এতটা এগিয়েও কেন আদানির হাতে তাজপুর তুলে দিলেন না মমতা?
Adani, Tajpur Port: সম্প্রতি মুখ্যমন্ত্রী জানিয়েছেন, এই প্রকল্পের জন্য নতুন করে দরপত্র জারি করা হবে। সেই দরপত্র নিলামে অংশ নিতে পারবেন যে কোনও সংস্থা, করতে পারবেন বিডও। বেঙ্গল গ্লোবাল বিজনেস সামিটের মঞ্চে সরাসরি ঘোষণা কর...
বঙ্গে হয়ে গেল দু'দিনের বাণিজ্য সম্মেলন। যাতে ডাক পেয়েছিলেন দেশের অসংখ্য বিশিষ্ট শিল্পপতি। কিন্তু তাতে দেখা মিলল না আদানি গোষ্ঠীর মালিক গৌতম আদানির। এমনকী তাঁর সংস্থা থেকে কোনও প্রতিনিধিও থাকলেন না সম্মেলনে। তাজপুর সমুদ্র বন্দর প্রকল্পের জন্য আদানি গোষ্ঠীর সঙ্গে যে চুক্তি হয়েছিল রাজ্য সরকারের, বাতিল হয়ে গিয়েছে সেই চুক্তিও। ফের নতুন করে টেন্ডার ডাকার কথা জানিয়েছেন মুখ্যমন্ত্রী মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়। আদানি প্রশ্ন ঘিরে দীর্ঘদিন ধরেই জলঘোলা চলছে জাতীয় এবং রাজ্য রাজনীতিতে। কিছুদিন আগেই সংসদে টাকার বিনিময়ে প্রশ্ন করার অভিযোগ তুলে কোণঠাসা করা হয়েছে কৃষ্ণনগরের তৃণমূল সাংসদ মহুয়া মৈত্রকে। এমনকী সংসদীয় এথিক্স কমিটি তাঁর সাংসদ পদ বাতিলেরও নির্ণয় নেয়। সে সময় আশ্চর্যজনক ভাবে নীরব ছিল তৃণমূল। মহুয়া বিতর্ক থেকে আরম্ভ করে আদানির বিরুদ্ধে ওঠা হিন্ডেনবার্গ রিপোর্ট, তার পর একের পর এক বিতর্ক, আদানির হাত থেকে তাজপুর পোর্ট ফস্কে যাওয়ার নেপথ্যে কি এই সমস্ত কারণ? এই মুহূর্তে তাজপুর বন্দরের ভবিষ্যৎ কোথায় দাঁড়িয়ে? ফের কোনও বড় হাতে কি যাবে তাজপুর বন্দর প্রকল্পের দায়িত্ব? বাতাসে ঘুরছে অনেকগুলি প্রশ্ন।
বিপাকে আদানি
কিছুদিন ধরেই জাতীয় রাজনীতি তোলপাড় আদানি কেলেঙ্কারি নিয়ে। হিন্ডেনবার্গ রিপোর্ট সামনে আসার পর থেকেই সঙ্কট বেড়েছে আদানি গোষ্ঠীর। ব্যাপক ক্ষতির মুখে পড়েছে গৌতম আদানির সংস্থা। শুধু তাই নয়, আদানি বিতর্কের প্রভাব পড়েছে অর্থনীতিতেও। ধস নেমেছে দালাল স্ট্রিটে। সেই বিতর্কের আঁচ এসে পড়েছে এ রাজ্যেও। যার জেরে একে একে হাত থেকে যাচ্ছে সমস্ত বড় বড় ব্যবসায়িক চুক্তি, সুযোগ। যেভাবে গেল তাজপুর বন্দরের বরাত। কিন্তু এমনটা তো বরাবর ছিল না। ভারতীয় শিল্পপতিদের মধ্যে অন্যতম আদানির নাম যে ফোর্বস তালিকায় শুধু উপরের দিকে ছিল তাই নয়, ভারতের প্রায় সর্বত্র ছিল আদানির অবাধ বিচরণ। সে সময় তাজপুর বন্দর প্রকল্পে লগ্নি করার কথা জানান আদানি, সেই মর্মে রাজ্য সরকারের সঙ্গে চুক্তিও হয়েছিল আদানিদের। কিন্তু হিন্ডেনবার্গের রিপোর্টে দুর্নীতিতে নাম জড়ানোর পর এক ধাক্কায় ৫০ হাজার কোটি টাকা ক্ষতির মুখে পড়েছে আদানি গ্রুপ। এক ধাক্কায় ধনকুবের গৌতম আদানির নাম নেমে এসেছে চতুর্থ থেকে সপ্তমে। এককালে মোদি-ঘনিষ্ঠ আদানি বিপাকে পড়তেই হাত থেকে বেরিয়ে যাচ্ছে একের পর এক ব্যবসায়িক চুক্তিগুলি।
আরও পড়ুন: আদানির বিরুদ্ধে প্রশ্ন, মাশুল দিচ্ছেন মহুয়া?
বন্দরের বরাত
দুই মেদিনীপুরে শিল্পের প্রসারে তাজপুরে বন্দর তৈরির বিরাট একটি প্রকল্পের কথা ঘোষণা করেছিলেন মুখ্যমন্ত্রী মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়। এই তাজপুর বন্দর তৈরিতে আনুমানিক ২৫ হাজার কোটি টাকা খরচ হওয়ার কথা। সেই বন্দর তৈরির বরাত যায় আদানি গোষ্ঠীর হাতে। মূল প্রকল্পের সঙ্গে আরও ১৫ কোটির বিনিয়োগ রয়েছে এই বন্দরে। তাজপুর বন্দর তৈরি সম্পূর্ণ হলে চাকরি হওয়ার কথা প্রায় ২৫ হাজার মানুষের। শিল্পপতিদের মধ্যে বাংলায় সবচেয়ে বড় বিনিয়োগ রয়েছে আদানিরই। বেঙ্গল গ্লোবাল বিজনেস সামিট ২০২২-এ এসেছিলেন শিল্পপতি গৌতম আদানি। ১০ হাজার কোটি টাকার বিনিয়োগের ঘোষণাও করেছিলেন। জানিয়েছিলেন, তৈরি হবে বিশ্বমানের বন্দর, অত্যাধুনিক ডেটা সেন্টার, যার ডেটাকেবল ছড়ানো থাকবে অতল সমুদ্রের গভীরে। তাছাড়া থাকবে গুদাম এবং লজিস্টিক পার্ক। ২০২০ সাল নাগাদ তাজপুরে বন্দর তৈরির বরাত পায় আদানি গোষ্ঠী। মুখ্যমন্ত্রী মমতা বন্দ্যোপাধ্যায় নিজেই এই প্রকল্পের LOI হস্তান্তর করেন। কলকাতার আদানি পোর্টের সিইও করণ আদানির হাতে তা তুলে দেওয়া হয়। গত তিন বছরে ধীর পায়ে হলেও শুরু হয়েছে কাজও। একটা বন্দর প্রকল্প মানে তো আর শুধুমাত্র সরকার বা বিনিয়োগকারী তাতে জড়িত, তাই নয়। তার সঙ্গে রাজ্যের শিল্প, পরিবহণ-সহ বহু কর্মী ও কর্মসংস্থানের সম্ভাবনা জড়িয়ে তার সঙ্গে। বিরাট বড় অঙ্কের বিনিয়োগ, বিরাট সম্ভাবনা, সবই এই মুহূর্তে বিশ বাঁও জলে।
চুক্তি বাতিল
কেন্দ্রের আদানি পক্ষপাতিত্ব নিয়ে যখন বারবার সরব হয়েছেন রাজ্যের শাসক দল, সেখানে আদানি গোষ্ঠীর কাছেই তাজপুর বন্দর প্রকল্পের টেন্ডার যাওয়া নিয়ে কম প্রশ্ন ওঠেনি। তার পরেও তাজপুর বন্দরের জন্য আদানি পোর্টস এবং স্পেশাল ইকোনমিক জোন লিমিটেডকে দায়িত্ব দেওয়ার প্রস্তাবে অনুমোদন দেওয়া হয়েছিল। তবে বর্তমান পরিস্থিতি পাল্টেছে। সময়ের সঙ্গে তাল মিলিয়ে আদানি পোর্টকে দেওয়া লেটার অফ ইনটেন্ট (Lol) বাতিল করার সিদ্ধান্ত নিয়েছে রাজ্য সরকার। সম্প্রতি মুখ্যমন্ত্রী জানিয়েছেন, এই প্রকল্পের জন্য নতুন করে দরপত্র জারি করা হবে। সেই দরপত্র নিলামে অংশ নিতে পারবেন যে কোনও সংস্থা, করতে পারবেন বিডও। বেঙ্গল গ্লোবাল বিজনেস সামিটের মঞ্চে সরাসরি ঘোষণা করে দিয়েছেন মুখ্যমন্ত্রী। এ বছর বাণিজ্য সম্মেলন আলো করেছিলেন রিল্যায়েন্সে গোষ্ঠীর চেয়ারম্যান মুকেশ অম্বানি। তিনি এসে ঝুড়ি ঝুড়ি বিনিয়োগের ঘোষণাও করে গিয়েছেন তবে ইতিমধ্যেই যে সব চুক্তি হয়ে গিয়েছে বাংলার আদানির সঙ্গে, সেগুলোর ভবিষ্যৎ নিয়ে আশঙ্কার মেঘ। সেগুলির দায়িত্ব কি বুঝে নেবে রিল্যায়েন্স গোষ্ঠী, তার উত্তর মিলবে আগামী দিনে।
বিরোধীদের তোপ
আদানির সঙ্গে সম্পর্কের অবনতিই কি তাজপুর বন্দরের চুক্তি ভেস্তে যাওয়ার পিছনে বড় কারণ? হাওয়ায় ঘুরছে প্রশ্ন। মজার ব্যাপার হল, এই বছর আদানি গোষ্ঠীর কেউই আসেননি বাণিজ্য সম্মেলনে। আর সে নিয়েই বিস্ফোরক দাবি করেছেন রাজ্যের বিজেপি নেতা শুভেন্দু অধিকারী। চুক্তিভঙ্গের ঘটনাকে অন্য রঙে রাঙানোর চেষ্টায় উঠে পড়ে লেগেছেন রাজ্যের বিরোধী দলনেতা শুভেন্দু অধিকারী। বিজেরপি নেতার দাবি, আদানিরাই কোনওদিনই তাজপুরে বন্দর তৈরিতে আগ্রহী ছিলেন না। মুখ্যমন্ত্রী মমতা বন্দ্যোপাধ্যায় সবটাই জানতেন ভালো মতো। তার পরেও খেলা চলেছে। সোশ্যাল ব্লগিং সাইটে তোপ দেগে তিনি দাবি করেছেন, আদানি পাওয়ার ঝাড়খণ্ড লিমিটেড বাংলাদেশে বিদ্যুৎ পাঠানোর ব্যাপারে চুক্তিবদ্ধ হয়েছে। কিন্তু সমস্যাটা হল সেই সাপ্লাইলাইনটা পশ্চিমবঙ্গের মধ্য়ে দিয়ে যাওয়ার কথা। বিশেষত মুর্শিদাবাদের উপর দিয়ে। আম আর লিচুর বাগান পড়ছে তার মধ্য়ে। সেকারণে বিশেষত সংখ্যালঘু সম্প্রদায়ের চাষিরাই মূলত এ নিয়ে আপত্তি করেছিলেন। তারপরেই আদানি ও মমতা বন্দ্য়োপাধ্য়ায়ের মধ্যে একটা চুক্তি সাক্ষর হয়। সেই মতো আদানি বিজিবিএসে মমতার প্রশংসা করবেন আর তার বিনিময়ে বাংলাদেশে প্রবেশের আগে ফরাক্কা, মুর্শিদাবাদ ও মালদার উপর দিয়ে লাইন নিয়ে যেতে দেবেন মমতা। তাজপুর পোর্ট ছিল সেই পরিকল্পনারই অঙ্গ…কিন্তু বাস্তবের সঙ্গে ওটা মিলছিল না। এরপর মমতা পুলিশ সংখ্য়ালঘু কৃষকদের উপর অত্যাচার করছিল। যারা শান্তিপূর্ণ প্রতিবাদ করছিলেন তাদের রক্ত ঝড়েছে। এদিকে প্রতিবাদী কৃষকরা যখন পালটা প্রতিবাদ করছিলেন তখন মমতা অন্য পথ ধরেন। এদিকে হাইটেনশন লাইন নিয়ে যাওয়ার জন্য প্রাচীন আমগাছের বাগান, লিচু বাগান নষ্ট করা হয়েছে। ১০০ বছরে এই প্রথম সেখানে ফলন হল না। এদিকে এখন যেহেতু উদ্দেশ্য সাধিত হয়েছে তখনই আদানি সরে আসেন তাজপুর বন্দরের পরিকল্পনা থেকে।আর এখন মমতা বন্দ্যোপাধ্য়ায় নতুন উৎসাহীদের ডেকে আনার চেষ্টা করছেন।
আরও পড়ুন: টাকার বিনিময়ে আদানি-দুর্নীতি নিয়ে প্রশ্ন! মহুয়া বিতর্কে কেন চুপ তৃণমূল?
মহুয়া বিতর্ক
কিছুদিন আগেই সংসদে আদানি দুর্নীতি নিয়ে প্রশ্ন করে বিপাকে পড়েছিলেন কৃষ্ণনগরের সাংসদ মহুয়া মৈত্র। দুবাইয়ের ব্যবসায়ী দর্শন হিরানন্দানির থেকে টাকা ও দামী দামী উপহারের বিনিময়ে সংসদে আদানি নিয়ে প্রশ্ন করেছিলেন মহুয়া। এমন অভিযোগ তোলেন বিজেপি সাংসদ নিশিকান্ত দুবে ও আইনজীবী জয় অনন্ত দেহাদ্রাই। হলফনামায় সে কথা স্বীকার করে নেয় সেই ঘটনা নিয়ে কম জলঘোলা হয়নি। অবশেষে সংসদের এথিকস কমিটি সুপারিশ করে, তাঁর সদস্যপদ বাতিলের। সেই ঘটনায় আশ্চর্য ভাবে মুখে কুলুপ এঁটেছিল দল। তেমন ভাবে মহুয়ার পাশে দাঁড়াতে দেখা যায়নি দলকে। তবে তার কারণ আঁচ করা বোধহয় আজ আর তেমন কঠিন নয়। সে সময় ওয়াকিবহাল মহলের অনেকেই দাবি করেছিলেন, সরাসরি মহুয়ার পাশে না দাঁড়িয়ে আদতে বিরোধী দলগুলোকেই আরও বেশি করে কথা বলার সুযোগ করে দিয়েছিল তৃণমূল। যদিও বন্দরের চুক্তি বাতিল হওয়ার পর এই প্রথম বার মহুয়ার পাশে দাঁড়িয়েছেন মমতা। যার বার্তা গিয়েছে গোটা দলের কাছেই।
বন্দরের ভবিষ্যৎ
এদিকে, এ রাজ্যের সরকার যেন এখন উভয় সংকটে। এ রাজ্যে আরও একবার অনিশ্চিয়তার মুখে পড়ে গিয়েছে রাজ্যের একটি বিরাট প্রকল্প, যার সঙ্গে অনিশ্চিত হয়ে পড়েছে হাজার হাজার মানুষের কর্মসংস্থানের স্বপ্ন, আশা। অন্যদিকে দুর্নীতিতে নাম জড়ানো আদানির সঙ্গে দূরত্ব বাড়ানো নিয়ে রাজ্য সরকারকে তোপ দাগতে ছাড়ছে না বিরোধী দলগুলিও। সব মিলিয়ে সফল একটি বিজনেস সামিট, এত এত লগ্নির ঘোষণা, তার পরেও যেন সব কিছু ঠিক ততটা ছন্দে নেই। অন্তত আদানি ও তাজপুর পোর্ট ঘিরে বেড়ে চলা বিতর্ক তো সে দিকেই নিশানা করছে। তাজপুর বন্দরের মতো বড় প্রকল্পের মতো বড় কাজের দায়িত্ব বুঝে নেবে কারা? কী হবে বন্দরের? সেটাই আপাতত সবচেয়ে বড় প্রশ্ন। যদিও ইতিমধ্যেই তাজপুর বন্দর নিয়ে নতুন করে দরপত্র ডেকেছেন মুখ্যমন্ত্রী। জানিয়েছেন, যে কোনও সংস্থা আবেদন করতে পারবেন। হবে বিডও। শেষপর্যন্ত তাজপুর বন্দরের মতো বড় প্রকল্পের মতো বড় কাজের দায়িত্ব বুঝে নেবে কারা? কী হবে বন্দরের? সেটাই আপাতত সবচেয়ে বড় প্রশ্ন।