কেন লাদাখে ছয় বছরের শান্তিপূর্ণ আন্দোলন হঠাৎ হিংসার রূপ নিল?

Ladakh Unrest 2025: এ কথা পরিষ্কার, লে-লাদাখের বাসিন্দারা কেন্দ্র সরকারের বিরুদ্ধে বীতশ্রদ্ধ হয়েই আইন ভাঙছে। এই পরিস্থিতিতে দেশের প্রাতিষ্ঠানিক মিডিয়ায় সোনাম ওয়াংচুককে সন্ত্রাসবাদী বলে দাগিয়ে দেওয়া হচ্ছে।

পূর্ণ রাজ্যের মর্যাদা দিতে হবে লাদাখকে—এই দাবিতে বুধবার লেহ জুড়ে বিক্ষোভ শুরু হয়। প্রথমে শান্তিপূর্ণ হলেও দ্রুতই হিংসার চেহারা নেয় এই বিক্ষোভ। পুলিশের সঙ্গে বিক্ষোভকারীদের সংঘর্ষে মৃত্যু হয়েছে চার জনের, আহত হয়েছেন অন্তত ৮০ জন। পরিস্থিতি সামাল দিতে লেহ-তে কার্ফু জারি করেছে প্রশাসন, পাশাপাশি ১৪৪ ধারা প্রয়োগ করে মোতায়েন করা হয়েছে অতিরিক্ত নিরাপত্তাবাহিনী।

সংঘর্ষে প্রাণ হারিয়েছেন চার জন বিক্ষোভকারী। আহত হয়েছেন অন্তত ৮০ জন, যাঁদের মধ্যে ৪০ জনেরও বেশি পেশায় পুলিশকর্মী রয়েছেন। গুরুতর জখমদের চিকিৎসা চলছে হাসপাতালে, মৃতের সংখ্যা আরও বাড়তে পারে বলে আশঙ্কা করছে প্রশাসন। লে, লাদাখের বাসিন্দাদের সবচেয়ে শান্তিপূর্ণ বলে মনে করা হত, এখন সেই লে লাদাখই যেন রণাঙ্গন।

এ কথা পরিষ্কার, লে-লাদাখের বাসিন্দারা কেন্দ্র সরকারের বিরুদ্ধে বীতশ্রদ্ধ হয়েই আইন ভাঙছে। এই পরিস্থিতিতে দেশের প্রাতিষ্ঠানিক মিডিয়ায় সোনাম ওয়াংচুককে সন্ত্রাসবাদী বলে দাগিয়ে দেওয়া হচ্ছে। স্বরাষ্ট্রমন্ত্রক বলছে, এই অশান্তিতে সোনামের মদত রয়েছে। পাশাপাশি বলা হচ্ছে নিয়ম ভেঙে বিদেশি অনুদান নিচ্ছেন সোনামরা।
ফরেন কন্ট্রিবিউশন রেগুলেশন অ্যাক্ট ভেঙে অনুদান নিচ্ছেন, এই অভিযোগে সোনমের বিরুদ্ধে তদন্ত শুরু করছে সিবিআই।

আরও পড়ুন

 লাদাখ আর কিছু দিন, দায় কার?

বিগত ৬ বছর ধরে শান্তিপূর্ণ ভাবেই আন্দোলনের পথে হাঁটছিলেন সোনম। সরকারকে বারবার মনে করিয়ে দিতে চাইছিলেন, লে লাদাখের গণদাবির কথা। ২৪ সেপ্টেম্বর ৬ বছর ধরে চলা এই আন্দোলন সহিংস আকার ধারণ করে। অবস্থা সামাল দিতে কার্ফু জারি করা হয়। পরিস্থিতি কিছুটা স্বাভাবিক হলেও, পরিবেশ থমথমে, মানুষ সন্ত্রস্ত। লাদাখে হিংসার ঘটনার পর সোনাম ওয়াংচুক নিজেই আন্দোলন প্রত্যাহার করে নিয়েছেন। আন্দোলনকারীদের বলেছেন, তারা ভুল পথে চলে গিয়েছেন। কারণ সোনম ওয়াংচুক গান্ধীর অহিংস মতাদর্শে বিশ্বাসী।

কখনও রাস্তা দখল করে আন্দোলন, কখনও দিল্লি টু মার্চ এর মতো কর্মসূচি, ষষ্ঠ তফশিলে অন্তর্ভুক্তকরণ ও পূর্ণরাজ্যেত মর্যাদার দাবি নিয়ে গত ছ'বছর আন্দোলন চালিয়ে গিয়েছেন লাদাখবাসী। ১০ সেপ্টেম্বর থেকে অনশন শুরু করেন ওয়াংচুক। ২১ সেপ্টেম্বর স্বরাষ্ট্রমন্ত্রক জানায় কথা শোনা হবে। কিন্তু সোনমরা জানান, সরকার শর্ত মানার বদলে শর্ত চাপাচ্ছে।  অনশন চলতে থাকে। ২৩ সেপ্টেম্বর অনশন এমন জায়গায় এসে দাঁড়ায় যে দু'জনকে হাসপাতালে ভর্তি করতে হয়। এতে আন্দোলনকারীরা আরও ক্ষিপ্ত হয়ে ওঠে। তারপরই, ২৪ সেপ্টেম্বর চূড়ান্ত অশান্ত হয় লাদাখ। গুলি চালানো হয় ঘটনাস্থলে।

প্রাতিষ্ঠানিক মিডিয়া সোনমকে চিনের দালাল বলতে শুরু করে। যদিও লাদাখের বুধবারের বিক্ষোভের নিয়ে জনপরিসরেই ক্ষোভপ্রকাশ করেছেন সোনম ওয়াংচুক। স্পষ্ট জানিয়েছেন, কোনও সহিংস আন্দোলনকে সমর্থন করেন না তিনি। এই ঘটনার পর ওয়াংচুক ট্যুইট করে বলেন, ‘‘এটি লাদাখের জন্য তো বটেই, ব্যক্তিগতভাবে আমার জন্যও সবচেয়ে দুঃখের দিন! কারণ, গত এতদিন আমরা যে পথে হাঁটছি, তা ছিল শান্তিপূর্ণ। আমরা পাঁচ বার অনশন করেছি, লেহ থেকে দিল্লি পর্যন্ত হেঁটেছি। কিন্তু আজ এই হিংসা ও অগ্নিসংযোগের ঘটনায় আমাদের শান্তির বার্তা ব্যর্থ হতে দেখলাম।’’

লাদাখবাসীদের দীর্ঘদিনের দাবি চার দফায় স্পষ্টভাবে সামনে এসেছে—

১)লাদাখকে পূর্ণ রাজ্যের মর্যাদা দিতে হবে।

আর্টিকেল ৩৭০ থেকে যখন তাদের পূর্ণ রাজ্যের মর্যাদা নিয়ে নেওয়া হয়, কেন্দ্রশাসিত অঞ্চল ঘোষণা করা হয়, লাদাখবাসী ভেবেছিলেন, এবার কেন্দ্র তাদের কথা ভাববে। আদতে তা হয়নি, বরং অভিযোগ বাইরের পুঁজি খাটিয়ে ধনী ব্যক্তিদের সুবিধে করে দেওয়া হয়েছে বলে অভিযোগ। লাদাখবাসীর মনে হচ্ছে দিল্লিতে বসে লাদাখকে নিয়ন্ত্রণ করার চেষ্টা চলছে।

২) সংবিধানের ষষ্ঠ তফসিল-এর অন্তর্ভুক্ত করতে হবে।

লাদাখের প্রায় ৯৭ শতাংশ মানুষ উপজাতি সম্প্রদায়ের। তাই ষষ্ঠ তফসিলে অন্তর্ভুক্তি স্থানীয় সংস্কৃতি, পরিবেশ ও উপজাতিদের অধিকার সুরক্ষায় বড় ভূমিকা নেবে। একইসঙ্গে স্থানীয় স্বায়ত্তশাসন ও উন্নয়নের পথও খুলে যাবে। এখন যা দিল্লি থেকে করা হয়।

৩) লেহ ও কার্গিলের জন্য আলাদা লোকসভা আসন নিশ্চিত করতে হবে।

যাতে তাঁদের ন্যায্য রাজনৈতিক প্রতিনিধিত্ব নিশ্চিত হয়, নিজেদের সাংস্কৃতিক পরিচয় রক্ষা করা যায়, আঞ্চলিক বৈষম্য কমানো সম্ভব হয় এবং ভারতের গণতান্ত্রিক প্রক্রিয়ায় শক্তিশালী ভূমিকা রাখা যায়।

আরও পড়ুন

মাইনাস ঠান্ডায় খোলা আকাশের নীচে টানা অনশন! যে দাবিতে লাদাখে সরব বাস্তবের ‘ব়্যাঞ্চো’

৪)লাদাখের জন্য পৃথক পাবলিক সার্ভিস কমিশন গঠন করতে হবে।

লেহ-তে গড়শিক্ষার হার ভালো কিন্তু বেকারত্ব অনেক বেশি। লাদাখে স্নাতক ডিগ্রিধারীদের মধ্যে বেকারত্বের হার ২৬.৫%, যা জাতীয় গড়ের প্রায় দ্বিগুণ। সেখানে আলাদা পাবলিক সার্ভিস কমিশন নেই, ফলে স্থানীয় চাকরির সুযোগও খুব সীমিত। এই অভাবই বিশেষ করে তরুণ প্রজন্মের মধ্যে প্রবল অর্থনৈতিক হতাশা ও ক্ষোভ তৈরি করেছে।যদি লাদাখকে ষষ্ঠ তফসিলের আওতায় আনা হয়, তবে নির্বাচিত স্থানীয় সংস্থাগুলি সম্পদ ব্যবস্থাপনা ও উন্নয়ন পরিকল্পনায় বেশি ক্ষমতা পাবে। এতে স্থানীয় প্রয়োজন ও দক্ষতার সঙ্গে সামঞ্জস্য রেখে আরও চাকরির সুযোগ তৈরি হতে পারে।

এই মুহূর্তে পুরো লেহ শহর এখন কড়া নিরাপত্তায় মোড়া। কার্ফু চলছে, বড় জমায়েত বা মিছিল নিষিদ্ধ। সরকার মনে করছে পরিস্থিতি সামলাতে সময় লাগবে। তবে প্রশ্ন উঠছে—যে লাদাখ এতদিন শান্তি ও পর্যটনের প্রতীক ছিল, সেখানে শান্তি ফিরবে কবে?

মনে রাখতে হবে, লাদাখে চলমান অশান্তি হঠাৎ ঘটে যাওয়া ঘটনা নয়; এটি বছরের পর বছর ধরে চেপে রাখা অসন্তোষের বহিঃপ্রকাশ। দীর্ঘ ছয় বছর ধরে শান্তিপূর্ণ আন্দোলন চালিয়ে আসা সত্ত্বেও স্থানীয়দের ন্যায্য দাবি মানা হয়নি। এসব ঘটনা ক্রমেই হতাশা ও ক্ষোভের জন্ম দিয়েছে। স্থানীয় প্রতিবাদীর কপালে জুটেছে দেশদ্রোহীর তকমা। কিন্তু মানুষের ইস্যু নিয়ে কখনও তৎপর হয়নি সংবাদমাধ্যম।

স্থানীয় সম্প্রদায়ের সঙ্গে সমন্বয় ব্যতীত এই পরিস্থিতি মোকাবিলা অসম্ভব।

More Articles