এমন প্রেমিক আজও আছে! যেভাবে ভালবাসার আদর্শ হয়ে উঠলেন পর্দার 'বামাখ্যাপা' সব্যসাচী
Oindrila-Sabyasachi: আজ ঠিক যতটা ভালো অভিনেতা হিসেবে সব্যসাচীর নাম উচ্চারিত হয়, ঠিক তার সঙ্গেই সাধারণ মানুষের মধ্যে সার্থক প্রেমিক হিসেবেও বারবার উল্লেখিত হন তিনিই!
'রং-বেরঙের আলখেল্লা পরিহিতা বিগবসের সঙ্গে...' সম্প্রতি সোশ্যাল মিডিয়ায় নিজের প্রোফাইলের ছবি বদলে ঐন্দ্রিলাকে সম্বোধন করেছিলেন এইভাবেই। প্রতি মুহূর্তে সোশ্যাল শুধু নয়, ব্যক্তিগত জীবনেও বুঝিয়ে দিচ্ছিলেন তিনি অসম্পূর্ণ ওঁকে ছাড়া! জনমানসে জনপ্রিয় 'বামাক্ষ্যাপা'-র অভিনয় ঠিক যতটা সমাদৃত, বঙ্গের আলোচনার ছত্রে ছত্রে তার তুলনায় সব্যসাচীর প্রেমিকসত্তা অনেক বেশি বিরচিত। তিনি যে একজন অভিনেতার সঙ্গেই অভিনেত্রী ঐন্দ্রিলা শর্মার লড়াইয়ের সঙ্গী, যোগ্য প্রেমিক। সঠিক ভালবাসার মানুষ, এই তত্ত্বেই আদতে সর্বাধিক মশগুল বঙ্গের জনতা। তাই আজ ঠিক যতটা ভালো অভিনেতা হিসেবে সব্যসাচীর নাম উচ্চারিত হয়, ঠিক তার সঙ্গেই সাধারণ মানুষের মধ্যে সার্থক প্রেমিক হিসেবেও বারবার উল্লেখিত হন তিনিই!
লায়লা-মজনু, শাহাজান-মমতাজ অথবা ওথেলো-দেসদিমোনার মতো হয়তো নয়, কিন্তু এই প্রেমের শিরায় শিরায় লুকিয়ে যা রয়েছে, তা তাদের থেকে কোনও অংশেই কম নয় বলেই মনে করেন অনেকেই।
আর সেই প্রেমই ফের উচ্চারিত। প্রত্যেকমুহূর্তে বেসরকারি হাসপাতালের বেডে জীবনযুদ্ধে মহীয়ান ঐন্দ্রিলা প্রসঙ্গে ফের জর্জরিত সব্যসাচীর অমোঘ অবদানও। তা ঠিক কতটা পাইয়ে দেওয়া বা করার জন্য করা, তা নিয়ে অনবরত প্রশ্ন উঠলেও সব্যসাচী যে সঙ্গীর সুখ-দুঃখের, লড়াইয়ের দিনে পাশে থাকার উৎকৃষ্ট উদাহরণ, বিপদের দিনে সঠিক সাহচর্য। তা-ও বলছেন কেউ কেউ।
আরও পড়ুন: প্রেমের সঙ্গে বাজি লড়ে আগেও হেরেছে মৃত্যু, বাংলা জানে এবারেও জিতে ফিরবেন ঐন্দ্রিলা
কে এই সব্যসাচী চৌধুরী
হাওড়ার বেলুড় মঠ এলাকার বনেদী পরিবারের সন্তান সব্যসাচী। বরাবর প্রতিপত্তিশালী চৌধুরীদের পুত্র পড়াশুনায় ছিলেন মেধাবী। বিদেশে উচ্চশিক্ষা। ইংল্যান্ডের নামকরা শিক্ষা প্রতিষ্ঠান অক্সফোর্ড ব্রুক্স থেকে ডার্ক ট্যুরিজমে স্নাতকোত্তর। পড়া শেষ করে ইংল্যান্ডেই প্রশিক্ষণ। কাজ শুরু। কিন্তু কে শোনে কার কথা! জীবনকে প্রতিষ্ঠানের বাইরে নতুন করে দেখার তাগিদে, কিছুদিন ইংল্যান্ডে অভিজ্ঞতা অর্জন করে ফিরলেন দেশে। বারণ করলেন পরিবারের অনেকেই। কিন্তু সব্যসাচী চলে এলেন নিজের দেশে।
অভিনয়ে হাতেখড়ি
থিয়েটারের সংক্ষিপ্ত-পর্ব কাটিয়ে বরাবর মৌলিক প্রতিভার বশে, সব্যসাচী পা দিলেন অভিনয় জগতে। 'এসো মা লক্ষ্মী' ধারাবাহিকে অপেক্ষাকৃত কম গুরুত্বের চরিত্রে অভিনয় দিয়ে শুরু হল পুরোদমে কাজ। সেইভাবে আর কেরিয়ারের জন্য পিছনে ফিরে তাকাতে হয়নি তাঁকে। কেরিয়ার গ্রাফে তখন তীব্র লড়াই চললেও স্বপ্নের মায়াজালে সব্যসাচী ছিলেন বিভোর। এলো একের পর এই সুযোগ। 'অগ্নিজল' ধারাবাহিকে অভিনয়। বড় সুযোগ পেলেন 'ভক্তের ভগবান শ্রীকৃষ্ণ' ধারাবাহিকে। সেখানে যুধিষ্ঠির চরিত্রে অভিনয়ের মাধ্যমে জনপ্রিয় হলেন আর এক কৃষ্ণ সব্যসাচী। এরপর ২০১৭ সাল নাগাদ 'ঝুমুর' ধারাবাহিক। যা সব্যসাচীর পরিচয়ে আগমন ঘটালো প্রেমিক সত্তার। বরাবর ঈশ্বর সংক্রান্ত ধারাবাহিকের অভিনয়-খোলস ছাড়িয়ে সব্যসাচী হয়ে উঠলেন অনন্য। অনবদ্য। সঙ্গে তখন নবীন অভিনেত্রী, বন্ধু ঐন্দ্রিলা। এরপর 'ওম নমঃ শিবায়' ধারাবাহিকে বিষ্ণুর চরিত্র। 'জড়োয়ার ঝুমকো'য় অর্ণবের ভূমিকায় অভিনয় করতে করতেই এল বড় সুযোগ। 'সাত ভাই চম্পা'য় পেলেন রাজা নক্ষত্রজ্যোতির চরিত্রে অভিনয়ের প্রস্তাব। তারপর সব্যসাচীর অভিনয়-জীবনে ঝড় আনল' মহাপীঠ তারাপীঠ' (Mahapeeth Tarapeeth) ধারাবাহিক। দীর্ঘদিন চলা এই পর্বে বামাক্ষ্যাপার (Bamakshyapa) চরিত্রে দাগ কাটলেন সব্যসাচী। হাওড়ার মেধাবী ছেলেটির অভিনয় মেধা দেখল রাজ্য। ঘরে ঘরে আলোচিত হল বামার নাম। ঈশ্বর, ভক্তি আর বামাচরণ চক্রবর্তীর ভূমিকায় অনবদ্য অভিনয় তাক লাগাল বারবার। অতি জনপ্রিয় হলেন সব্যসাচী চৌধুরী। তারপর একাধিক ওয়েবসিরিজ, বিজ্ঞাপন, শর্ট ফিল্ম-এ অভিনয় ইন্ডাস্ট্রিতে কদর বাড়িয়েছে তাঁরও। সম্প্রতি বন্ধু ঐন্দ্রিলার সঙ্গেই 'ভাগাড়' ওয়েবসিরিজে তাঁর অভিনয় নজর কেড়েছে ফের।
প্রেমিক সব্যসাচী
২০১৭ সালে বহরমপুর থেকে আসা ২০ বছরের নবীন অভিনেত্রী যে মেয়েটির হাত ধরেছিলেন তিনি। যে 'ঝুমুর' ধারাবাহিকে হওয়া পরিচয়ে প্রেমের গাঁটছড়া বেঁধেছিলেন সব্যসাচী, তার বিচ্ছেদ ঘটেনি আজও। প্রেমিকা ঐন্দ্রিলার জীবন বদলে দেওয়ার কারিগর হিসেবে বারবার উঠে এসেছে তাঁর নাম। আজ যে সব্যসাচী রাতের পর রাত জাগছেন হাসপাতালের করিডরে। এই সব্যসাচীকেই দেখা গিয়েছিল ঐন্দ্রিলা দ্বিতীয়বার ক্যানসার-আক্রান্ত হলে তাঁর সঙ্গে থাকতে। যে কর্তব্য তিনি তাঁর দায়বদ্ধতা থেকে করেছেন! সাধারণভাবে এই প্রশ্ন উঠলেও আসলে প্রেমিক সব্যসাচীর এই ভূমিকা নাড়িয়ে দিয়েছিল বিচ্ছেদ-মিলনের দোলাচলে দুলতে থাকা বিশ্বকে।
ঠিক কী করেছিলেন তিনি? অনেকেই বলেন, প্রেমিক হিসেবে, প্রেমের জন্য, সম্পর্কের জন্য, প্রিয় মানুষের জন্য যা যা প্রয়োজন, বিনা স্বার্থে যেটুকু করা প্রয়োজন সকলের, তার চেয়ে অনেক বেশি করেছেন তিনি! কেন? ঐন্দ্রিলার ভেঙে পড়ার মুহূর্তে ভরসা জুগিয়েছেন, পাশে থেকেছেন সব্যসাচী। যা প্রিয়ের জন্য সর্বাধিক দরকার শুধু নয়, কাছের মানুষের বিপদের সময় সবচেয়ে বেশি প্রয়োজনও। আর সেই মৌলিক চিত্রই দেখেছে এই দেশ। নেটমাধ্যমে ভাইরাল হয়েছেন তাঁরা। যা তাঁদের কাছে ব্যক্তিগত, অতি সাধারণ, তাই-ই যেন দূরত্বের পৃথিবীতে হয়ে উঠেছে বিরল। সব্যসাচীময় হয়েছেন ঐন্দ্রিলা। আর জীবনের 'বিগবস' ঐন্দ্রিলা জড়িয়েছেন সব্যসাচীকে।
'অন্য' সব্যসাচী
'দৃষ্টি একই থাকে, দৃষ্টিকোণ বদলায় বারবার।' মৌলিক অভিনেতা সব্যসাচীর লেখক-সত্তার প্রথম নিদর্শনের ভূমিকায় উঠে এসেছিল এই বাক্যই। ২০২২-এর ২৮ ফেব্রুয়ারি, কলকাতা আন্তর্জাতিক বইমেলায় তাঁর হাত ধরে বার্তা প্রকাশনের তরফে প্রকাশ পায় তাঁর লেখা প্রথম বই 'দলছুটের কলম'। সব্যসাচী বলেছিলেন, ''বরাবর ফেসবুকে লিখতাম। নিজের কথা বলতাম। অনেকেই বলতেন বই হিসেবে প্রকাশের। অবশেষে ইচ্ছাপূরণ। বই বেরোলো।'' যে বই লেখার রসদ ছিলেন প্রেমিকা ঐন্দ্রিলাও। যিনি বই পড়তে খুব একটা ভালো না বাসলেও সব্যসাচীর বই লেখার তাগিদ, উপকরণে তাঁর ভূমিকা ছিল সর্বাধিক। এই বই মূলত, বিভিন্ন সময়ের অনুভূতির কথার সমষ্টি। 'বামাক্ষ্যাপা'র টেলিভিশনপর্ব শেষ হতেই বই লেখার কাজ শেষ করেন সব্যসাচী। বইমেলায় প্রকাশিত তাঁর প্রথম বই। যা সমাদৃত হয় পাঠক মহলে।
'ব্যবসায়ী' সব্যসাচী
চলতি বছরেই বন্ধু, জনপ্রিয় অভিনেতা 'মন্টু পাইলটে'র সঙ্গে হাত মেলান 'বামা'। সৌরভ দাসের সঙ্গে মিলে সল্টলেকের সেক্টর একে খোলেন একটি রেস্তোরাঁ। 'হোদোলস্' নামের ওই রেস্তোরাঁর মাধ্যমে সব্যসাচী শুরু করেন নতুন কাজ।
অভিনয়ে সাফল্য। লেখক হিসেবে পরিচিতি। নতুন উদ্যোগে প্রতিষ্ঠা পাওয়ার মধ্যেই, আবার ঘুরে দাঁড়ানোর চেষ্টার মধ্যেই ফের বিপর্যয়। একদিন আগেই (৩১ অক্টোবর) নিজের জন্মদিনে যে প্রিয় মানুষটির কাছ থেকে শুনেছিলেন 'বেঁচে টাকার কারণ তিনি', সেই ঐন্দ্রিলা আজ ফের শয্যাশায়ী। ১ নভেম্বর থেকে নতুন লড়াই লড়ছেন তিনি। যে প্রেমিকার জন্য একদিন নাওয়া-খাওয়া ছেড়ে, ধারাবাহিকের মায়া ত্যাগ করে দিনরাত পড়ে থাকতেন সব্যসাচী, আজ আবার সেই তাঁর জন্যই রাতের পর রাত জাগছেন তিনি।
প্রিয় মানুষের জন্য হয়তো এটাই করণীয়! হয়তো সব্যসাচীর মায়ার জালে বন্দি ঐন্দ্রিলার এইটুকুই প্রাপ্য! কিন্তু সকলেই কি পারেন? সকলেই কি প্রিয়জনের জন্য এভাবে ত্যাগের মুখোমুখি হয়েও মাঝ সমুদ্রের হাবুডুবু খাওয়া নৌকাকে বারবার পাড়ে ফেরানোর চেষ্টায় ব্রতী হন? সব্যসাচী-ঐন্দ্রিলা পর্বে প্রশ্ন ওঠে নিরন্তর! কিন্তু উত্তর তো একটাই, সব্যসাচী চৌধুরী!