উন্মত্ত ট্রাম্পের মাদকবিরোধী অভিযান ভেনেজুয়েলায়! মার্কিন মিডিয়া চুপ কেন?
Venezuela crisis: ট্রাম্প শুধু সমুদ্রেই নয়, 'স্থল ভাগে' কথিত মাদকচক্রকেও আঘাত হানার হুঁশিয়ারি দিচ্ছেন— যা বাস্তবে ভেনেজুয়েলার বিরুদ্ধে সরাসরি সামরিক অভিযান ঘোষণার সমতুল্য।
নেশা, অপরাধ ও নিরাপত্তার বয়ানকে কেন্দ্র করে যুক্তরাষ্ট্র দীর্ঘদিন ধরে 'নার্কো-স্টেট' ধারণাকে রাজনৈতিক অস্ত্র হিসেবে ব্যবহার করে আসছে, কিন্তু মার্কিন মূলধারার সংবাদমাধ্যম এই বয়ানটির ভ্রান্তি, উদ্দেশ্য এবং প্রমাণহীনতার দিকে সচরাচর আঙুল তোলে না। এই নীরবতা শুধু তথ্যগত ঘাটতি নয়; বরং যুক্তরাষ্ট্রের বৈদেশিক নীতি, সামরিক কৌশল, ভূ-রাজনৈতিক স্বার্থ এবং কর্পোরেট লবির সম্মিলিত কাঠামোগত চাপের ফল। ফলে জনমত যেন সহজ ভাবে বিশ্বাস করে ক্যারিবিয়ানে, আন্দেস অঞ্চলে বা ভেনেজুয়েলার মতো দেশগুলি মাদকচক্র নিয়ন্ত্রিত রাষ্ট্র, এবং তাই যুক্তরাষ্ট্রের হস্তক্ষেপ ন্যায্য। কিন্তু বাস্তবতা ও প্রমাণ— দু'টিই প্রায়শই এই বয়ানের বিপরীত কথা বলে।
সেপ্টেম্বর থেকে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র ক্যারিবিয়ান সাগর ও প্রশান্ত মহাসাগরে প্রায় দু'ডজন হামলা চালিয়েছে, এতে ৮০ জনেরও বেশি মানুষ নিহত হয়েছে। সর্বশেষ হামলায় আরও চারজন নিহত হয়েছেন। তবুও ট্রাম্প প্রশাসন দাবি করা কথিত 'মাদক পাচারকারীদের' বিষয়ে কোনো প্রমাণ হাজির করেনি— নৌকাগুলিতে মাদক ছিল কি না, তারা যুক্তরাষ্ট্রের দিকে যাচ্ছিল কি না, কিংবা আদৌ কোনো আইনগত ভিত্তিতে এই হামলা চালানো হলো কি না কোনো কিছুই ব্যাখ্যা করা হয়নি। অনেক আন্তর্জাতিক আইন বিশেষজ্ঞ ইতোমধ্যেই বলেছেন, মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের এই হামলাগুলি আন্তর্জাতিক আইন লঙ্ঘন করছে। কিন্তু এই মৌলিক প্রশ্নগুলি মার্কিন সংবাদমাধ্যমের বড় অংশেই গায়েব। বরং মিডিয়া দ্রুত সরকারের প্রচারিত 'মাদকবিরোধী অভিযান' বয়ানকে পুনরাবৃত্তি করে। ইতিহাস বলে, যুক্তরাষ্ট্র যখনই কোনো অঞ্চলে শাসন পরিবর্তন বা রাজনৈতিক চাপ বাড়ানোর চেষ্টা করে, তখনই ‘নার্কো-স্টেট’ বা ‘মাদক-সন্ত্রাসবাদী’ ট্যাগটি হাজির হয়। এবারও ভেনেজুয়েলাকে এই ছাঁচেই ফেলা হয়েছে।
ট্রাম্প শুধু সমুদ্রেই নয়, 'স্থল ভাগে' কথিত মাদকচক্রকেও আঘাত হানার হুঁশিয়ারি দিচ্ছেন— যা বাস্তবে ভেনেজুয়েলার বিরুদ্ধে সরাসরি সামরিক অভিযান ঘোষণার সমতুল্য। ইতোমধ্যে বিশ্বের বৃহত্তম বিমানবাহী রণতরী ইউএসএস জেরাল্ড আর ফোর্ড, হাজার হাজার মার্কিন সেনা ও এফ-৩৫ যুদ্ধবিমান ক্যারিবিয়ানে মোতায়েন করা হয়েছে— যা কয়েক দশকের মধ্যে এই অঞ্চলে যুক্তরাষ্ট্রের সবচেয়ে বড় শক্তি প্রদর্শন। ভেনেজুয়েলার উপকূলের এত কাছে মার্কিন যুদ্ধবিমান শনাক্ত হওয়ায় কারাকাস সরকার এটিকে 'ঔপনিবেশিক হুমকি', 'মিলিটারি হ্যারাসমেন্ট' ও দেশের সার্বভৌমত্বে আঘাত বলে চিহ্নিত করেছে। ভেনেজুয়েলার প্রতিরক্ষামন্ত্রী ভ্লাদিমির পাদ্রিনো লোপেজ জানিয়েছেন বিমানগুলি দেশের উপকূল থেকে মাত্র ৭৫ কিমি দূরে উড়ছিল— যদিও আকাশসীমা ভাঙেনি, তবুও এই উপস্থিতিকে ভেনেজুয়েলার সরকার উস্কানি হিসেবেই বিবেচনা করছে। মার্কিন মিডিয়া এসব আইনি প্রশ্ন, সার্বভৌমত্বের সংকট বা সামরিক সহিংসতার প্রমাণগুলি নিয়ে প্রায় নীরব।
আরও পড়ুন
ট্রাম্প বনাম মাদুরো: কিউবান মিসাইল সংকটের ছায়া কি ফিরছে?
মার্কিন সংবাদমাধ্যমের নীরবতা যে রাজনৈতিক ভাবে সুবিধাজনক তা স্পষ্ট হয়ে ওঠে যখন দেখা যায়, ট্রাম্প প্রশাসন কংগ্রেসকে জানিয়েছে যুক্তরাষ্ট্র এখন নাকি 'মাদক কার্টেল'-এর বিরুদ্ধে 'অ-আন্তর্জাতিক সশস্ত্র সংঘাত'-এ নিযুক্ত, অর্থাৎ বিদেশি কার্টেলের সদস্যরা হবে 'বেআইনি যোদ্ধা'— এটিও মূলত একটি আইনি ফাঁক তৈরি করে নির্বিচার অভিযানকে বৈধ দেখাতে। পরে এই কার্টেলগুলিকে 'নার্কো-সন্ত্রাসবাদী' হিসেবে পুনরায় ব্র্যান্ড করা হলো, যা যুক্তরাষ্ট্রের সামরিক হস্তক্ষেপকে আরও সহজে তুলে ধরার কৌশল। যুক্তরাষ্ট্রের প্রেসিডেন্টের কথায় ভেনেজুয়েলার আকাশসীমা 'বন্ধ'— যা আন্তর্জাতিক আইন, বাণিজ্যিক উড্ডয়ন ও আঞ্চলিক শান্তির উপর সরাসরি প্রভাব ফেলে। অথচ এসব পদক্ষেপের প্রয়োজনীয়তা বা প্রমাণ নিয়ে মার্কিন সংবাদমাধ্যমের গভীর অনুসন্ধান নেই; বরং সরকারি বয়ান বারবার প্রতিষ্ঠা পায়।
ভেনেজুয়েলার ভেতরে এ পরিস্থিতি তৈরি করেছে ভয়, বিভক্তি ও অনিশ্চয়তার পরিবেশ। মার্কিন চাপকে নোবেল শান্তি পুরস্কার প্রাপক মারিয়া কোরিনা মাচাদো-র নেতৃত্বে কিছু মানুষ স্বাগত জানাচ্ছে বলে মনে হলেও জরিপগুলি বলে— বাস্তবে ভেনেজুয়েলার বিপুল সংখ্যাগরিষ্ঠ নাগরিক অর্থনৈতিক নিষেধাজ্ঞা, সামরিক হস্তক্ষেপ বা বিদেশি হামলার বিরোধিতা করে। গবেষণা সংস্থা 'ডাটানালিসিসের' জরিপ অনুযায়ী, ৫৫ শতাংশ মানুষ অর্থনৈতিক নিষেধাজ্ঞার বিপক্ষে, ৫৫ শতাংশ বিদেশি সামরিক হামলারও বিরোধী। তাদের উদ্বেগ— বেসামরিক মৃত্যু, গৃহযুদ্ধ, বিশৃঙ্খলা ও অর্থনীতির আরও ধস। তারা জানে অতীতে পানামা, লিবিয়া, সিরিয়া কিংবা ইরাকে যুক্তরাষ্ট্রের হস্তক্ষেপ কোনো দেশেই স্থিতিশীলতা আনেনি, বরং ধ্বংস, শাসন-শূন্যতা, অস্ত্রবাহী গোষ্ঠী ও মানবিক বিপর্যয় সৃষ্টি করেছে।
সাধারণ ভেনেজুয়েলানদের বড় অংশের দলীয় রাজনৈতিক পরিচয় নেই, ৬০ শতাংশ মানুষ সরকার বা বিরোধী কারও পক্ষেই নয়। তাদের প্রধান উদ্বেগ বেঁচে থাকা, মূল্যস্ফীতি, নিরাপত্তা ও কাজ। কিন্তু মার্কিন মূলধারার সংবাদমাধ্যম এই মানবিক বাস্তবতার চেয়ে বেশি গুরুত্ব দেয় ট্রাম্প প্রশাসনের বয়ান, সামরিক কৌশল বা 'মাদক দমন'-এর চাঞ্চল্যকর উপস্থাপনাকে। ফলে আঞ্চলিক বাস্তবতা— ভেনেজুয়েলার বিশাল তেল, গ্যাস, সোনা, ইউরেনিয়াম ও খনিজ সম্পদের জন্যই যুক্তরাষ্ট্র আগ্রহী— তা আলোচনায় আসে না। অথচ তরুণ ভেনেজুয়েলানদের বড় অংশ মনে করে যুক্তরাষ্ট্রের আগ্রহ আসলে এসব কৌশলগত সম্পদের প্রতি, গণতন্ত্র বা 'মাদকবিরোধী' নীতির প্রতি নয়। মার্কিন অভিযানগুলি যে মানবিক ক্ষতি করছে— মোট নিহতের সংখ্যা ৮০ ছাড়িয়ে গিয়েছে, এ সব নিয়ে আন্তর্জাতিক পর্যবেক্ষকরা 'বেআইনি হত্যাকাণ্ড' বলছেন। কিন্তু এ বিষয়েও যুক্তরাষ্ট্রের সংবাদমাধ্যমে খুব কম প্রতিবেদন প্রকাশিত হচ্ছে। বরং তারা এই অভিযান গুলিকে ট্রাম্পের 'মাদক দমন' উদ্যোগ হিসেবে তুলে ধরছে— এ যেন এক পূর্বপরিচিত স্ক্রিপ্ট, যেখানে শত্রু হিসেবে চিহ্নিত দেশকে প্রথমে 'নার্কো-স্টেট' বলা হয়, পরে মানবিক সংকট ও সামরিক অভিযানকে ন্যায়সঙ্গত করা হয়, আর শেষে শাসন পরিবর্তনের চেষ্টা করা হয়।
আরও পড়ুন
মাচাদো: শান্তির মুখোশে সাম্রাজ্যবাদী ছায়া পুতুল
এখন ভেনেজুয়েলার সরকারও পাল্টা শক্তি প্রদর্শনে নেমেছে— সেনা সমাবেশ, বিমান-বিধ্বংসী ব্যবস্থা, 'ব্যাপক মোবিলাইজেশন'— দু'টি রাষ্ট্রই এখন এমন এক সীমানার দিকে এগোচ্ছে যেখানে একটি ভুল হিসাব যুদ্ধ ডেকে আনতে পারে। সাধারণ মানুষও দ্বিধাগ্রস্ত, কেউ কেউ উন্নতির আশা করছে, কেউ ভয়ে খাবার মজুত করবে বলেও ভাবছে, কেউ পরিবারকে নিয়ে আশ্রয় খুঁজবে, কেউ আবার বিশ্বাসে ভর করে ভাবে কিছুই হবে না। তাদের জীবনের এই বাস্তব সংকট কিন্তু মার্কিন মিডিয়ার আলোচনার অন্তর্ভুক্ত নয়।
স্পষ্টই বোঝা যাচ্ছে, 'নার্কো-স্টেট' বয়ানটি যুক্তরাষ্ট্রের ভূ-রাজনৈতিক স্বার্থ রক্ষার একটি হাতিয়ার। মিথ্যা বা অর্ধসত্য তথ্য ব্যবহার করে কোনো দেশকে অস্থিতিশীল বলে চিহ্নিত করা, সামরিক উপস্থিতিকে ন্যায়সঙ্গত করা, শাসন পরিবর্তনকে গ্রহণযোগ্য করে তোলা— এই বড় কৌশলেরই অংশ। মার্কিন মিডিয়া এই প্রচারযন্ত্রের অংশ হয়ে ওঠে কারণ তারা সরকারি সূত্র, সামরিক ব্রিফিং ও কর্পোরেট স্বার্থের প্রতি নির্ভরশীল; আর দক্ষিণ গোলার্ধের বাস্তবতা, মানবিক ক্ষতি বা রাজনৈতিক জটিলতা তাদের কভারেজে জায়গা পায় না। যারা যুক্তরাষ্ট্রের বাইরে থাকে, তাদের জন্য সত্যের শেষ পরিমাপ হয় মার্কিন রাষ্ট্রের বয়ান— এতে মিথ ভাঙা তো হয়ই না, বরং সেই মিথই আরও শক্তিশালী হয়ে ওঠে। ভেনেজুয়েলার উপকূলের কাছে মার্কিন যুদ্ধবিমান, সামরিক মিশন ও আইনি অসঙ্গতির প্রমাণ থাকা সত্ত্বেও 'নার্কো-স্টেট' নামে এক প্রমাণহীন গল্পকেই মিডিয়া প্রতিধ্বনিত করে চলেছে— যা আজকের বৈশ্বিক তথ্যব্যবস্থার গভীরতম সংকটগুলির একটি প্রতিফলন।
Whatsapp
