স্বধর্ম পালনের স্বাধীনতা বাংলাদেশে পুরোপুরি বিলোপ হয়ে যায়নি

Communal harmony: বিশেষ আনন্দ পেলাম হিন্দু বন্ধুদের কাছ থেকে এই কথা জেনে যে, এই বছর পূজো নির্বিঘ্নে, শান্তিপূর্ণভাবে, হয়ত বা (নিরাপত্তা বোধের দরুনই হতে পারে) একটু বেশি ঘটা করেই পালিত হয়েছে।

SC

২০২৫ সালে দুর্গাপুজোর কয়েকদিন ইউটিউবে দেখলাম, ঢাকা ও বাংলাদেশের নানান জায়গায় খুব আড়ম্বর ও উৎসাহের সঙ্গে দুর্গাপুজো পালিত হল। জনসমাগম দেখে আশ্চর্য হলাম, যেমন হয়েছিলাম, দু’বছর আগে ২০২৩ সালে ঢাকায় দুর্গোৎসবে মানুষের স্বতঃস্ফূর্ত যোগদান দেখে। কিন্তু সেই সঙ্গেই মনে ভেসে উঠল ঠিক একবছর আগের, অর্থাৎ ২০২৪ সালে বাংলাদেশের দুর্গাপুজোর কথা, যাকে ঘিরে ভারতের মূলধারার সংবাদমাধ্যমে লাগাতার সাম্প্রদায়িক বিষ ছড়িয়ে, প্রচার করা হচ্ছিল হিন্দু-নিধন যজ্ঞের ভুয়ো খবর। আজ তাই এক বছর আগেকার ঘটনাগুলির দিকে নজর ফেরাচ্ছি কারণ তা অপ্রাসঙ্গিক হবে না।

২০২৪ সালের জুন মাসে বাংলাদেশে বৈষম্য বিরোধী গণ-আন্দোলন যখন শুরু হয়, তখন আমি বিদেশে, ইরানে। এ’ যাত্রায় একমাস ছিলাম সেই দেশে কিন্তু বন্ধুদের সঙ্গে মেলামেশায় এমন ব্যস্ত ছিলাম যে বাংলাদেশের খবরের দিকে নজর দিতে পারিনি। বিষয়টা চোখে পড়ল ১ জুলাই, ২০২৪ তারিখে। তখনো আমি ইরানে, সিরাজে। দেশে ফিরলাম ১৭ জুলাই। তারপর ঘটনাপ্রবাহ এমন দ্রুত গতিতে চলতে লাগল যে নিজেই আশ্চর্য বোধ করলাম। ১ আগস্ট তারিখে মনে হল যে হাসিনা সরকারের ভবিষ্যৎ টলোমলো, তবে মনে করেছিলাম যে, বিচক্ষণ রাজনীতিবিদ তিনি, সমঝোতার মাধ্যমে অবস্থাটা সামলে নেবেন। কিন্তু শীঘ্রই বুঝলাম, আমার অনুমান ভুল। শুধু হাসিনা বিরোধিতা নয়, সেই সঙ্গে মিশেছে সম্মিলিত জনতার পুঞ্জিভূত ঘৃণা ও ক্রোধ। তাঁর সঙ্গে সমঝোতা করার প্রবৃত্তিও আর কারো মধ্যে অবশিষ্ট নেই। জনতা মাথা হেঁট করবে না।

ওই ১৭ জুলাই থেকে পাঁচই অগাস্ট অবধি, প্রতি ঘন্টায় ইউটিউব চ্যানেলের মাধ্যমে বাংলাদেশের খবর নিচ্ছিলাম। সেখানকার বন্ধুদের সঙ্গেও কথা বলতাম। তারপর একদিন ইন্টারনেট ও টেলিফোন সংযোগ বিচ্ছিন্ন হল। ৫ অগস্ট চ্যানেলগুলির মাধ্যমে এইটুকু বুঝলাম, ঢাকার রাজপথ জনশূন্য। সেনাবাহিনী টহল দিয়ে বেড়াচ্ছে, অবস্থা থমথমে। কয়েকদিন আগেই দেখেছি যে সেনাবাহিনীর অবসরপ্রাপ্ত অফিসাররাও জন-আন্দোলনে শামিল হয়েছেন। আমার মনে নানা আশঙ্কা কাজ করছিল, শেষ পর্যন্ত এই জন-আন্দোলন সামরিক অভ্যুত্থানের দিকে যাবে না তো! শেষ পর্যন্ত ঢাকার এই থমথমে পরিস্থিতি যে শেষে গণ-অভ্যুত্থানের রূপ নেবে, সেটা ক’জনই বা আগে থেকে বুঝেছে?

আরও পড়ুন

২৬ বছর পর বাংলাদেশে ফিরছেন তারেক রহমান! ক্ষমতার কুর্সি অপেক্ষমান?

২০২৪ এর ৫ অগাস্ট তারিখে বেলা আড়াইটে নাগাদ আমার বিশেষ বন্ধু, শ্রীমৃণালকান্তি রায়ের ফোন পেলাম, “খবর পেয়েছেন? শেখ হাসিনা তো দেশ ছেড়ে পালিয়েছেন। কোথায়, সেটা জানি না।” তারপরের ঘটনা তো আমরা দেখেছি। বাংলাদেশের বন্ধুদের সঙ্গে যোগাযোগ করতে পারলাম তার পরদিন। কিন্তু তার আগেই ভারতের বন্ধুরা বলতে শুরু করেছেন, “দেশটা এবার পাকিস্তান-আফগানিস্তান হয়ে যাবে। জামাত-বিএনপির হাতে ক্ষমতা গেছে।”

আমার বন্ধু, বাংলাদেশের কমিউনিস্ট পার্টির (CPB) দীর্ঘদিনের নেতা ও কর্মী (আমার চোখে মুক্তিযোদ্ধা, যদিও তিনি সেই দাবি করেন না) বললেন,

“দাদা, এত বড় গণ-অভ্যুত্থানের পর দেশ কোন দিকে যাবে কেউ বলতে পারে না। জামাত ও বিএনপি খুবই আস্ফালন করছে, মনে হবে তারাই যেন ক্ষমতা দখল করেছে। কিন্তু মানুষের সঙ্গে রাস্তায় তো আমরাও ছিলাম। আমরা ছোট পার্টি, শক্তি কম। আমরা বড় কোনো কৃতিত্বের দাবি করব না। সংগ্রাম এখন অন্য স্তরে পৌঁছে গেছে, দেখা যাক কে কেমন ভাবে লড়ে। কে কতদুর এগোয়।”

তারপর কথা বলেছিলাম, বাংলাদেশের নারী আন্দোলনের এক নেত্রীর সঙ্গে, যিনি ওই গণ আন্দোলনে অংশ নিয়েছিলেন। তিনি বললেন, “দাদা, আমাদের দুই শত্রু, আওয়ামি লীগের গুন্ডাবাহিনী আর মৌলবাদীরা। আওয়ামি, ছাত্রলীগের গুন্ডারা আজ আজ বিপর্যস্ত, কিন্তু অন্য কায়দায় গুণ্ডাগিরি চালাচ্ছে আর মৌলবাদীরা তো নিজেদের জয় ঘোষণা করে দিয়েছে। কিন্তু তারা তো আন্দোলনে নেতৃত্ব দেয় নি। আন্দোলন গেছে নানা ধারায়- নেতৃত্বের দাবিদার হল সবাই। চূড়ান্ত ফলাফল আসতে অনেক দেরি।”

আমি তাঁকে জিজ্ঞাসা করলাম “শেখ হাসিনা আজ ভারতে আশ্রয় পেয়েছেন, তাতে কি সাধারণ মানুষের মধ্যে ভারত-বিদ্বেষ বেড়ে গেছে?” উনি আমাকে উত্তরে বললেন,

“কারো কারো মধ্যে হয়েছে। কিন্তু শেখ হাসিনার দেশত্যাগ করা ছাড়া উপায় ছিল না। জনরোষের সামনে দাঁড়াবার ক্ষমতা তাঁর ছিল না। আর তিনি যদি ভারতে আশ্রয় না পেতেন, তবে তাঁর প্রাণরক্ষা করতে সেনাবাহিনীকে অবশেষে গুলি চালাতে হত। তাতে যে কত প্রাণহানি হত কে জানে! তাতে গণ-অভ্যুত্থানও বিপথগামী হতে পারত। সেটা যে আমাদের দেখতে হল না, সেটাও আমাদের স্বস্তি। নতুন সরকার এলে, আইনের ধারা অনুযায়ী শেখ হাসিনার একদিন বিচার হবে। তার আগে আমাদের সামনে অনেক কাজ।”

ওই ২০২৪-এর ৫ অগাস্টের পর প্রথম যে সব খবর ভারতের সংবাদমাধ্যমে পেতাম  হিন্দুদের উপর ও হিন্দু মন্দিরের উপর আক্রমণের খবর। কিন্তু চেন্নাই থেকে প্রকাশিত দি হিন্দু খবরের কাগজে এই খবরও দেখেছি, যে বাংলাদেশের মুসলমান সমাজ, এমনকি বিএনপি ও জামাতের স্বেচ্ছাসেবকরা সংঘবদ্ধ ভাবে হিন্দু প্রতিবেশী ও হিন্দু উপাসনাস্থল রক্ষা করেছেন। কিন্তু ভারতের সংবাদ মাধ্যমে ক্রমাগত যা দেখতে লাগলাম, সেটা হল একতরফা ভাবে শুধুই “লাঞ্ছিত” হিন্দু-সমাজের কথা।

এই সব শুনে, আমি বিশেষ করে যোগাযোগ রেখে চলতাম, আমার চেনা হিন্দু বন্ধু পরিবারগুলির সঙ্গে, বিশেষ করে, সাভারে, যশোরে ও চট্টগ্রামে তাঁরা সবাই একবাক্যে আমাকে বলেছিলেন, “দাদা, আশঙ্কা কার না থাকে? তবে মহালয়া থেকে কালীপূজো অবধি সব অনুষ্ঠানই নির্বিঘ্নে কেটেছে। অন্যবারের চেয়ে সরকার আরো বেশি নজর রেখেছিল। কোথাও কোনো গণ্ডগোল হয়নি।”

হিন্দু নির্যাতন ও মন্দির আক্রমণ ও পুজোয় বিঘ্নের খবর আমাদের সংবাদমাধ্যমে ক্রমাগতই আসতে লাগল । ভারত সরকারও বাংলাদেশ সরকারকে নানা সময়ে হিন্দুদের নিরাপত্তার বিষয়ে হুঁশিয়ারিও দিয়েছেন। এই বিষয়ে তো কলকাতার এক ইউটিউব চ্যানেলে, এক ফরওয়ার্ড ব্লক নেতার সাক্ষাৎকার নেবার সময় চ্যানেল-আহ্বায়ক বললেন, “বাংলাদেশে তো হিন্দুদের জেনোসাইড চলছে।” জেনোসাইড অর্থাৎ সংগঠিত নিধন কার্য। সেটা শুনেই আমি ইন্টারনেটে ভারতের বৈদেশিক বিষয়ক মন্ত্রী ড: এস. জয়শঙ্করের বক্তব্য খোঁজ করলাম। তাতে দেখলাম যে লোকসভায় Starred Question No.75 এর উত্তরে, ২৯ নভেম্বর ২০২৪-এ তিনি বলেছেন,

“...Reports of attacks on temples and Puja Mandaps also come to light during the recent Durga Puja festival in Bangladesh. Government had expressed its serious concerns regarding attacks on a Puja Mandap in Tantibazar, Dhaka and theft at the Jashoreshwari Kali Temple in Satkhira, during Durga Puja 2024. Following these attacks, the Government of Bangladesh had issued instructions for special security including deployment of Army and Border Guards Bangladesh to ensure peaceful celebration of Durga Puja.”

এর থেকে কি আমরা জেনোসাইড-এর আভাস পাই? বা, বাংলাদেশ সরকারের নিষ্ক্রিয়তার? যে সব বিচ্ছিন্ন ঘটনাগুলি ঘটেছে, সেগুলো এড়ানো হয়ত যেত। তবে বর্তমান বাংলাদেশ সরকারও সম্পূর্ণ নিষ্ক্রিয় থাকেনি। অবশ্য, এ কথা অনেকেই বলবেন যে আরও তৎপর থাকলে ভালো হতো । হয়ত তাই ।

আদতে তত্ত্বাবধায়ক সরকারের রাজনৈতিক ও প্রশাসনিক ক্ষমতা হলো সীমিত, রাজনৈতিক বিচক্ষণতারও অভাব আছে। তাই , ২০২৪ এর নভেম্বরে ইসকন থেকে বিতাড়িত, শ্রী চিন্ময়কৃষ্ণ দাসের গ্রেফতার প্রসঙ্গে ঢাকা ট্রিবিউনের সম্পাদক জাফর সোবহানের মতামত এই রকম,

“চিন্ময়কৃষ্ণ দাস হলেন, বাংলাদেশের নাগরিক। বাংলাদেশের আইন অনুসারেই তাঁর বিচার হবে। ভারতের কোনো রকম নির্দেশ দেবার অধিকার নেই। তবে, যে অপরাধে তাঁকে গ্রেফতরা করা হলো, তাতে বর্তমান সরকারের বিচক্ষণতার অভাব বেশ বোঝা যায়। চিন্ময়কৃষ্ণ দাসের বিরুদ্ধে ধর্মীয় বিদ্বেষ ছড়ান ও প্ররোচনামূলক বক্তব্যের অনেক প্রমাণ আছে। সে বিষয়ে শাস্তিমূলক ব্যবস্থা নিলে কোনো জটিলতাই হত না।”

প্ররোচনামূলক বক্তব্য দুই দেশ থেকেই আসছে। চিন্ময়কৃষ্ণ দাসের গ্রফতারের পর, চট্টগ্রাম আদালত চত্ত্বরে পাবলিক প্রসিকিউটর সইফুল ইসলামের হত্যার বিষয়কে ভারতবর্ষে যে ভাবে সাম্প্রদায়িক রঙ দেওয়া হয়, তা অত্যন্ত ধিক্কারজনক। ঠিক তেমনই ঢাকায় BUET এর প্রবেশ পথে ভারতের জাতীয় পতাকাকে যেভাবে অপমান করা হয়, সেটা অতি নিন্দিত কাজ। এছাড়াও অনেক গর্হিত কাজ দুই দেশের একাংশের মানুষ নির্লজ্জ ভাবে করে চলেছে।

তবে আশার বিষয়, গত ৯ ডিসেম্বর ২০২৪, ঢাকায় ভারত ও বাংলাদেশের পররাষ্ট্র সচিবদের যে আলোচনা হলো, তাতে দুই দেশের পক্ষ থেকে যে সংযত মনোভব দেখা গেছে, তাতে আমরা কিছুটা আশ্বস্ত বোধ করি। এছাড়া, ভারতে বসে শেখ হাসিনা বাংলাদেশের তত্ত্বাবধায়ক সরকারের বিরুদ্ধে যে রাজনৈতিক বক্তব্য দিয়ে যাচ্ছিলেন , ভারতের বিদেশসচিব তার নিন্দাও করেছেন। সেটাও দুই সরকারের মধ্যে সম্পর্ক সহজ করবে বলে মনে করি। আশা করি, এই প্রক্রিয়া এগুতে থাকবে।

গত ২০২৩ সালে পুজোর সময় ১৮ দিন বাংলাদেশ ভ্রমণে গিয়েছিলাম। বহু মানুষের সঙ্গে কথা বলে বুঝেছিলাম যে শেখ হাসিনা একদিন বিরাট বিক্ষোভের মুখোমুখি হবেন। তবে সেই বিক্ষোভ যে এত বিরাট আকার নিয়ে গণ-অভ্যুত্থানে, এত তাড়াতাড়ি পরিণত হবে, সেটা আমি কখনও বুঝতে পারিনি। সে সব পরে কখনও বলব। যে বিষয় নিয়ে শেষ করব, সেটা হলো সাম্প্রদায়িক গুজব রটানোর স্পৃহা কেমন করে সাধারণ এবং শুভবুদ্ধিসম্পন্ন মানুষের মধ্যেও ছড়িয়ে পড়েছে।

আমার ওই বাংলাদেশ সফরে, ভ্রমণ সঙ্গী হয়েছিলেন, আমারই এক বন্ধু, তাঁর নাম ধরুন 'কমলবাবু'। ওই ভ্রমণ কালে চট্টগ্রামের এক হিন্দু পরিবারের সঙ্গে হৃদ্যতা জন্মায় ও তা আজ বন্ধুত্বে পরিণত হয়েছে। ওই কমলবাবু হলেন আবার আমার পূর্বোল্লিখিত বন্ধু, মৃণালবাবুরও বন্ধু। ওই ২০২৪-এর নভেম্বর মাসের ১৮-১৯ তারিখে, ওই 'কমলবাবু' মৃণালবাবুকে বললেন, “জানেন বাংলাদেশ পাকিস্তান হয়ে যাচ্ছে। প্রদীপবাবুরাও সাম্প্রদায়িক অত্যাচার সইতে না পেরে, চট্টগ্রামের ঘর বাড়ি ছেড়ে, ছেলেমেয়ের কাছে অস্ট্রেলিয়া চলে গেছেন।” মৃণালবাবুর মুখে খবরটা শুনে, বিচলিত হয়ে প্রদীপবাবুকে ফোন করলাম। তিনি তখন, ছেলে মেয়ের কাছে সিডনিতে, দুই-ভাই বোন একই শহরে থাকেন। বললেন, “কোনো সমস্যা হয় নাই । আপনাকে তো আগেই বলেছি, নভেম্বরে ছেলে মেয়েদের কাছে আসব। ভেবেছিলাম বাংলাদেশে সরকার পরিবর্তনের পর ভিসা পেতে অসুবিধা হবে। কিন্তু সমস্যা কিছু হয় নাই । আমাদের ভিসা সমস্যা হলো ভারতের সঙ্গে। আমার ছোটভাই থাকত কলকাতায়, ইন্ডিয়ার সিটিজেন। দীর্ঘ রোগভোগের পর সে মারা গেল। ভিসা অফিস বন্ধ, আমি যেতে পারলাম না।”

আমি জিজ্ঞাসা করলাম, “আপনাদের দেশের বাড়িতে দূর্গাপুজো নির্বিঘ্নে হয়েছে তো?” প্রদীপ বাবু বললেন, কোন সমস্যা (বাংলাদেশের মানুষ “সমস্যা” শব্দটি খুব ব্যবহার করেন, আমাদের মতো “নো পব্‌লেম্‌” বলেন না) হয় নাই। প্রশাসন এবার আরও কড়া ছিল।” এইসব শুনে আমি মৃণালবাবুকে একহাত নিলাম, “কী মশাই, এই মিথ্যা প্রচারে আপনিও আছেন?”
মৃণালবাবু তো শুনে খুব লজ্জিত হলেন। ওই 'কমলবাবু'কে তিনি সরাসরি বললেন, “আপনার জন্য সব্যসাচীদার কাছে মিথ্যাবাদী প্রতিপন্ন হলাম।।"

'কমলবাবু' এবার তাঁর সুর পাল্টালেন, “আপনি জানেন না, মৃণালদা, প্রদীপবাবুরা কত রাত ভয়ে কাটিয়েছেন। সারারাত জেগে বাড়ি পাহারা দিতে হত ওনাদের, কখন অ্যাটাক হয়।”
প্রথমে আমি তেমন গুরুত্ব দিইনি। তবে চট্টগ্রামের আদালতে সরকারী উকিল, সইফুল ইসলামের হত্যার পর ভাবলাম, খোঁজ নিই। প্রদীপবাবুদের বাড়িও তো চট্টগ্রামে। প্রদীপবাবুকে বললাম, “আপনারা বিদেশে,- এতদিন বাড়ীতে কেউ থাকবে না, যদি হামলা হয়? চট্টগ্রামে তো গোলমাল চলছে। যাবার আগে, আপনাদের তো মশায় পালা করে, রাত জেগে পাহারা দিতে হত।”

আরও পড়ুন

শ্রীলঙ্কা, বাংলাদেশ,নেপাল || বারবার গণবিক্ষোভ যা শেখাল

শুনে প্রদীপবাবু আকাশ থেকে পড়লেন। বললেন, “কে বলেছে? নাকি, রিপাবলিক টিভির ‌খবর? বাড়ি খালি রেখে আসতে ভয় কোথায়? পুরা বিল্ডিংই তো হলো সব আমাদের নিজেদের লোক। আমরা পাহারা দেব কেন? কেয়ার-টেকারই তো আছে।” আমি বললাম, “আপনাদের নিজের লোক সবাই, তার মানে তো আপনাদের বাড়ি হলো হিন্দু বাড়ি, a marked place। আপনারাই তো তাহলে অ্যাটাকের টার্গেট হবেন। আর, আপনাদের কেয়ারটেকারও কি হিন্দু?” উনি বললেন,

“হ্যাঁ, সেও হিন্দু, কিন্তু ড্রাইভার হলো মুসলমান, আপনি তো তাঁকে দেখেছেন। তা ছাড়া, পুরা পাড়ায় আমরা হিন্দু-মুসলমান , সবাই একে অপরের ভালো-মন্দ দেখি। বিপদে ছুটে আসি। যদি হামলা হয়, বাইরে থেকে হবে। পাড়ায় হিন্দু-মুসলমান সবাই একসঙ্গে বেরিয়ে ঠেকাবে। আর এইবারও প্রশাসন চট্টগ্রামের গন্ডগোলটাকে ওই কোর্ট চত্বরের বাইরে ছড়াতে দেয়নি।”

এই 'কমলবাবু' কিন্তু হলেন বাম-গণতান্ত্রিক চেতনা সম্পন্ন মানুষ, কিন্তু এক্ষেত্রে মনগড়া থিওরি নিজেই বানিয়েছেন, বা কেউ তাঁকে দিয়ে থিওরি তৈরি করেছেন : কেন তা জানি না। তবে, ভারতীয় গোদি মিডিয়ার অসত্য, সাম্প্রদায়িক প্ররোচনামূলক প্রচার এক সাম্রাজ্যে পরিণত হয়েছে। সেই পণ্য 'কমলবাবু'ও কিনেছেন, বিনামূল্যে। মূল্যটা দেবে কিন্তু আমাদের সমাজ।

এই বছর, অর্থাৎ ২০২৪-এর দুর্গাপুজার পর কালীপূজো ও ভাইফোঁটাও কেটে গেল। দুর্গাপুজোর সময়, বিশেষ করে, বিজয়া-দশমীর সন্ধ্যায় (২০২৩-এ দুর্গাপূজোর সময় ঢাকাতেই ছিলাম) বাংলাদেশের বন্ধুদের কাছ থেকে স্বতঃস্ফূর্ত আন্তরিক শুভেচ্ছা পেয়ে পুলকিত হলাম। বিশেষ আনন্দ পেলাম হিন্দু বন্ধুদের কাছ থেকে এই কথা জেনে যে, এই বছর পূজো নির্বিঘ্নে, শান্তিপূর্ণভাবে, হয়ত বা (নিরাপত্তা বোধের দরুনই হতে পারে) একটু বেশি ঘটা করেই পালিত হয়েছে। বাংলাদেশে প্রায় দেড় কোটি, হিন্দুর বাস আর দুর্গাপুজো হয়েছে প্রায় ৩৪ হাজার : আশ্চর্যের কথা, জনসংখ্যার অনুপাতে দুর্গাপুজোর সংখ্যা পশ্চিমবঙ্গের চেয়ে বেশি। একথা ঠিক, বাংলাদেশের সার্বিক পরিস্থিতি আমরা শুধুমাত্র দুর্গাপুজোর নিরিখে বিচার করতে পারি না। কিন্তু এটুকু বুঝতে পারা যায়, স্বধর্ম পালনের স্বাধীনতা বাংলাদেশে পুরোপুরি বিলোপ হয়ে যায়নি।

(মতামত লেখকের ব্যক্তিগত। এই মতামতের দায়ভার ইনস্ক্রিপ্টের উপর বর্তায় না।)

More Articles