দিল্লি সন্ত্রান্সের নেপথ্যে মেডিক্যাল মডিউল! যেভাবে গড়ে উঠেছিল
Medical Terror Module: সম্প্রতি দিল্লির লালকেল্লা এলাকায় ভয়াবহ বিস্ফোরণের তদন্তে উঠে আসে এই মডিউলের নাম। সেই ঘটনার সূত্র ধরেই দিল্লি, নয়ডা ও ফরিদাবাদ জুড়ে শুরু হয় তল্লাশি অভিযান।
দিল্লির লালকেল্লা বিস্ফোরণের নেপথ্যে এখনও পর্যন্ত নাশকতার কোনো স্পষ্ট প্রমাণ না মিললেও, আত্মঘাতী হামলার আশঙ্কা উড়িয়ে দিচ্ছেন না তদন্তকারীরা। এই ঘটনার সূত্র ধরে ধীরে ধীরে সামনে আসছে এক চাঞ্চল্যকর সন্ত্রাস জাল, যার কেন্দ্রবিন্দুতে রয়েছেন একাধিক চিকিৎসক। দিল্লি ও তার আশপাশের এলাকায় আতঙ্ক ছড়িয়েছে নতুন এক সন্ত্রাস মডিউল ঘিরে। তদন্তে উঠে এসেছে, দক্ষিণ কাশ্মীরের শপিয়ান জেলার এক মৌলবি পরিচয়ের ব্যক্তি ছদ্মবেশে প্যারামেডিক হিসেবে কাজ করত। এই ব্যক্তিই ফরিদাবাদের তথাকথিত "মেডিক্যাল টেরর মডিউল"-এর মূল হোতা বলে দাবি করেছে তদন্তকারী সংস্থা। মেডিক্যাল টেরর মডিউল কী?
'মেডিক্যাল টেরর মডিউল' মানে এমন একটি চিকিৎসা-সংযুক্ত সন্ত্রাস নেটওয়ার্ক, যা মানবসেবার ছদ্মবেশে কাজ করলেও এর ভিতরে লুকিয়ে থাকে র্যাডিকাল ভাবনা ও সন্ত্রাসী কার্যক্রমের পরিকল্পনা। এই গ্রুপগুলোকে 'মেডিক্যাল টেরর মডিউল' বলা হয় কারণ তারা নিজেদের শিক্ষিত পরিচয় ব্যবহার করে সন্দেহ এড়িয়ে চলে, চিকিৎসা সামগ্রীর অজুহাতে রাসায়নিক বা বিস্ফোরক সংগ্রহ করে, আহত জঙ্গিদের চিকিৎসা বা লুকিয়ে রাখা কাজে সহায়তা করে, নতুন সদস্যদের ধর্মীয় ও মানবিক কথাবার্তার মাধ্যমে প্রভাবিত করে।প্যারামেডিক হিসেবে কাজ করা অন্যতম ব্যক্তির নাম ইরফান আহমেদ ওয়াগে।
সম্প্রতি দিল্লির লালকেল্লা এলাকায় ভয়াবহ বিস্ফোরণের তদন্তে উঠে আসে এই মডিউলের নাম। সেই ঘটনার সূত্র ধরেই দিল্লি, নয়ডা ও ফরিদাবাদ জুড়ে শুরু হয় তল্লাশি অভিযান। কয়েকজন সন্দেহভাজনকে ইতিমধ্যে আটক করা হয়েছে, যাদের অধিকাংশই মেডিক্যাল শিক্ষার্থী। অভিযুক্ত কারা? কী কী অভিযোগ?
আরও পড়ুন
‘তিনবার মাটিতে পড়ে গিয়েছিলাম’! দিল্লির বিস্ফোরণ নিয়ে যা জানালেন প্রত্যক্ষদর্শীরা
তদন্তকারীরা বলছেন, এই মডিউলের সবচেয়ে ভয়ঙ্কর দিক হলো “হোয়াইট-কলার সন্ত্রাস”— অর্থাৎ শিক্ষিত পেশাজীবীদের ব্যবহার করে জঙ্গি নেটওয়ার্ক গড়ে তোলা। আগে সাধারণত অশিক্ষিত বা প্রান্তিক তরুণদের সন্ত্রাসে জড়ানোর ঘটনা দেখা যেত, কিন্তু এই প্রবণতা এক নতুন ও উদ্বেগজনক দিক নির্দেশ করছে। বর্তমানে দিল্লি ও হরিয়ানার যৌথ বিশেষ দল ইরফান ও তার সহযোগীদের আর্থিক লেনদেন, মোবাইল যোগাযোগ ও অনলাইন কার্যকলাপ খতিয়ে দেখছে। তদন্তকারীদের লক্ষ্য, এই নেটওয়ার্কের আন্তর্জাতিক সংযোগ ও অর্থের উৎস চিহ্নিত করা।
ইরফান একদিকে ধর্মীয় প্রচারক হিসেবে নিজেকে পরিচিত করেছিলেন, আবার অন্যদিকে চিকিৎসা সহায়ক বা প্যারামেডিক হিসেবেও কাজ করতেন। এই দুই পরিচয়ের আড়ালেই তিনি ধীরে ধীরে তৈরি করেছিলেন ভয়ঙ্কর জাল— যার টার্গেট ছিল শিক্ষিত যুবসমাজ, বিশেষ করে মেডিক্যাল ও প্যারামেডিক্যাল শিক্ষার্থীরা। তদন্তে জানা গিয়েছে, ইরফান তরুণ চিকিৎসা শিক্ষার্থীদের সঙ্গে বন্ধুত্ব গড়ে তুলত, ধর্মীয় আলোচনার মাধ্যমে তাদের বিশ্বাস অর্জন করত। তারপর ধীরে ধীরে র্যাডিকাল চিন্তাধারার দিকে ঠেলে দিত। কারও মনে প্রশ্ন জাগলে তিনি তা 'ধর্মীয় কর্তব্য' বলে ব্যাখ্যা করত। এই মডিউল শুধু মতাদর্শে সীমাবদ্ধ ছিল না। তারা অর্থ সংগ্রহ, বিস্ফোরক উপকরণ জোগাড়, লজিস্টিক সহায়তা দেওয়া এবং অনলাইন মাধ্যমে যোগাযোগ রক্ষা করত দেশের বিভিন্ন প্রান্তের জঙ্গি সংগঠনের সঙ্গে। তদন্তকারীদের মতে, তাদের সংযোগ ছিল জইশ-ই-মহম্মদ (JeM)-এর মতো আন্তর্জাতিক সন্ত্রাসী সংগঠনের সঙ্গে।
তিন সপ্তাহ আগে, অক্টোবরের শেষ দিকে, কাশ্মীর পুলিশ খবর পায়— একটি বিশেষ গোষ্ঠী কাশ্মীরে হামলার প্রস্তুতি নিচ্ছে। সেই তথ্যের ভিত্তিতেই শুরু হয় তল্লাশি অভিযান। এই অভিযানে গ্রেফতার হয় চিকিৎসক আদিল আহমেদ রাঠর। অভিযোগ, তিনি শ্রীনগরে পাকিস্তানি জঙ্গিগোষ্ঠী জইশ-ই-মহম্মদ (JeM)-এর সমর্থনে পোস্টার সাঁটিয়েছিল। আদিলকে জিজ্ঞাসাবাদের পর আরও দু’জনের নাম সামনে আসে। তাঁদের মধ্যে অন্যতম ছিলেন ডা. মুজাম্মিল আহমেদ। মুজাম্মিলকে জেরা করেই পুলিশ জানতে পারে, দিল্লির কাছে হরিয়ানার ফরিদাবাদে বিস্ফোরক মজুতের তথ্য। তল্লাশি চালিয়ে ফরিদাবাদ থেকে উদ্ধার হয় প্রায় ৩৬০ কেজি আরডিএক্স তৈরির কাঁচামাল। পরবর্তীতে জম্মু-কাশ্মীর পুলিশ জানায়, গত কয়েক দিনে দেশের বিভিন্ন জায়গায় অভিযান চালিয়ে মোট ২,৯০০ কেজি বিস্ফোরক উপকরণ উদ্ধার করা হয়েছে। এই বিপুল পরিমাণ বিস্ফোরক উদ্ধারের পর গোটা তদন্তের মোড় ঘুরে যায়।
আদিল ও মুজাম্মিলের গ্রেফতারের পর থেকে পুলিশের নজরে আসে উমর নবি। তদন্তকারীদের দাবি, এই বিস্ফোরণের মূল সন্দেহভাজন হতে পারেন হারিয়ানার ফরিদাবাদের আল-ফালাহ বিশ্ববিদ্যালয়ের সহকারী অধ্যাপক উমর নবি। তদন্তকারীদের ধারণা, সহকর্মীদের গ্রেফতারের পর তিনি ভয় পেয়ে ফরিদাবাদ থেকে পালিয়ে আসেন। ১০ নভেম্বর সন্ধ্যা ৬টা ৫২ মিনিটে, লালকেল্লার কাছে সুভাষ মার্গ সিগন্যালে একটি হুন্ডাই আই–২০ গাড়ি হঠাৎ গতি কমিয়ে দাঁড়ায়। ঠিক তখনই ঘটে ভয়াবহ বিস্ফোরণ। মুহূর্তের মধ্যে আগুনে পুড়ে যায় পুরো গাড়ি, মৃত্যু হয় ১২ জনের।
উমর নবি পেশায় একজন শিক্ষাবিদ, কাশ্মীরের পুলওয়ামা জেলার লেথপোরা এলাকার কৈল গ্রামের বাসিন্দা। উমর বিশ্ববিদ্যালয়ে প্যারামেডিক্যাল বিভাগের শিক্ষক হিসেবে পরিচিত। সহকর্মীদের কথায়, উমর ছিল একেবারেই অন্তর্মুখী ও চুপচাপ স্বভাবের মানুষ। খুব বেশি বন্ধু ছিল না, ক্লাস শেষে বেশিরভাগ সময় নিজের মধ্যেই থাকত। তার পরিবারও বলেছে, উমর কখনও রাজনীতি বা ধর্মীয় উগ্রতায় জড়িত ছিল না। পরিবারের সদস্যদের কথায়, “আমরা বিশ্বাসই করতে পারছি না, এমন কোনো ঘটনায় তাঁর নাম জড়াতে পারে।”
আরও পড়ুন
২০২৫ প্রথম নয়, বারবার গাড়ি বিস্ফোরণে ছিন্নভিন্ন হয়েছে ভারতাত্মা
১০ নভেম্বর সন্ধ্যায় দিল্লির লালকেল্লা সংলগ্ন এলাকায় হুন্ডাই আই–২০ গাড়িতে প্রবল বিস্ফোরণ হয়। ঘটনাস্থলেই মৃত্যু হয় ১২ জনের, আহত হন আরও বহু মানুষ। পরে জানা যায়, গাড়িটি উমর নবির নামে রেজিস্টার্ড ছিল। সিসিটিভি ফুটেজেও দেখা গিয়েছে, বিস্ফোরণের আগে উমর প্রায় তিন ঘণ্টা গাড়িটি সুাহিরি মসজিদের পার্কিং এলাকায় রেখে দেন। এরপর গাড়িটি শহরের বিভিন্ন এলাকা ঘুরে লালকেল্লা অঞ্চলে পৌঁছায়। তদন্তকারীরা জানিয়েছেন, গাড়ির ধ্বংসস্তূপ থেকে অ্যামোনিয়াম নাইট্রেট ও অন্যান্য রাসায়নিকের চিহ্ন মিলেছে। ধারণা করা হচ্ছে, গাড়িতে কোনো ভাবে বিস্ফোরক বহন করা হচ্ছিল— তা দুর্ঘটনাবশত বিস্ফোরিত হয়েছে, নাকি পরিকল্পিত হামলা, তা এখনও নিশ্চিত নয়। ঘটনার পর থেকেই বিশ্ববিদ্যালয় প্রশাসন ও শিক্ষার্থীরা হতবাক।
বিস্ফোরণে ব্যবহৃত গাড়ির রেজিস্ট্রেশন ছিল হরিয়ানার মহম্মদ সলমনের নামে। পুলিশ তাঁর কাছ থেকে তথ্য সংগ্রহ করে জানতে পারে, গাড়িটি সলমন প্রথমে দেবেন্দ্র নামে এক ব্যক্তির কাছে বিক্রি করেন। এরপর তা আমির, পরে তারিক, এবং সবশেষে উমর মহম্মদের হাতে পৌঁছায়। তবে গাড়ির নথিতে মালিকানার কোনো আনুষ্ঠানিক পরিবর্তন হয়নি— এই তথ্যও দিয়েছেন সলমন।
তদন্তকারীরা এখন উমর ও তার সহযোগীদের আর্থিক লেনদেন, ফোন রেকর্ড এবং কাশ্মীরে সম্ভাব্য যোগসূত্র খতিয়ে দেখছেন। যদিও দিল্লি পুলিশ এখনও পর্যন্ত ফরিদাবাদের বিস্ফোরক উদ্ধার ও লালকেল্লা বিস্ফোরণের মধ্যে কোনো সরাসরি সংযোগের কথা স্বীকার করেনি। চিকিৎসকদের জড়িয়ে থাকা এই সম্ভাব্য জঙ্গি নেটওয়ার্ক এখন দেশের গোয়েন্দা সংস্থাগুলির নজরের কেন্দ্রে। লালকেল্লা বিস্ফোরণ হয়ত ছিল সেই বড় ষড়যন্ত্রেরই অংশ, যা কাশ্মীর থেকে ফরিদাবাদ হয়ে পৌঁছেছে রাজধানী দিল্লির বুকে।
দিল্লি পুলিশ ও এনআইএ যৌথভাবে এই ঘটনার তদন্ত শুরু করেছে। তাঁরা এখন উমর নবির অনলাইন অ্যাকাউন্ট, ব্যাংক লেনদেন এবং কাশ্মীরে তাঁর পরিচিতদের যোগাযোগের দিক খতিয়ে দেখছেন। প্রাথমিক ধারণা, উমর কোনওভাবে ফরিদাবাদ–ভিত্তিক সন্ত্রাস মডিউলের সঙ্গে যুক্ত ছিল। একজন অন্তর্মুখী বিশ্ববিদ্যালয় শিক্ষক থেকে কীভাবে সন্দেহভাজন সন্ত্রাসীর তকমা— সেই প্রশ্নেই সরব গোটা দেশ।

Whatsapp
