বাম-ভোটে 'পৌষমাস' তৃণমূলের, নিরঙ্কুশ জয়ের পরেও তবু গলায় বিঁধে কাঁটা

West Bengal panchayat polls 2023: সামগ্রিক ভাবে পঞ্চায়েত নির্বাচনে নামমাত্র আসনে জয় এলেও এবারে ভোট-শতাংশ বেড়েছে সিপিএমের।

ব্যাপক সন্ত্রাস, রক্তপাত আর লাশের পাহাড়। সাঙ্গ পঞ্চায়েত নির্বাচন। প্রথমার্ধের ফলাফল ইতিমধ্যেই হাতে, এবং তা প্রত্যাশিত। ভোটের ফলাফলের ভিত্তিতে পশ্চিমবাংলার যদি একটা মানচিত্র আঁকা যেত, তাহলে দেখা যেত গোটা ম্যাপবইটাই প্রায় সবুজে ঢাকা। মাঝখানে কিছুটা বিজেপি আর খুব সামান্য পরিমাণ বাম-কংগ্রেস জেগে আছে। এটা সত্য, কিন্তু সার সত্য নয়। গণতন্ত্রে কোনও কালেই বিরোধীশূন্যতা কোনও কাজের কথা নয়। আর এ রাজ্যে গণতন্ত্র যে চলছে না, তা ভোটের দিনের সন্ত্রাসে স্পষ্ট। ভোটগণনার দিনেও যেভাবে ব্যালটবক্স লুঠ, ব্যালট গিলে ফেলা কিংবা ব্যালটের বাক্স নিয়ে চোঁ চোঁ দৌড়ের সাক্ষী থাকল বাংলা, তা চোখে আঙুল দিয়ে দেখিয়ে দেয় গণতন্ত্রের পায়া সজোরে কাটছে ঘুণপোকায়। আর আজ থেকে নয়, এই ঘুণের দৌরাত্ম্য শুরু হয়ে গিয়েছে সেই কবে থেকেই।

আরও পড়ুন: গ্রাম দখলের টোটকা এখনও শুভেন্দুর অধরাই! নন্দীগ্রাম পঞ্চায়েতে বিজেপি কেবলই বুদবুদ?

সিঙ্গুর-নন্দীগ্রামে জমি জবরদখলের লড়াই, নিরীহ মানুষের উপর গুলি। বুদ্ধিজীবীদের নড়েচড়ে বসা এবং রাজ্যের মানুষের সম্মিলিত প্রতিবাদ টলিয়ে দিতে পেরেছিল গদি। মানুষ জেগেছিলেন, লড়াই করেছিলেন, এবং বদলে ফেলেছিলেন সরকার। ৩৪ বছরের সাম্রাজ্যের উপর গড়ে উঠল নয়া মসনদ। গড় দখল করল তৃণমূল। মা-মাটি-মানুষের সরকার। তার পর কেটে গেছে তিন-তিনটে মেয়াদ। এর মধ্যে কেন্দ্রের মসনদেও পালাবদল ঘটেছে। কংগ্রেস জমানার পতন এবং বিজেপির মাথা তুলে দাঁড়ানো, সামগ্রিক ভাবে রাজ্য ও দেশীয় রাজনীতির সমীকরণটাই বদলে দিয়েছে। ক্রমে শক্তিক্ষয় হয়েছে সিপিএমের। প্রধান বিরোধীদলের লড়াই থেকেও ছিটকে গিয়েছে তৃণমূল, তার জায়গা দখল নিয়েছে বিজেপি। আপাতত তৃণমূলকে কাঁটায় কাঁটায় টক্কর দেওয়ার জন্য মূল বিরোধী শক্তি ভারতীয় জনতা পার্টিই। সিপিএম আরও ব্যাকফুটে। কিছুই 'কোথাও যদি নেই. তবু তো কজন আছি বাকি'- ঠিক সেভাবেই বাংলায় টিকে রয়েছে বামেরা। সাংগঠনিক শক্তি তলানিতে। হাতে পুঁজি বলতে কয়েকটা বাছা বাছা মুখ। যারা গ্রামবাংলায় নিয়ত গলা ফাটাচ্ছেন,লড়াই চালিয়ে যাচ্ছেন। ফিরে আসার জন্য মরণকামড় বসাতে চায় ৩৪ বছর আগে অস্তাচলে যাওয়া সূর্য।

গত পনেরো বছরে দুর্নীতির পাঁকে গলা অবধি ডুবে গিয়েছে শাসক দল। সারদা, নারদা হয়ে হালের কয়লা, গরুপাচার এবং শিক্ষাদুর্নীতি। সিবিআই, ইডির চোখরাঙানি, তাবড় নেতাদের দুর্ভোগ ও জেলভোগ। বাদবাকি দলের সম্পদ বলুন বা সেনাপতি, তাঁরা বেশিরভাগই দল বদলে বিজেপির সৈন্যে। আর যেটুকু বাকি থাকে, সেখানে দানা বেঁধেছে গোষ্ঠীকোন্দল। ফলে বলে দিতে হয় না, সামগ্রীক ভাবে বঙ্গে বিরাট চাপে রয়েছে তৃণমূল নেতৃত্ব। তাই ভোট জুড়ে এ হেন ক্ষমতার আস্ফালন, গুন্ডামি এবং সন্ত্রাস। পঞ্চায়েত ভোটে গ্রামবাংলায় সবুজ ঝড়। কারণ বহু জায়গাতেই জোর খাটিয়ে বিরোধীদের মনোনয়নটুকুই জমা দিতেই দেয়নি শাসক দল। 'ফেয়ার' লড়াই তো দূরের কথা। যেসব জায়গায় পাল্টা মার ফিরিয়ে দিয়েছে বিরোধীরা, সেখানেই রক্তে ভিজেছে মাটি।

শুধু মাত্র একটি পঞ্চায়েত ভোট, আর তাতেই লাশের সংখ্যা ছুঁয়ে ফেলল ৪০। যে কোনও সভ্য দেশের পক্ষেই যা লজ্জার। আর এ রাজ্যে সেটাই দস্তুর। প্রতিটি পঞ্চায়েত ভোট টপকে যাচ্ছে গতবারের সংখ্যা। আরও বাড়ছে মৃত্যু। পঞ্চায়েত জয়ের পর তৃণমূলের সর্বভারতীয় সাধারণ সম্পাদক অভিষেক বন্দ্যোপাধ্যায় বললেন, 'নো ভোট টু মমতা' স্লোগান পঞ্চায়েত নির্বাচনের ফলাফলের পর ফিরে এসেছে 'নাও ভোট ফর মমতা' হয়ে। তবে মুখে যা-ই বলুন না কেন, এই যে তৃণমূলের বিরুদ্ধে নিয়ত ওঠা দুর্নীতির অভিযোগ, ঘাড়ের কাছে আদালতের নিঃশ্বাস, চাকরিপ্রার্থীদের আন্দোলন, সরকারি কর্মচারীদের ডিএ-প্রতিবাদ, এ সবের ভিড়ে সত্য়িই কি ভোট জুড়ে ততটা আত্মবিশ্বাসী ছিল শাসক দল। যদি তা থাকতই, তাহলে যে কোনও উপায়ে জেতার এমন মরিয়া চেষ্টা থাকত কী!

তবে প্রশ্নটা সম্ভবত বিরোধীদের আত্মবিশ্বাসেরও। তৃণমূল জমানায় ওঠা দুর্নীতির অভিযোগ কার্যত টলিয়ে দিয়েছে পশ্চিমবঙ্গের শিক্ষার ভিতটাকেই। যেভাবে প্রাথমিক থেকে এসএসসি, প্রায় সব স্তরের নিয়োগেই দুর্নীতি হয়েছে এই সরকারের শাসনকালে, তা নিয়ে সত্যিই কি হেলদোল রয়েছে বিরোধীদের! সেদিক থেকে দেখতে গেলে সিঙ্গুর-নন্দীগ্রামের তুলনায় কোনও অংশে কম গুরুতর ছিল কি এই ইস্যু? তবু কোনও বিরোধীদলকেই সে নিয়ে তেমন বড় কোনও আন্দোলনের পথে যেতে দেখা গেল না, যতটা মারাত্মক ছিল জমি জবরদখল বিরোধী আন্দোলন। খুচরো পথে নামা এবং প্রতিবাদেই ফুরিয়ে গেল তার আগুন। নাকি শিক্ষা নিয়ে ছিনিমিনি তেমন কোনও বড় সমস্যা বলে ঠাহরই হয় না আর সাধারণ মানুষ কিংবা বিদ্বজনদের চোখে। না বিজেপি, না কংগ্রেস-সিপিএম জোট, ভোটের আগে কোনও দলকেই সেই অস্ত্রে শান দিতে দেখা গেল না। ব্যাপারটা ভাবলে অবাক লাগে না কি!

পঞ্চায়েতে প্রায় ৩৪ হাজার আসনে নিরঙ্কুষ জয় ছিনিয়ে আনল তৃণমূল। নানা বাধা বিপত্তিতে সম্পূর্ণ ভোটগণনা সম্পূর্ণ হয়নি। ফলে প্রথম দিনের কাজ গড়িয়েছে দ্বিতীয় দিনেও। গতবারের ধারা বজায় রেখেই এবারেও দ্বিতীয় স্থানে রয়েছে বিজেপি। ৯৬৫৬টি আসনে ইতিমধ্যেই জয় পেয়েছে তারা। সিপিএম জয়ী ২৯২৬টি আসনে এবং কংগ্রেস ২৫২৮টি আসনে। তবে এবার বিরোধী ভোটের অনেকটাই এসেছে বাম-কংগ্রেস জোটের থলিতে। প্রতিবারের মতো সমস্ত বিরোধী ভোটই বিজেপির ব্যাগে গিয়ে জমা হয়নি। আর সে কারণেই বোধহয় তৃণমূলের নিরঙ্কুষ জয় আরও কিছুটা নিশ্চিত হয়েছে।

বাংলার রাজনীতিতে বামেরা প্রায় নিশ্চিহ্ন। তবে বিচ্ছিন্ন ভাবে বিভিন্ন এলাকায় মাটি কামড়ে থাকতে চেষ্টার ত্রুটি করেনি সিপিএম। বহু অংশেই বিজেপির ভোট অনেকটাই কেটেছে বামেরা। বিশেষত মুর্শিদাবাদ, বাঁকুড়ায় বামেদের অবস্থান আগের চেয়ে ভালো হয়েছে। সামগ্রিক ভাবে পঞ্চায়েত নির্বাচনে নামমাত্র আসনে জয় এলেও এবারে ভোট-শতাংশ বেড়েছে সিপিএমের। মারাত্মক অশান্তি, হিংসা সত্ত্বেও ভাঙড়ে ভালো ফল করেছে বামেরা। তাতে তৃণমূলের ভোটবাক্সে দাঁত বসাতে না-পারলেও বহু জায়গাতেই শক্তিহীন করা গিয়েছে বিজেপিকে। সেটুকুই সান্ত্বনা। আবার গ্রাম পঞ্চায়েত স্তরে তৃণমূলের একচেটিয়া জয়ের নেপথ্যেও কার্যত কাজ করেছে সেই অঙ্কই।

গত লোকসভা ও বিধানসভা ভোটে লজ্জাজনক পরিস্থিতিতে পড়েছিল বামেরা। জনভিত্তি পৌঁছেছিল কার্যত তলানিতে। কিন্তু প্রতিবারের মতোই গ্রাম পঞ্চায়েত স্তরে সংগঠনকে উপরে তুলে আনার মরিয়া চেষ্টা চালিয়ে গিয়েছে সিপিএম। চালিয়েছে প্রচার। তার ফলাফল বিজেপিকে কিছুটা বিপাকে ফেললেও তৃণমূলের জন্য কিন্তু আখেরে 'পৌষমাস'ই  হয়ে এসেছে। হ্যাঁ, তবে এসবে স্বস্তি বলুন বা সান্ত্বনা একটাই, এর আগের নির্বাচনে বিরোধী ভোট যেভাবে একত্রিত হয়ে বিজেপির দিকে গিয়েছিল, সেই প্রবণতায় কিছুটা ছেদ ফেলা গিয়েছে। অন্তত পঞ্চায়েত ভোটে তো বটেই।

আর সেটুকুতেই আশার আলো দেখেছেন বামেরা। এই আকালের দিনে সেই পাওয়াটুকুকে সঙ্গী করেই দলের মনোবল বাড়ানোর চেষ্টা করছেন বাম নেতৃত্ব। বিক্ষিপ্ত দু-একজন ছাড়া দলে তেমন উজ্জ্বল মুখ নেই। সংগঠন বলেও প্রায় কিছু নেই। একটা সময় ছিল, সিপিআইএম প্রবীণ নেতাদের দল বলে বিশেষ দুর্নাম ছিল। তবে দিনে দিনে সমস্ত রবিই অস্তাচলে। এখন বামে নবীনদেরই দাপট। তবে তাঁরাও যে দলকে বিশেষ কোনও জায়গায় পৌঁছে দিতে পেরেছে, এমন প্রমাণ সাম্প্রতিক অতীতে নেই। তবু হিন্দুত্ববাদী শক্তির দাপটে যে কিছুটা হলেও থাবা বসাতে পেরেছে বামেরা, সেটুকুই স্বস্তির।

আরও পড়ুন: সন্ত্রাস ছাড়া জয় নেই! শেষ ২০ বছরে বাংলার পঞ্চায়েত মানেই লাশের রাজনীতি

তবে এই পঞ্চায়েত ভোটে শাসকদল যে সন্ত্রাসের সাহায্য নিয়েছে, তা কার্যত নজিরবিহীন। আর তা-ই চোখে আঙুল দিয়ে দেখিয়ে দিয়েছে, ভয় পেয়েছে তারা। যে হারে প্রতিদিন একটা একটা করে দুর্নীতি নজির ছাই ঘেঁটে উঠে এসেছে, তা স্বাভাবিক ভাবে বঙ্গ-রাজনীতিতে বিপাক-পরিস্থিতি তৈরি করেছে তৃণমূলের জন্য। যে সব নেতাদের হাত ধরে হাসতে হাসতে উতরে যেত পঞ্চায়েত ভোট, তাঁদের কেউ জেলে, কেউ বা দলবদলু হয়ে বিজেপিতে। ফলে পঞ্চায়েত দখলে রাখতে কড়া অবস্থান নেওয়া ছাড়া কী বা পথ খোলা ছিল শাসকের কাছে। শুধু ভোটের দিন হিংসা, গুন্ডামি নয়, ভোটগণনার দিনেও যেখানেই ব্যালটবাক্স কথা বলতে শুরু করেছে বিরোধীদের পক্ষে, অস্থির হয়ে উঠেছে তৃণমূল। কোথাও নেতাকর্মীরা ব্যালটবাক্স নিয়ে দৌড় লাগিয়েছেন, কোথাও বা পুড়িয়ে ফেলা হয়েছে, কোথাও আবার পুকুরে ছুঁড়ে ফেলে দেওয়া হয়েছে সেটিকে। কোথাও আবার আস্ত ব্যালট গিলে খেয়ে ফেলেছেন কর্মীরা। আর এর থেকেই স্পষ্ট, শাসকের ভিতরে ভিতরে কোথাও চেপে বসেছে গদি টলার ভয়। নিরঙ্কুশ জয়ও যেই ভীতিতে মলম লাগাতে পারছে না কিছুতেই।

More Articles