গুরুপত্নীর প্রেমপত্র শিষ্যকে! কেন বীরাঙ্গনা কাব্য বিদ্যাসাগরকেই উৎসর্গ করলেন মধুসূদন?
Michael Madhusudan Dutt: আইন যাতে পাশ করা সম্ভব হয় তাই বিদ্যাসাগরকে পরাশর সংহিতা থেকে শাস্ত্রবচন উদ্ধার করে কোন কোন ক্ষেত্রে নারী ‘দ্বিতীয় পতি’ পরিগ্রহণ করতে পারেন তা নির্দেশ করতে হলো।
ভালোবাসার চিঠি লেখে হাত। সে হাত কি আর যেমন তেমন? প্রেমের কবিতায় রমণীয় হাতের কথা ফিরে ফিরে আসে। ১৮৪১ সাল। মধুসূদন খিদিরপুরে বসে লিখেছিলেন বৃষ্টিদৃশ্য মাখা একটি ইংরেজি কবিতা। সখা গৌরদাস বসাক, যাঁকে ঘিরে নানা আবেগে ভেসেছিলেন মধুসূদন, সেই প্রিয় গৌরদাসের অনুরোধে লেখা হয়েছিল কবিতাটি। তবে সে কবিতা নিবেদিত এক রমণীর প্রতি। কবিতাটি শেষ হয়েছে সেই রমণীর কমনীয় সাদা-হাতের বিবরণে। লিখেছেন মধুসূদন,
‘They bathed her snowy hands – while I warmed them with my sighs!"
সাদা, বরফের মতো সাদা, হাত ধুয়ে দিচ্ছে বারিধারা আর প্রেমিক-পুরুষটি তাঁর দীর্ঘ নিঃশ্বাসের উষ্ণতা ঢেলে দিচ্ছেন সেই হাতে। এ এক আশ্চর্য বৈপরীত্য– শীতলতা আর উষ্ণতার যুগল-ডানায় আছে তো হাতখানি। মধুসূদনের কবিতায় আবার ফিরে এল হাত। কামমোহিত ভালোবাসায় উদ্দীপিত রমণীয় এক হাত, এর কুড়ি বছর পরে। ইংরেজি কবিতায় নয়, বাংলা কবিতায়। তাঁর ‘বীরাঙ্গনা’ কাব্যের সোমের প্রতি তারা পত্রটি সবচেয়ে বিতর্কিত। তারা গুরুপত্নী। গুরুপত্নী তো ‘মাতৃতুল্য’। অথচ গুরুপত্নী তারা সোমকে প্রেমপত্র লিখছেন। এ কী অজাচার (incest)? লিখছেন হাত দিয়ে। সে কবিতায় তারা সচেতন তাঁর এই প্রেমের সামাজিক ‘অনৈতিকতা’ সম্বন্ধে। কিন্তু প্রেমের কী বা নীতি কী বা অনীতি? লিখলেন তারা,
কি লজ্জা! কেমনে তুই, রে পোড়া লেখনি,
লিখিলি এ পাপ কথা, -- হায় রে, কেমনে?
কিন্তু বৃথা গঞ্জি তোরে! হস্তদাসী সদা
তুই; মনোদাস হস্ত; সে মনঃ পুড়িলে
কেন না পুড়িবি তুই? বজ্রাগ্নি যদ্যপি
দহে তরুশিরঃ; মরে পদাশ্রিত লতা!
আরও পড়ুন- বিমলাকে ‘শিক্ষা’ দিলেন না নিখিলেশ, পদাবলির বিরহকে ঘরে-বাইরে মিশিয়ে দিলেন রবীন্দ্রনাথ
কলম বা লেখনি সে তো হাতের দ্বারা নিয়ন্ত্রিত, আর হাত সে তো মনের দাস। মন যখন পোড়ে তখন তো হাত লেখে, লিখতে চায় সেই পোড়া মনের কথা। তারার মন পুড়েছে। দেবগুরু বৃহস্পতির পত্নী তারা। সেই বৃহস্পতির কাছে নিরাময় লাভে ব্যর্থ তারার শরীর-মন। যুবতী রমণীকে মাতার আবরণের শীতলতায় সম্মত হতে হবে! গুরুপত্নী রূপে মেনে নিতে হবে ত্যাগের জীবন! তারা পত্রে সোমকে জানিয়েছেন, কীভাবে সোমের আগমনে জেগে উঠল তাঁর শরীর ও মন। ‘শান্ত আশ্রমে’ সোমের প্রবেশের সঙ্গে সঙ্গে ‘সহসা ফুটিল’ তাঁর ‘নবকুমুদিনীসম এ পরাণ’। দর্পণে মুখ দেখলেন তিনি। বেণী বন্ধন করলেন। চুল সাজালেন ফুলে। বল্কল ত্যাগ করে অঙ্গে ধারণ করলেন রেশমবস্ত্র। নিজেকে সাজালেন নানা গহনায়।
এই যে নিজের অতৃপ্ত অভুক্ত শরীর মেলে দিলেন পরিণীত হওয়ার জন্য এ কি পাপ বাসনা কেবল? এ কি প্রাকৃতিক দাবি নয়? মধুসূদন তাঁর এই কাব্য উৎসর্গ করেছিলেন ‘বঙ্গকুলচূড়া/ শ্রীযুক্ত ঈশ্বরচন্দ্র বিদ্যাসাগর মহোদয়ের/... নিকট/ যথোচিত সম্মানের সহিত’। কেন বিদ্যাসাগর মধুসূদনের কাছে সম্মানের পাত্র? মধুসূদনকে বিপদের দিনে অর্থসাহায্য করেছিলেন বিদ্যাসাগর, পাশে ছিলেন তাঁর। তবে দানবীর বিদ্যাসাগরের কথা ভেবে বোধহয় এই কাব্য বিদ্যাসাগরকে উৎসর্গ করেননি তিনি। উৎসর্গ করেছিলেন নারীশিক্ষার ও বিধবাবিবাহের সমর্থক বিদ্যাসাগরের কথা ভেবে। ১৮৫৬ সালে বিদ্যাসাগরের ‘প্রযত্ন’ সফল হল। বিধবাবিবাহ আইন পাশ করল ঔপনিবেশিক সরকার। এই আইন যাতে পাশ করা সম্ভব হয় তাই বিদ্যাসাগরকে পরাশর সংহিতা থেকে শাস্ত্রবচন উদ্ধার করে কোন কোন ক্ষেত্রে নারী ‘দ্বিতীয় পতি’ পরিগ্রহণ করতে পারেন তা নির্দেশ করতে হলো। তবে শাস্ত্রবচন ছাড়াও আরেকটি বিষয় বিদ্যাসাগরের লেখায় গুরুত্ব পেয়েছিল। বিদ্যাসাগর মনে করেন অভুক্ত-অতৃপ্ত নারীর শরীর ও মনের দাবি অনিবার্য, স্বাভাবিক ও প্রাকৃতিক। লেখেন তিনি,
"তোমরা মনে কর, পতিবিয়োগ হইলেই, স্ত্রীজাতির শরীর পাষাণময় হইয়া যায়; দুঃখ আর দুঃখ বলিয়া বোধ হয় না... তোমাদের এই সিদ্ধান্ত যে নিতান্ত ভ্রান্তিমূলক, পদে পদে তাহার উদাহরণ প্রাপ্ত হইতেছি।"
বিদ্যাসাগর, যে বিদ্যাসাগর নারী শরীরের এই স্বাভাবিক অনিবার্য প্রাকৃতিক অধিকারের কথা বিধবাবিবাহ প্রচারের সূত্রে স্বীকার করে নেন, সেই বিদ্যাসাগরকে রমণীয় প্রেমকথার পত্রকাব্য উৎসর্গ করলেন মধুসূদন। তাঁর পত্রকাব্যে তারা লিখলেন সোমকে,
লিখিনু লেখন বসি একাকিনী বনে,
কাঁপি ভয়ে – কাঁদি খেদে – মরিয়া শরমে!
লয়ে ফুলবৃন্ত, কান্ত, নয়ন-কাজলে
লিখিনু! ক্ষমিও দোষ, দয়াসিন্ধু তুমি!
আরও পড়ুন- প্রেমে খুনই শেষ সত্য নয়, ‘রক্তকরবী’-র বিশু পাগল তার প্রমাণ
তারার মনের কথা লেখার কলমখানি সুপ্রাকৃতিক। ফুলের বোঁটা তার কলম। কাজল তার কালি। সেই কথা লিখছেন তিনি ‘দয়াসিন্ধু’কে। বিদ্যাসাগর তো দয়ারসাগর নামে সুপরিচিত। এই দয়াবান করুণাসাগরও। করুণায় সমমর্মী বলেই তিনি অনুধাবন করতে পারেন নারী-শরীরের প্রাকৃতিক বেদনা। সেই বেদনা উপশমের জন্য বিবাহ নামের প্রতিষ্ঠানটিকে নতুন অধিকারের সূত্রে সম্প্রসারিত করতে চান বিদ্যাসাগর। মধুসূদনের পথ অবশ্য বিদ্যাসাগরের পথের সমতুল নয়। মধুসূদনের তারার হৃদয়পোড়া হাত যে চিঠি লেখে তা সামাজিক অনুশাসনের তোয়াক্কা করে না, হৃদয়ের অনুশাসনকেই গুরুত্বপূর্ণ বলে মনে করে। এই হৃদয়ের অনুশাসনকে গ্রহণ করা সর্বদা সম্ভব কিনা, করলেও কতটা সম্ভব তা নিয়ে যে তর্ক তার সর্বাত্মক সমাধান অসম্ভব। ১৮২৪ খ্রিস্টাব্দে জন্মেছিলেন মধুকবি। খুব দীর্ঘজীবনের অধিকারী ছিলেন না তিনি। চলে গেলেন ১৮৭৩ খ্রিস্টাব্দে। ১৮৭২ সালে প্রকাশিত হল বঙ্কিমচন্দ্রের সম্পাদনায় ‘বঙ্গদর্শন’ সাময়িকপত্র। সেখানে প্রথম বর্ষ থেকে ধারাবাহিক ভাবে প্রকাশিত হচ্ছিল ‘বিষবৃক্ষ’। সে উপন্যাসের বিষয় মনের অনুশাসন ও সামাজিক অনুশাসনের দ্বন্দ্ব। নগেন্দ্রর মন তাঁর স্ত্রী সূর্যমুখীর দিক থেকে সরে গেল কুন্দের দিকে। কী দোষ সূর্যমুখীর? দোষ তো নেই কিছু। মন যে প্রকৃতির মতো চঞ্চলা। সেই চঞ্চলা মনের সব কথা শুনলে যে সামাজিক সর্বনাশ হয় তারই নিদর্শন বঙ্কিমের ‘বিষবৃক্ষ’ উপন্যাস। সে উপন্যাসে বঙ্কিম মনের অনুশাসনের চাইতে সামাজিক অনুশাসনকেই গুরুত্বপূর্ণ বলে স্বীকার করেছিলেন। মধুসূদন কিন্তু ব্যক্তিগত জীবনে ও কবিতায় সামাজিক অনুশাসনের পরিবর্তে মনের অনুশাসনের অনুসারী। এই মধুসূদনকে তাই বলে কি ফেলে দেবেন বঙ্কিম ও বঙ্গদর্শন! দেননি, দেওয়া সম্ভব নয়। মধুসূদনের প্রয়াণের পর বঙ্কিমের ‘বঙ্গদর্শন’-এ যে প্রয়াণলেখ প্রকাশিত হল তাতে মধুসূদনকে ‘জাতীয় কবি’র স্বীকৃতি দেওয়া হল।
পোড়ামনের যাত্রাপথ ভালোবাসার পথ, হাত লেখে সে অধিকারের কথা, সে হাতের গতি রোধ করা যায় না। দুশো বছর আগে জন্মেছিলেন যে বাঙালি কবি সেই মধুসূদন পোড়ামনের আনন্দ-বিষাদের দুর্জয় কথা নানাভাবে লিখেছিলেন তাঁর কাব্যে।