের অবশিষ্ট অংশে থেকে যায়।
আরও পড়ুন
কেউ রিকশাচালক, কেউ ট্যাক্সি ড্রাইভার, দিল্লি বিস্ফোরণের নিহতদের সম্পর্কে যা জানা যাচ্ছে
ছোটবেলায় দাদুর মুখে শুনেছি, গ্রামে যখন বিদ্যুৎ আসেনি, তখন রেড়ির তেল (আমাদের এলাকায়, ভেন্নার তেল হিসেবে পরিচিত) ব্যবহার করে আলো জ্বালাতেন মানুষজন, অন্যান্য তেলের চেয়ে ঘন হওয়ায় অনেক্ষণ ধরে জ্বলত। পেট খারাপেও তখনকার চিকিৎসকরা পরামর্শ দিতেন ফিল্টার করা রেড়ির তেল বা ক্যাস্টর অয়েল খেতে; এমনকি আরও আগে, গরুর গাড়ির লুব্রিক্যান্ট হিসেবে ব্যবহার করা হত এই তেল। সেই বীজেই কিনা লুকিয়ে আছে সাঙ্ঘাতিক জৈব মারণাস্ত্র!
১৮৮৮ সালে জার্মান বিজ্ঞানী, পিটার হারম্যান স্টিলমার্ক প্রথম রাইসিনকে আলাদা করেন। এটি এতই বিষাক্ত যে স্তন্যপায়ী প্রাণীর শরীরে ঢুকে প্রোটিন উৎপাদন বন্ধ করে দেয়, যার ফলে কোষের মৃত্যু ঘটায়। একটি রাইসিনের অণু প্রতি মিনিটে হাজার হাজার রাইবোসোমকে নিষ্ক্রিয় করতে পারে, যার অর্থ এর খুব কম পরিমাণই (মাত্র ৫ মিলিগ্রাম) মানুষের মৃত্যুর জন্য যথেষ্ট।
কতটা বিষাক্ত এই রাইসিন?
এটি শরীরে ঢুকলে শ্বাসযন্ত্র, পাকস্থলী ও লিভার মারাত্মক ভাবে ক্ষতিগ্রস্ত হয়। বিষ প্রয়োগের কয়েক ঘণ্টার মধ্যেই জ্বর, কাশি, বুকে ব্যথা, বমি বমি ভাব ও শ্বাসকষ্ট শুরু হয়। ফুসফুসে জল জমতে পারে, এবং পর্যাপ্ত চিকিৎসা না হলে মৃত্যু ঘটতে পারে। এই সময় কিছু খেলে বা পান করলে শুরু হয় প্রবল বমি, ডায়রিয়া সাথে রক্তক্ষরণ। ফলে শরীর মারাত্মক ভাবে জলশূন্য হয়ে যায় এবং বিপজ্জনকভাবে রক্তচাপও কমতে থাকে। অন্যান্য উপসর্গের মধ্যে হ্যালুসিনেশন, খিঁচুনি এবং প্রস্রাবে রক্ত, ইত্যাদি ভুক্তভোগীকে মৃত্যুর দোরগোড়ায় পৌঁছে দেয়। ফলে অচিরেই মাল্টি অরগান ফেলিওর হতে পারে। কোনোভাবে বেশি পরিমাণে এই বিষ শরীরে প্রবেশ করলে রক্তবমি শুরু হয়। সবচেয়ে দুর্ভাগ্যজনক যে এর কোনো প্রতিষেধক এখনও বাজারে আসেনি। সেজন্য, মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রর সেন্টার ফর ডিজিজ কন্ট্রোল (CDC) এটিকে গ্রেড বি ক্যাটাগরির জৈব অস্ত্র হিসাবে ঘোষণা করেছে।
আরও পড়ুন
দিল্লি সন্ত্রান্সের নেপথ্যে মেডিক্যাল মডিউল! যেভাবে গড়ে উঠেছিল
এই অস্ত্রের ব্যবহার নতুন নয়; ১৯৭৮ সালে লন্ডনে, বুলগেরিয়ান লেখক ও সরকার বিরোধী কর্মী জর্জি মার্কভ-কে রাইসিন প্রয়োগ করা হয়। তিনি তখন BBC world-এ কর্মরত। ততদিনে, 'At Every Milestone' নামক নাটক লিখে বেশ নামডাক হয়েছে তাঁর। ওয়াটার্লু ব্রীজের সামনে বাস স্টপে দাঁড়িয়ে আছেন বাস ধরবেন বলে। আচমকা অনুভব করলেন তাঁর হাঁটুর পেছনে কিছু একটা ফুটিয়ে পালিয়েছেন এক আগন্তুক। কর্মক্ষেত্রে ফিরে অসুস্থ হয়ে পড়েন; সহকর্মীরা সেন্ট জেমস হসপিটালে ভর্তি করলেও শেষ রক্ষা হয়নি। চার দিনের মাথায় মারা যান তিনি। রোগের লক্ষণ প্রকাশ্যে আসলে ময়না তদন্তের নির্দেশ দেওয়া হয়, সেসময় ক্ষতস্থান থেকে ধাতব পেলেট উদ্ধার হয়, যেগুলো পরবর্তীতে পরীক্ষার জন্য পাঠানো হয় ফরেন্সিক ল্যাবরেটরিতে, সেখানকার বিষ বিভাগের বিশেষজ্ঞরা পেলেট গুলো পরীক্ষা করে দেখেন রাইসিনের কারণে মৃত্যু হয়েছে মার্কভের।
তারপর থেকে পৃথিবীর বিভিন্ন প্রান্তে, গুরুত্বপূর্ণ ব্যাক্তিদের উপর রাইসিন ব্যবহারের নজির সামনে আসে। এমনকি, ২০২০ সালে, তদানীন্তন মার্কিন প্রেসিডেন্ট ডোনাল্ড ট্রাম্প-কে এই বিষ মিশ্রিত চিঠি পাঠানোর চেষ্টা হয়, কিন্তু আততায়ী সফল হয়নি। এর আগে, বারাক ওবামা ও অন্যান্য কয়েকজন মার্কিন কর্মকর্তাকে রাইসিনের গুড়ো মেশানো চিঠি পাঠানোর দায়ে ২০১৪ সালে মিসিসিপির এক ব্যক্তিকে ২৫ বছরের কারাদণ্ড দেওয়া হয়।
প্রথম বিশ্বযুদ্ধকে বলা হয় রসায়নের যুদ্ধ; বিপুল পরিমাণ রাসায়নিক অস্ত্র (ক্লোরিন, ফসজিন , ইত্যাদি) প্রয়োগ করা হয় সেই সময়ে। সেই ভাবে দেখতে গেলে, দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধে বলা হয় পদার্থবিদ্যার যুদ্ধ; কাজে লাগানো হয় নিউক্লিয়ার শক্তি। এরপর বিজ্ঞানের বিবর্তনে অনেক আধুনিক অস্ত্র দেখছে বিশ্ববাসী। সেই সবের সাহায্যে বিভিন্ন জায়গায় সন্ত্রাস ছড়িয়েছে অনেক উগ্রবাদী সংগঠন। কিন্তু জৈব মারণাস্ত্রের এরকম সঙ্ঘবদ্ধ পরিকল্পনা এর আগে বিশেষ দেখা যায়নি। প্রশাসনিক উদ্যোগে এই সব জৈব রাসায়নিক পদার্থের উৎপাদন ও বিপণন নিষিদ্ধ না করতে পারলে এর আশঙ্কা থেকে মুক্তি পাওয়া সম্ভব নয়।

Whatsapp
