অনুপ্রবেশকারীদের উৎখাত: নির্বাচনী রাজনীতির হাতিয়ার?

BJP Politics: বিজেপি আসামে এবং পশ্চিমবঙ্গে একই সঙ্গে একটি বার্তা ছড়াতে চাইছে, ‘‌‘‌‌আমরাই অনুপ্রবেশকারীদের বিরুদ্ধে লড়ছি, আমরাই জমি ফিরিয়ে দিচ্ছি।”

RD

প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদি সম্প্রতি আসামে জনসভা করে ঘোষণা করেছেন, “লাখ লাখ একর জমি অনুপ্রবেশকারীদের হাত থেকে উদ্ধার করা হয়েছে।” তাঁর বক্তব্যে বারবার ফিরে এসেছে “অবৈধ দখলদার” এবং “বাংলাদেশি অনুপ্রবেশকারী” প্রসঙ্গ। এই শব্দবন্ধগুলি নতুন নয়। বরং গত এক দশকে আসামের রাজনৈতিক আলোচনায়, এমনকি পশ্চিমবঙ্গেও, এই শব্দগুলি বারবার উত্থাপিত হয়েছে। প্রশ্ন উঠছে, প্রধানমন্ত্রী কেন আবার এই প্রসঙ্গ তুললেন? এর উত্তর খুঁজতে খুব বশি কষ্ট করতে হয় না। আসামে বছর ঘুরলেই নির্বাচন এবং পশ্চিমবঙ্গেও প্রায় একই সঙ্গে ভোট। এবার নির্বাচনে বিরোধীরা যখন বিশেষ নিবিড় ভোটার তালিকা সংশোধনী বা এসআইআর-‌কে নির্বাচনী ইস্যু হিসেবে সবার উপরে রাখছেন, তখন গেরুয়া শিবিরের প্রধান রাজনৈতিক হাতিয়ার হল ‘‌অনুপ্রবেশ’‌। তাই পদ্ম শিবিরের নেতাদের মুখে বার বার উঠে আসছে ভুয়ো ভোটার এবং অনুপ্রবেশের প্রসঙ্গ। স্বয়ং প্রধানমন্ত্রীই-‌বা তার থেকে দূরে থাকবেন কেন। তাই সে বিহার হোক বা পশ্চিমবঙ্গ বা আসাম, প্রতিটি সরকারি বা রাজনৈতিক মঞ্চ থেকে জমি দখল ও অনুপ্রবেশকারীর ইস্যুটি ফের জীবন্ত করে তুলতে চাইছে বিজেপি।

ইতিমধ্যেই গত কয়েক মাসে আসাম সরকার নতুন করে বহু জায়গায় জবরদখল উচ্ছেদ অভিযান চালিয়েছে। উৎখাত হতে হয়েছেন লক্ষাধিক মানুষ। এই উৎখাত হওয়া মানুষদের সম্পর্কে সামান্য খোঁজখবর করলেই উঠে আসছে বেশ কিছু তথ্য। যেমন, তাদের ৯৯ শতাংশই মুসলিম ধর্মাবলম্বী। নদীর চর বা জঙ্গলে বসবাসকারী বেশিরভাগই হতদরিদ্র ঝুপড়িবাসী। এমনকী, এই মানুষগুলোর বেশিরভাগই গত কয়েক দশক ধরে আসামের নিম্নভাগে কোনওমতে দিনগুজরান করছে। এদেরই বলা হচ্ছে ‘‌অনুপ্রবেশকারী’‌। এখন এক সঙ্গত প্রশ্ন, এই ‘‌অনুপ্রবেশকারীদের’‌ সরকারি জমি থেকে উচ্ছেদ করে দেওয়ার পর তারা কোথায় যাচ্ছেন ?‌ কী করছেন ?‌ জবাব খুঁজতে বেশি কষ্ট করতে হচ্ছে না মোটেও। উচ্ছেদ হওয়া লাখো আবালবৃদ্ধবনিতা কিছু দূরে গিয়ে অন্য কোথাও বসবাস করছেন। অর্থাৎ জায়গা বদ হচ্ছে শুধুমাত্র। এখানেই অনেকেই প্রশ্ন তুলছেন, তাহলে সরকারের উদ্দেশ্য কী?‌ রাজ্য সরকার এবং দেশের প্রধানমন্ত্রী যাদের উৎখাত করে জমি পুণরুদ্ধারের জন্য নিজেরাই নিজেদের পিঠ চাপড়াচ্ছেন, সেই উৎখাত হওয়া মানুষগুলো তো রয়েই গেল !‌ তারা বেআইনি অনুপ্রবেশকারী চিহ্নিত হলে ব্যবস্থা নেওয়া হচ্ছে না কেন ?‌ গত কয়েক বছরে আসাম সরকার এমন কতজনের বিরুদ্ধে আইনি পদক্ষেপ করেছে?

আরও পড়ুন- ‘ভোট চুরি’ বা এসআইআর! নির্বাচন কমিশনের সেম-সাইড গোল?

এবার আসা যাক তথ্যে। ধুবরিতে আদানি গোষ্ঠীর প্রকল্পের জন্য চার হাজার একর জমি থেকে প্রায় ১,৪০০ পরিবার উচ্ছেদ হয়েছে। গোয়ালপাড়া, নলবাড়ি, লক্ষ্মীপুর-‌সহ বিভিন্ন জেলায় একই চিত্র। হাজার হাজার পরিবার, যাদের অধিকাংশই বাংলাভাষী মুসলিম, রাতারাতি ঘরবাড়ি হারিয়েছেন। সরকার তাদের চিহ্নিত করছে “অবৈধ বাংলাদেশি অনুপ্রবেশকারী” হিসেবে। কিন্তু বিরোধী দল এবং মানবাধিকার সংগঠন বলছে, এদের অনেকেরই ভারতীয় নাগরিকত্বের বৈধ নথি রয়েছে, বহু প্রজন্ম ধরে তারা আসামে বসবাস করছে। গরিব ও প্রান্তিক হওয়ায় আদালতে নিজেদের পক্ষে দাঁড়ানোর মতো আর্থিক ও আইনি সামর্থ্য তাদের নেই। ফলে প্রশাসনের চোখে তাঁরা ‘‌বাংলাদেশি’‌। রাজনৈতিক ভাষণে তাঁরা ‘‌ভোটব্যাংক’‌, কিন্তু বাস্তবে তাঁরা শিকড়ছিন্ন হওয়া মানুষ।

এই অবস্থায় প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদির বক্তব্যের সময়োপযোগিতা তাই অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ। একদিকে অসমে শিগগিরই নির্বাচন। অন্যদিকে, চলতি বছরেই বিহার এবং তারপর পশ্চিমবঙ্গে আহামী বছরের শুরুতেই বিধানসভা ভোট। পদ্মশিবির মনে করে, ‘‌অনুপ্রবেশকারী’‌ প্রসঙ্গ এই আসাম তো বটেই বিহার ও পশ্চিমবঙ্গ রাজ্যের জনমনে আবেগ জাগাতে স্টেরয়েডের মতো কাজ করবে। রাজনীতির ভাষায় যাকে বলে ‘‌তৈরি জমি’‌। আসামে নাগরিকপঞ্জি বা এনআরসি বিতর্কে ইতিমধ্যেই ‘‌অনুপ্রবেশকারী’‌ একটি মস্ত ইস্যু এবং বহুচর্চিত। আর পশ্চিমবঙ্গে গত কয়েক বছরে বিজেপি’‌র সংগঠন বিস্তারের মূল অস্ত্রই হয়েছে অনুপ্রবেশ। সেখানে প্রতিপক্ষ শাসকের অপশাসন বা দুর্নীতি অথবা ভবিষ্যতে আম জনতার জন্য বিশেষ কোনও প্রতিশ্রুতি গৌণ থেকেছে। মুখ্য ইস্যু করে তোলা হয়েছে সীমান্তের অনুপ্রবেশকে। মিশিয়ে দেওয়া হয়েছে জাতীয়তাবাদের গন্ধ। কেল্লা ফতে !‌ আশানুরূপ না হলেও অনক সাফল্য মিলেছে ভোট বাক্সে। তাই সীমান্ত ঘেঁষা জেলা কোচবিহার, উত্তর ও দক্ষিণ দিনাজপুর, উত্তর ও দক্ষিণ ২৪ পরগনা, নদিয়া, মালদহ, মুর্শিদাবাদ এই সব জায়গাতেই বিজেপি ‘‌অনুপ্রবেশ’‌ ইস্যু তুলে ধরে কার্যত ভোটের আরও অনেকটা মেরুকরণ ঘটাতে চায়। মোদির বক্তব্য আসলে এই দ্বিমুখী রাজনৈতিক লক্ষ্যেই ছোঁড়া একটি মোক্ষম তীর।

আরও পড়ুন- ৬৮ জন ভোটারের ঠিকানা বার! ফের নির্বাচন কমিশনের বিরুদ্ধে ভোটচুরির অভিযোগ

তবে সমস্যার অন্য দিকও আছে। আসামে উচ্ছেদের নামে যে হাজার হাজার মানুষ শিকড়হারা হচ্ছেন, তাঁদের মানবাধিকার লঙ্ঘনের প্রশ্ন সামনে আসছে। রাজ্য সরকারের দেওয়া তথ্য বলছে, ২০১৬ থেকে এ পর্যন্ত প্রায় ১৫,২৭০ পরিবার সরকারি জমি থেকে উচ্ছেদ হয়েছে। অন্তত আটজনের মৃত্যু হয়েছে। এই প্রসঙ্গে উল্লেখ্য গুয়াহাটি হাইকোর্টের সাম্প্রতিক একটি পর্যবেক্ষণ। সিমেন্ট কারখানার জন্য তিন হাজার বিঘা জমি বরাদ্দের সিদ্ধান্তে সরকারের ভূমিকার কঠোর সমালোচনা করেছে হাইকোর্ট। আদালত স্পষ্ট বলেছে, জনগণের মতামত না নিয়ে, আইনি প্রক্রিয়া উপেক্ষা করে জমি অধিগ্রহণ হয়েছে। এখানেই শেষ নয়। হিমন্ত বিশ্বশর্মার সরকার মুখে বলছে অনুপ্রবেশকারীদের সরানো হচ্ছে, জমি উদ্ধারের কাজ চলছে। কিন্তু সরকার এখনও পর্যন্ত কোনো স্পষ্ট পরিসংখ্যান প্রকাশ করেনি কতজন প্রকৃত অনুপ্রবেশকারী শনাক্ত হয়েছে, কতজনকে গ্রেফতার করা হয়েছে কিংবা তাদের নিজেদের দেশে ফেরত পাঠানোর ব্যবস্থা হয়েছে কিনা। আরও গুরুত্বপূর্ণ প্রশ্ন, উদ্ধার হওয়া এই বিশাল পরিমাণ জমি ভবিষ্যতে সরকার কী কাজে লাগাবে কৃষক ও গৃহহীনদের পুনর্বাসনে, নাকি কর্পোরেট প্রকল্পের জন্য তা হস্তান্তর হবে? এই জ্বলন্ত প্রশ্নগুলো সরকারের উদ্দেশ্য নিয়ে নতুন সংশয় তৈরি করছে।

অতএব, প্রধানমন্ত্রী যখন জনসভা থেকে জমি উদ্ধারের কথা বলেন, তখন বুঝতে হবে এটি কেবল আইনের শাসনের দাবি নয়, বরং রাজনৈতিক কৌশলও বটে। বিজেপি আসামে এবং পশ্চিমবঙ্গে একই সঙ্গে একটি বার্তা ছড়াতে চাইছে, ‘‌‘‌‌আমরাই অনুপ্রবেশকারীদের বিরুদ্ধে লড়ছি, আমরাই জমি ফিরিয়ে দিচ্ছি।” এতে স্বাভাবিকভাবেই সংখ্যাগরিষ্ঠ হিন্দু ভোটারদের একাংশে আবেগে সুড়সুড়ি দেওয়া যায় বটে। কিন্তু এর আড়ালে প্রান্তিক মানুষ, দরিদ্র কৃষক এবং সংখ্যালঘু পরিবারদের দুর্দশা চাপা পড়ে যায়। গণতন্ত্রে যে রাষ্ট্রের প্রথম দায়িত্ব নাগরিকদের নিরাপত্তা ও অধিকার রক্ষা করা, সেটিই অনেক সময় রাজনৈতিক লাভের হিসেবের আড়ালে হারিয়ে যায়। এই প্রসঙ্গ তাই শুধু আসাম বা পশ্চিমবঙ্গ নয়, গোটা দেশের জন্যই একটি সতর্ক সংকেত।

More Articles