মোদি আর বিজেপি দুই-ই এবার ব্যাকফুটে || মুখোমুখি পরাকলা প্রভাকর
Exclusive Interview of Parakala Prabhakar: বিজেপি কি সত্যিই ২৩০-এর বেশি আসন পাবে না? হিন্দু-মুসলিম ন্যারেটিভের বাইরে গিয়ে ইলেক্টোরাল বন্ড নিয়ে আদৌ চিন্তিত মানুষ? ইনস্ক্রিপ্টের সঙ্গে একান্ত আলাপচারিতায় পরকলা প্রভাকর।
দ্য ক্রুকড টিম্বার অফ নিউ ইন্ডিয়া গ্রন্থটির আনুষ্ঠানিক উদ্বোধন উপলক্ষে কলকাতায় এসেছিলেন পরাকলা প্রভাকর। স্ত্রী-র হাতে দেশের অর্থমন্ত্রক, আর সেই অর্থনীতির প্রশ্নে বিজেপিকে ছিন্নভিন্ন করলেন তিনি। মঞ্চ থেকে স্পষ্ট বললেন, বিজেপি ক্ষমতায় ফিরলে মণিপুরের মতো পরিস্থিতি হতে পারে দেশের অন্যত্রও। ফলে ভোট দিতে হবে বিবেচনা করে। অনুষ্ঠান মিটতেই এই নিভৃতকথার সুযোগ এল প্রবীণ রাজনৈতিক-অর্থনীতিবিদের সঙ্গে।
অর্ক: ভোটের গাড়ি এগোচ্ছে। হাতে আর ২৫-২৬ দিন রয়েছে। আপনি শুরু থেকে বলছিলেন, বিজেপি ২৩০টির বেশি আসন পাবে না। আপনি এখনও এই তত্ত্বে অটল?
প্রভাকর: যে ধরনের খবর দু'দফা ভোটের পর পেয়েছি, তাতে দেখতে পাচ্ছি বিজেপি ব্যাকফুটে আছে। এর আরেকটা প্রমাণ বিজেপির প্রচারের ধরন। দেখবেন, দলীয় নেতৃত্ব বিশেষত নরেন্দ্র মোদি প্রচারের সুরই বদলে ফেলেছেন। প্রধানমন্ত্রী একদম খুল্লামখুল্লা সাম্প্রদায়িক কথাবার্তা বলছেন। এমন নয় কিন্তু যে প্রধানমন্ত্রী ইশারা, ইঙ্গিত করছেন। আমি বলছি, একদম আদাজল খেয়ে নেমে সাম্প্রদায়িক কথাবার্তা বলছেন। তার মানে আর 'আচ্ছে দিন', 'বিকাশ', 'কৃষকের দ্বিগুণ আয়', 'কালো টাকা দেশে ফেরানো'-র কথায় চিঁড়ে ভিজবে না। শেষ দু'টো নির্বাচনে এই কথাগুলি বিজেপির পক্ষে গিয়েছিল। এমনকী বাহুবলী জাতীয়তাবাদের কথাও বলছে না তারা। তারা শুধু হিন্দু-মুসলিম করছে, বলছে হিন্দু নারীর মঙ্গলসূত্র নিয়ে নেওয়া হবে। কাজেই তাদের যেখানে যেটুকু সমর্থক রয়েছে, তা ধরে রাখতেই এই ধরনের অস্ত্র প্রয়োগ করা হচ্ছে। অন্যের কথাকে হিন্দু বিরোধী বলে দাগিয়ে বিকৃত প্রচার করা হচ্ছে। ওরা নিজেদের যেটুকু আছে তা ধরে রাখতেই এখন মরিয়া।
অর্ক: আপনি আশাবাদী বুঝলাম কিন্তু মাঠে রেফারি যদি ঠিক না থাকে, তবে খেলার ফলে তার প্রভাব পড়তে বাধ্য। নির্বাচন কমিশনের আচরণ কি পক্ষপাতদুষ্ট নয়? বিশেষত যেভাবে ভোটদাতাদের সংখ্যা না প্রকাশ করে শতাংশ প্রকাশ করা হচ্ছে, এই ঘটনাকে কীভাবে দেখেন আপনি?
প্রভাকর: সত্যিই নির্বাচন কমিশনের অভিসন্ধি নিয়ে প্রশ্ন তোলার অবকাশ থাকছে। আমি এমন বলছি না যে, নির্বাচন কমিশন পক্ষপাতদুষ্ট এ ব্যাপারে আমি নিশ্চিত। কিন্তু সন্দেহের অবকাশ থাকছে। মূলত দু'টো কারণে আশঙ্কা। এক, এই নির্বাচন কমিশনারদের নিয়োগের সময়ে সুপ্রিম কোর্টের কোনও পর্যবেক্ষক রাখা হলো না। কমিটিতে সরকারের সংখ্যাগরিষ্ঠতা ছিল। প্রধানমন্ত্রী নিজে একজন নিয়োগকারী, সঙ্গে ছিলেন তাঁরই অনুমোদিত একজন সাংসদ। ফলত, এটাকে এক্সিকিউটিভ অ্যাপয়েন্টমেন্ট বলা চলে। এখন এভাবে যারা নিযুক্ত হলো তারা শাসকের বিরোধিতা করবে, এটা বিশ্বাস করা কঠিন। তাঁরা বিজেপির বিরুদ্ধে যাবে, এমনটা ভাবা যাচ্ছে না।
আরও পড়ুন- শুধু প্রসাদ বিতরণ নয়, লাগবে কর্মসংস্থান
দ্বিতীয়ত, আপনি যদি এই সাত দফা নির্বাচনের দিন-তারিখ-জায়গা খতিয়ে দেখেন, মনে হবে শাসকদলের বড় নেতারা যাতে সর্বত্র বিচরণ করতে পারেন সে কথা মাথায় রেখেই এই পরিকল্পনা করা। আর ভোটদানের হার শতাংশে জানানো, যে কথাটা আপনি বললেন, তা-ও দীর্ঘ সময়ের ব্যবধানে। প্রথমে তারা যে ভোট শতাংশ বলেছিল আর শেষে যে ভোট শতাংশ বলল, দেখা গেল তার মধ্যে বড় ব্যবধান রয়েছে। আমি তথ্য না দেখে বলতে পারব না যে এখানে কারচুপি হয়েছেই, কিন্তু ওই, সন্দেহের যথেষ্ট অবকাশ থাকছে। একটা গণতান্ত্রিক দেশে গোটা নির্বাচন প্রক্রিয়াকে সন্দেহের ঊর্ধ্বে থাকতে হবে। কেউ যেন আঙুল না তুলতে পারে। আমি চাই না, আমার দেশের নির্বাচন কমিশন যা সংবিধান স্বীকৃত, তার কার্যকলাপ, কর্মপদ্ধতি নিয়ে প্রশ্ন উঠুক। দেশের কোনও সচেতন মানুষ এ জিনিস বরদাস্ত করবে না।
অর্ক: আপনি বলছেন নির্বাচনী বন্ডে টাকা নেওয়া এবং বিনিময়ে বড় সুবিধে পাইয়ে দেওয়ার ঘটনার বড় প্রভাব পড়বে নির্বাচনের ফলে। ইলেক্টোরাল বন্ডের সারবস্তুটা রাজনৈতিক নেতারা ঘরে ঘরে পৌঁছে দিতে পারলেন? দু'একটি ব্যতিক্রম বাদ দিলে প্রত্যেকের পা-ই তো পচা শামুকে কেটেছে। রাফালের মতোই আরেকটা নিষ্ফলা ইস্যু নয় তো এই বন্ড?
প্রভাকর: ইলেক্টোরাল বন্ডের সূক্ষ্মতিসূক্ষ্ম দিকগুলি সবাই না-ও বুঝতে পারে। যেমন বহু বিষয় আপনি আমিও বুঝি না। সবাই সবটা বুঝবে এমন প্রত্যাশা রাখাও অন্যায়। কিন্তু এটুকু সবাই বুঝবে, দেনাপাওনা হয়েছে। আপনার মনে থাকবে, ২০১৪ সালে টু-জি স্পেকট্রাম নিয়ে প্রবল হইচই হয়েছিল। টু-জি স্পেকট্রাম নিয়ে খুব কম লোকেরই স্পষ্ট ধারণা রয়েছে কিন্তু সকলেই বোঝে কোথাও একটা বড় ঘাপলা হয়েছে। আপনি রাফালের কথা বলছিলেন। মানুষ প্রথম, দ্বিতীয় অন্যায় মেনে নিয়েছে বলে তৃতীয় অন্যায়টাও মেনে নেবে, এমন ভাবার কোনও কারণ নেই। গতকাল মানুষ যা মেনে নিয়েছিল আজও তা সে সহ্য করবেই এমন দাসখত লিখে কেউ গণতন্ত্রে বাস করে না। আপনি একটা ১০ কেজি ওজনের জিনিস ৫ মিনিটের জন্য ধরে রাখতে পারবেন কিন্তু এমন হতেই পারে ১১ মিনিটের বেলায় আপনার হাত ছিঁড়ে আসছে। মনে হচ্ছে, এই ভার অসহনীয়। ফলে একের পর এক ঘটনা সামনে আসা, পাশাপাশি মানুষের জীবন-জীবিকা সংক্রান্ত নানা প্রশ্নে তুমুল ব্যর্থতা মানুষকে বিদ্রোহী করে তুলবেই।
অর্ক: এই ভোটের মূল ইস্যুগুলি কী কী? বিজেপি কেন মূল ইস্যু থেকে নজর ঘুরিয়ে আমাদের মাছ-মঙ্গলসূত্র-মন্দিরে নিয়ে আসছে?
প্রভাকর: আমরা একটা অর্থনৈতিক দুরবস্থার মধ্যে রয়েছি। তরুণ ছেলেমেয়েদের হাতে কোনও কাজ নেই। শাসক দলের বিরুদ্ধে দুর্নীতির ভয়াবহ অভিযোগ রয়েছে। আবার বিদেশনীতির ক্ষেত্রেও আমরা যথেষ্ট ভয়ের জায়গায় আছি। চিন আমাদের ভূখণ্ডের অনেকটা দখল করে নিয়েছে। এই সবক'টা বিষয়কে এক সুতোয় গাঁথলে বিজেপি বিপাকে পড়বে বলেই মনে হয়। এই কারণেই বিজেপি হিন্দু-মুসলিম ন্যারেটিভ তৈরি করছে। মঙ্গলসূত্র নিয়ে মন্তব্য করছেন প্রধানমন্ত্রী।
আরও পড়ুন- বাংলার একপেশে রাজনীতি বিজেপিকে জায়গা করে দিল । মুখোমুখি দীপঙ্কর ভট্টাচার্য
অর্ক: অমিত শাহ একটি সাম্প্রতিক সাক্ষাৎকারে চাকরি নিয়ে প্রশ্ন করা হলে বলেন, এয়ারপোর্ট, রাস্তা হয়ছে, তাতে কিছু কাজ সৃষ্টি হয়েছে। সরকার কি কর্মসংস্থান নিয়ে আদৌ ভাবছে?
প্রভাকর: সবাই সরকারি চাকরি চাইছে এই কথাটা তো ঠিক নয়। একটা সম্ভাবনাময় অর্থনীতির কথা বলা হচ্ছে। যাতে কাজের সুযোগ তৈরি হয়। কেউ বলছে না, আমাকে সেক্রেটারি বানিয়ে দাও, আমাকে ক্লার্ক বানিয়ে দাও কিন্তু আমাকে জীবিকা নির্বাহ করার একটা ভদ্রস্থ উপায় বাতলে দাও— এ কথাটা সবাই বলছে। এটা কি ন্যায্য দাবি নয়? আপনি কাজের চাহিদাটা ভেবে দেখুন। ভারতীয় রেলের ৩৫ হাজার শূন্যপদে এক কোটি পঁচিশ লক্ষ লোক আবেদন করেছে। এই পরিস্থিতিতে, সম্প্রতি ভারত সরকারের প্রধান আর্থিক উপদেষ্টা বলে দিয়েছেন, কর্মসংস্থান বিষয়ে ভাবা নাকি সরকারের কাজই নয়। তাহলে বোঝাই যাচ্ছে কাজ সৃষ্টির বিষয় থেকে তারা গা বাঁচাতে চাইছে। আপনি যে সামগ্রিক আর্থিক দুরবস্থা দেখছেন, কাজ নেই, মানুষের সঞ্চয় কমছে, ধার বাড়ছে এগুলি এই সরকারকে ভূতের মতো তাড়া করবে।
অর্ক: বিজেপি উত্তর ভারতের ক্ষয়, দক্ষিণ ভারতে বিশেষত কেরল তামিলনাড়ুতে পূরণ করে ফেলবে পারবে না?
প্রভাকর: আমার মনে হয় না ওরা পারবে। দেখা যাক। চলুন প্রতিটি দফা ধরে ধরে আমরা অঙ্ক কষি। আমি আশা রাখছি।