দশ বছর পর পাহাড়ে ভোট, গোর্খারা পেতে চলেছে নতুন নেতা?
এবারের ভোট হচ্ছে মোট ৯২২টি বুথে৷ ভোটার সংখ্যা ৭ লক্ষ ৩২ হাজার৷ পাহাড়ের ভোটের ইতিহাস বলছে, ৫ লক্ষর কাছাকাছি ভোটার আসতে পারেন ভোটকেন্দ্রে৷
বৃষ্টি চলছে৷ ঠান্ডাও বাড়ছে৷ কুয়াশা নেমে এসেছে রাস্তায়৷ তবে কোনওকিছুকেই আমল না দিয়ে পাহাড়ে জাঁকিয়ে বসেছে ভোটের গরম৷ শৈলশহরে আজ ভোট৷ শুধুই পাহাড়ে নয়, একযোগে ভোট চলছে সমতলেও৷ পাহাড়ে জিটিএ বা গোর্খাল্যান্ড টেরিটোরিয়াল অ্যাডমিনিস্ট্রেশনের দখল কার হাতে যাবে, সেই ভোট হচ্ছে ১০ বছর পর। আর সমতলের শিলিগুড়ি মহকুমা পরিষদের নির্বাচন ৭ বছর পর। যতই পারদ নামুক, সব ভোটেই আলাদা এক উত্তাপ গ্রাস করে প্রার্থী, দল, ভোটার আর প্রশাসনকে৷ এক্ষেত্রেও তার ব্যতিক্রম হয়নি৷ পাহাড়-সমতলে একই উত্তাপ সকাল থেকেই নজরে এসেছে৷
রাজনৈতিক মহলের নজর পাহাড়ের দিকেই৷ ২০১২-র নির্বাচনে বিনা প্রতিদ্বন্দ্বিতায় জয়ী হয়ে জিটিএ দখল করেছিলেন বিমল গুরুংরা৷ ২০১৭-তে জিটিএ-র মেয়াদ শেষ হলেও পরবর্তী টানা ৫ বছর প্রশাসকের মাধ্যমে চলেছে গোর্খাল্যান্ড টেরিটোরিয়াল অ্যাডমিনিস্ট্রেশন। ১০ বছরের মাথায় এবার ভোট হচ্ছে৷
পাহাড়ে গুরুত্বপূর্ণ নির্বাচন হচ্ছে, অথচ কোথাও নেই পাহাড়ের এতদিনের মুকুটহীন সম্রাট বিমল গুরুং! গুরুং-রোশন গিরিদের দল গোর্খা জনমুক্তি মোর্চা এবারের নির্বাচনের বিরোধিতা করেছে৷ গুরুং বলেই দিয়েছেন, তিনি এবং মোর্চার সাধারণ সম্পাদক রোশন গিরি এবার ভোট দিতেও যাবেন না। গুরুং রাজ্যের শাসক দল তৃণমূলের জোটসঙ্গী৷ তবুও জিটিএ নির্বাচনের বিরোধিতাই করেছে মোর্চা৷ নিজেকে জিটিএ নির্বাচন থেকে নিজেকে সরিয়ে নিলেও একেবারে শেষ মুহূর্তে নির্দলদের সমর্থনের বার্তা দিয়েছেন গুরুং। তবে পাহাড়ে এখন গুরুংয়ের জনপ্রিয়তা তলানিতে ঠেকেছে৷ ২০২১-এর বিধানসভা ভোটে তৃণমূল কংগ্রেসকে সমর্থনের বার্তা দিলেও মোর্চার প্রার্থীরা কিছুই করতে পারেনি। উল্টে গোর্খা জনমুক্তি মোর্চার গুরুং-গোষ্ঠী এবং তামাং-গোষ্ঠীর দ্বন্দ্বের ফায়দা তুলে নিয়েছে বিজেপি। বিনয় তামাংয়ের গোষ্ঠী একটি আসন দখল করলেও বিমল গুরুং শিবির শূন্য হয়ে গিয়েছিল। তখনই গুরুংয়ের পতন শুরু হয়৷
আরও পড়ুন: রাষ্ট্রপতি হওয়ার দৌড়ে কতটা এগিয়ে দ্রৌপদী মুর্মু? বিরোধীদের এই ব্যর্থতাই বিজেপির তাস
জিটিএ ভোটে গুরুংয়ের শূন্যতা এবার ভরিয়ে দিয়েছে ধুমকেতুর মতো উঠে আসা অজয় এডওয়ার্ডসের হামরো পার্টি৷ দার্জিলিং-এর নস্টালজিক Glenary's-এর কর্ণধার অজয় এডওয়ার্ডস৷ দার্জিলিং পুরসভা ভোটে সবাইকে চমকে দিয়ে পাহাড়ে মাথা তুলে দাঁড়ায় হামরো পার্টি। অজয় এডওয়ার্ডসের দল মাত্র ৪-৫ মাসেই পাহাড়ের রাজনীতিতে ফ্যাক্টর হয়ে গিয়েছে। কিছুদিন আগে হয়ে যাওয়া পুরভোটে একক কৃতিত্বে দার্জিলিং পুরসভা দখল করে হামরো পার্টি। দ্বিতীয় হয় অনীত থাপার গোর্খা জনমুক্তি মোর্চা। এবার নির্বাচনে নেই বিজেপি ও জিএনএলএফের মতো দলগুলি। সিপিএম এই ভোটে ১২ প্রার্থী দিয়েছে। কংগ্রেস লড়ছে ৫ আসনে৷
জিটিএ-র দখল নিতে এবার সম্মুখ সমরে অনীত থাপার ভারতীয় গোর্খা প্রজাতান্ত্রিক মোর্চা এবং অজয় এডওয়ার্ডসের হামরো পার্টি৷ গুরুং-মিথ মুছে দিয়ে পাহাড়ের মসনদে বসতে মরিয়া অজয়-অনীত, দু'পক্ষই৷ ২০১২-র প্রথম জিটিএ নির্বাচনে নজর কেড়েছিল নির্দল প্রার্থীদের ভিড়৷ এবারও তাই৷ ৪৫ আসনের এই নির্বাচনে মোট ২৭৭ প্রার্থীর মধ্যে ১৮৭ জনই নির্দল৷ ওদিকে অনীত থাপার ভারতীয় গোর্খা প্রজাতান্ত্রিক মোর্চা ৩৬ আসনে প্রার্থী দিলেও বহু আসনে নির্দলদের সমর্থন করছে। বাংলার শাসক তৃণমূল কংগ্রেস লড়ছে ১০ আসনে। তবে পাহাড়ের গুঞ্জন, তৃণমূল এবার অনীত থাপার ভারতীয় গোর্খা প্রজাতান্ত্রিক মোর্চার সঙ্গে একসঙ্গে লড়ছে৷ তবে অনীত থাপা একথা মানতে চাননি৷ তাঁর দাবি, 'কোনও আসনেই আমরা এক হয়ে লড়াই করছি না। জিটিএ বোর্ড আমরাই গঠন করব। আমাদের প্রার্থী ৩৬ আসনে থাকলেও বাকি আসনে আমরা নির্দলদের সমর্থন করছি।’ এদিকে ৪৫ আসনের সবক'টিতেই নিজেদের প্রার্থী দাঁড় করিয়েছে একমাত্র হামরো পার্টি। এই ভোটে লড়াই মূলত হামরো পার্টি এবং ভারতীয় গোর্খা প্রজাতান্ত্রিক মোর্চার মধ্যে৷ হামরো পার্টির দাবি, 'আমাদের জয় নিশ্চিত। নির্দলদের নিয়ে চিন্তিত নই৷ পাহাড়ের মানুষ আমাদেরই ভোট দেবে।' ওদিকে, হাওয়া অফিস আজও বৃষ্টির পূর্বাভাস দিয়েছে৷ স্বাভাবিকভাবেই এতে চিন্তিত সব পক্ষই। এবারের ভোট হচ্ছে মোট ৯২২টি বুথে৷ ভোটার সংখ্যা ৭ লক্ষ ৩২ হাজার৷ পাহাড়ের ভোটের ইতিহাস বলছে, ৫ লক্ষর কাছাকাছি ভোটার আসতে পারেন ভোটকেন্দ্রে৷
এবার পাহাড়ে পালাবদল হচ্ছেই৷ গোর্খারা এবার পেতে পারেন নতুন নেতা৷
শিলিগুড়ি মহকুমা পরিষদ
অন্যদিকে ৭ বছর পর আজই কড়া নিরাপত্তায় ভোট হচ্ছে শিলিগুড়ি মহকুমা পরিষদের৷ মহকুমা পরিষদের ৯টি আসনের পাশাপাশি ৪টি পঞ্চায়েত সমিতির এবং ২২টি গ্রাম পঞ্চায়েতের ভোট চলছে৷ শিলিগুড়ি মহকুমা পরিষদ নির্বাচনে মোট আসন সংখ্যা ৫৩৭টি। যার মধ্যে ২২টি গ্রাম পঞ্চায়েতের আসন সংখ্যা ৪৬২। ৪টি পঞ্চায়েত সমিতির আসন সংখ্যা ৬৬ ও মহকুমা পরিষদের আসন সংখ্যা ৯। বিভিন্ন দলের মোট প্রার্থীর সংখ্যা ১৪৪২ জন৷ মোট ভোটার সংখ্যা ৫ লক্ষ ২৮ হাজার৷ ভোট গ্রহণ চলছে মোট ৬৫৭টি বুথে৷ প্রায় ৫ হাজার ভোটকর্মী কাজ করছেন৷ প্রায় ১০ হাজার পুলিশ মোতায়েন রয়েছে গোটা এলাকায়৷
প্রায় শ'দেড়েক বুথকে স্পর্শকাতর ঘোষণা করা হয়েছে। এই বুথগুলিতে থাকছে সিসি ক্যামেরা৷ ভিডিওগ্রাফির ব্যবস্থাও রাখা হয়েছে। শিলিগুড়ি মহকুমা পরিষদের ৯টি আসনের মধ্যে ৬টি আসন দার্জিলিং পুলিশ এলাকায় এবং ৩টি আসন শিলিগুড়ি পুলিশ কমিশনারেট এলাকায় রয়েছে৷ প্রশাসনিক সিদ্ধান্ত অনুসারে, আজ প্রতিটি বুথে একজন করে সশস্ত্র পুলিশ কর্মী এবং একজন করে লাঠিধারী পুলিশ রয়েছেন৷ শনিবার থেকেই ভোটকর্মীরা নিজ নিজ ভোটগ্রহণ কেন্দ্রে পৌঁছে গিয়েছেন৷
মহকুমা পরিষদের ত্রিস্তরীয় পঞ্চায়েত নির্বাচনে ফেভারিট তৃণমূল কংগ্রেস৷ মূল লড়াই তৃণমূলের সঙ্গে বামেদের৷ তবে একাধিক আসনে 'বিদ্রোহী' তৃণমূল নেতা-কর্মীরা প্রার্থী হয়েছেন৷ বিজেপিও একই সমস্যায় আক্রান্ত ৷ মহকুমা পরিষদের ৯টি আসনে লড়াই করছে বিজেপিও৷ বামেরা ৮টি ও কংগ্রেস ৭টি আসনে প্রতিদ্বন্দ্বিতা করছে। মহকুমা পরিষদের ভোটে গতবার বহুমুখী লড়াই হলেও এবার তৃণমূলের প্রতিপক্ষ 'বিদ্রোহী' তৃণমূল। বিজেপি নয়, বামেরাই এবার তৃণমূলের বড় প্রতিদ্বন্দ্বী৷ কংগ্রেস থাকলেও তাঁরা তেমন আশবাদী নয়। এই ভোটে সব দলের আসল মাথাব্যথা নির্দলদের নিয়ে।
এদিকে রাজ্য পুলিশ দিয়ে শিলিগুড়ি মহকুমা পরিষদে ভোট হলে, অবাধ ও নিরপেক্ষ নির্বাচন সম্ভব নয় বলে অভিযোগ তুলে ইতিমধ্যেই সরব হয়েছেন শিলিগুড়ির বিজেপি বিধায়ক শঙ্কর ঘোষ, প্রাক্তন মেয়র ও পুরমন্ত্রী বাম নেতা অশোক ভট্টাচার্য৷ গত নির্বাচনে লড়াই ছিল ত্রিমুখী। বাম, কংগ্রেস এবং তৃণমূল। বামেদের শক্তি এখনও কিছুটা আছে। সংগঠনও আছে তৃণমূল স্তরে। শিলিগুড়ি পুরভোটের ফলের পর এবার অনেকটাই পিছিয়ে গিয়েছে তারা। কংগ্রেস বহু বছর ধরেই এখানে ক্ষয়িষ্ণু। তারা পিছনের আসনেই রয়েছে। বিজেপি বাইরে যতখানি প্রচার চালাচ্ছে, ভোটের ময়দানে তার আঁচ পাওয়া যায়নি৷ একুশের বিধানসভা নির্বাচনের পর গেরুয়া কর্মীদের মনোবল তলানিতে। তবে তৃণমূলের সবচেয়ে বড় প্রতিদ্বন্দ্বী এখন তৃণমূলই। এরা সবাই দলত্যাগী তৃণমূলি৷ বিক্ষুব্ধ নেতা-কর্মীদের নিয়ে কিছুটা বিপাকে বিজেপিও। দুই দলেই টিকিট না পেয়ে বহু নেতা-নেত্রী নির্দল হয়ে ভোটে লড়ছেন৷ ভোট-রাজনীতি বলছে, নির্দল প্রার্থীরা জিতুক বা হারুক, নিজেদের প্রাক্তন দলের ভোটই কাটবে৷ রাজনৈতিক মহল বলছে, এবার নির্ণায়ক হতে পারেন নির্দলরাই৷
এই আশঙ্কা মাথায় নিয়েই আজ ভোটযুদ্ধে নেমে পড়েছে প্রায় সব দলই৷