সহিংসতা ও সৌন্দর্যের মেলবন্ধনে নোবেল পেলেন হাঙ্গেরির লেখক লাসজলো ক্রাসনাহরকাই
2025 Nobel Prize in Literature: ১৯৮৫ সালে প্রকাশিত ‘স্যাটানটাঙ্গো’ তাঁর প্রথম উপন্যাস। যেখানে একটি কৃষি সমবায় গ্রামীণ জীবনের গল্প তুলে ধরেন; সেখানে এক রহস্যময় আগন্তুকের আগমন এক ধরনের বিভ্রম ও আশা সৃষ্টি করে।
এবছর মৌলিক বিজ্ঞানের নোবেলের ঝুড়ি পরিপূর্ণ। ৯ অক্টোবর সুইডিশ নোবেল কমিটি সাহিত্যে অভূতপূর্ব অবদানের জন্য হাঙ্গেরিয়ান সাহিত্যিক লাসজলো ক্রাসনাহরকাই-কে (László Krasznahorkai ) পুরস্কৃত করল। ইমরে কের্তেজের পর তিনি দ্বিতীয় হাঙ্গেরীয় লেখক, যিনি নোবেলের মুকুট পরলেন। পুরস্কার ঘোষণার সময় আয়োজকদের মুখে বারবার উঠে আসে তাঁর জার্মান ভাষায় লেখা উপন্যাস, ‘হার্শট ০৭৭৬৯’ এর নাম, যেটিতে জার্মান সমাজের অস্থিরতার চিত্র নিপুণ দক্ষতায় তুলে ধরেছেন তিনি। ঠিক কী ধরনের সাহিত্য রচনা করেছেন তিনি?
তাঁর লেখায় বারবার ফিরে ফিরে এসেছে অ্যাপোক্যালিপ্টিক আতঙ্ক তথা ভবিষ্যতের বিপর্যয়ের কথা। এটি এমন এক আতঙ্ক, যেখানে মনে করা হয় মহাবিপর্যয় আসন্ন, পৃথিবী বা সভ্যতা বোধহয় আর থাকবে না, ধ্বংস হয়ে যাবে অচিরেই। এই রকম দোদুল্যমান পরিস্থিতির ভিতরে সাহিত্য, শিল্প, বা কোনো মননশীল সৃষ্টিকর্মের জন্ম দেওয়া দুরূহ ব্যাপার। একদিকে ভয় আতঙ্ক, অন্যদিকে অপার্থিব সৌন্দর্য, এই দুই বিপরীত ধারণাকে একই ছাতার তলায় এনেছেন লাসজলো। ইংরেজিতে reconcile নামের একটি জনপ্রিয় শব্দ আছে, যার অর্থ দুটো বিপরীত ধর্মী চিন্তাকে এক জায়গায় এনে দাঁড় করানো, হ্যাঁ লাসজলো সেটাই করছেন। তাঁর লেখনীকে কাফকা, বার্নহার্ড, স্যামুয়েল বেকেটের সঙ্গে তুলনা করেছেন নোবেল কমিটি । তাঁর লেখায় প্রাচ্যের মননশীলতা ও সূক্ষ্ম সুর ফুটে ওঠে । চিন ও জাপানে ভ্রমণের সময়ের কথাও তুলে ধরেছেন তিনি। না ঠিক ভ্রমণাশ্রিত লেখনী নয়, ভ্রমণকালের লব্ধ অভিজ্ঞতা মিশে রয়েছে তাঁর একগুচ্ছ রচনাতে। তার লেখনির পরতে পরতে মিশে আছে গভীর দার্শনিক সুর, একধরনের মহাজাগতিক বিষণ্ণতা— যেখানে ইতিহাস, ধর্ম, রাজনীতি, প্রকৃতি, ধ্বংস, মৃত্যু, সব মিলে মিশে একাকার হয়ে যায়।
আরও পড়ুন
রসায়নে নোবেল ২০২৫: CO₂ বন্দি, মরুভূমিতে জল সঞ্চার সম্ভব হবে এবার
১৯৮৫ সালে প্রকাশিত ‘স্যাটানটাঙ্গো’ তাঁর প্রথম উপন্যাস। যেখানে একটি কৃষি সমবায় গ্রামীণ জীবনের গল্প তুলে ধরেন; সেখানে এক রহস্যময় আগন্তুকের আগমন এক ধরনের বিভ্রম ও আশা সৃষ্টি করে। এই উপন্যাস তাঁকে হাঙ্গেরীয় সাহিত্যজগতে ব্যাপক পরিচিতি এনে দেয়। পরে বিখ্যাত পরিচালক বেলাটার এটিকে চলচ্চিত্রে রূপ দেন, যা আজও বিশ্ব চলচ্চিত্রের এক কাল্ট ক্লাসিক। তাঁর সদ্য প্রকাশিত ‘হার্শট ০৭৭৬৯’ উপন্যাসে জার্মানির থুরিংগেনের এক ছোট্ট শহরে অস্থিরতা, হত্যা ও অগ্নিসংযোগের কারণে বিপর্যস্ত জনজীবনের চিত্র বুনেছেন তিনি। সেজন্য পুরস্কার ঘোষণার সময় নোবেল কমিটির বিবৃতি কানে বাজতে থাকে- ‘এটি এক নিঃশ্বাসে লেখা একটি বই, যেখানে হিংসা এবং সৌন্দর্যকে ‘অসম্ভব’ভাবে সংযুক্ত করা হয়েছে।’
তাঁর কলম কখনও থেমে থাকেনি। ১৯৫৪ সালে রোমানিয়ার সীমান্তবর্তী দক্ষিণ-পূর্ব হাঙ্গেরির ছোট শহর গিউলাতে জন্মানো ক্ষণজন্মা এই সাহিত্যিকের কলমের আঁচড়ে একে একে প্রকাশ পেয়েছে ‘হাবারু এস হাবারু’ (১৯৯৯), এ মাউন্টেন টু দ্য নর্থ (২০০৩), এ রিভার টু দ্য ইস্টের মতো সব কালজয়ী সৃষ্টি। তাঁর , ‘ওয়ার অ্যান্ড ওয়ার’ উপন্যাসে সভ্যতা, ইতিহাস ও মানব অস্তিত্ব নিয়ে গভীর অনুসন্ধানমূলক ভাবনার বহিঃপ্রকাশ ঘটেছে; যেখানে তিনি দেখিয়েছেন এক সরকারি কেরানির সংগ্রাম-যুদ্ধ, ইতিহাস ও ভাষার মধ্য দিয়ে টিকে থাকার আপ্রাণ প্রচেষ্টা। এছাড়াও তাঁর উল্লেখযোগ্য কাজের মধ্যে আছে, দ্য মেলানকোলি অব রেজিস্ট্যান্স, যেখানে একটি বিশাল হাঙরের প্রদর্শনীকে কেন্দ্র করে মানুষের মধ্যে সামাজিক বিশৃঙ্খলা, উন্মাদনা এবং একনায়কতন্ত্রের ছবি তুলে ধরা হয়েছে; সে যেন মানব সভ্যতার পতন ও নৈতিক শূন্যতার এক দার্শনিক কাব্যগাঁথা। পরবর্তীতে, এর ওপর সিনেমাও নির্মিত হয়।
এর আগে, ২০১৫ সালে ম্যান বুকার ইন্টারন্যাশনাল পুরস্কার ও ২০১৯ সালে ন্যাশনাল বুক অ্যাওয়ার্ড ফর ট্রান্সলেটেড লিটারেচার পুরস্কার পেয়েছেন তিনি। ২০২৪ সালে তিনি আন্তর্জাতিক সাহিত্য পুরস্কার ফর্মেন্টর পুরস্কারও লাভ করেন। মহাপ্রলয়ের ভয়াবহতার মধ্যেও শিল্পের শক্তিকে পুনর্জীবিত করার যে অভূতপূর্ব মুন্সিয়ানা দেখিয়েছেন তাঁর সৃষ্টিতে, তা ফুটে উঠেছে নোবেল কমিটির বিবৃতিতে ‘তাঁর মনোমুগ্ধকর এবং দূরদর্শী কাজ, যা মহাপ্রলয়ের আতঙ্কের মাঝেও শিল্পের শক্তিকে পুনর্ব্যক্ত করে, তার জন্য তাঁকে পুরস্কৃত করা হলো।’

Whatsapp
