কেন নোবেল পুরস্কার চান ট্রাম্প?
Trump Nobel Prize controversy: আসলে নোবেল শান্তি পুরস্কার বহু দিন ধরেই আর এই শান্তির প্রতীক নয়। বরং পুরস্কার দিয়ে এসেছে এমন নেতাদের, যাঁরা নিজেরাও যুদ্ধের অংশ ছিলেন।
ডোনাল্ড ট্রাম্প নোবেল শান্তি পুরস্কার চান, এই কথাটি শুনলেই অনেকে মুখ টিপে হাসেন। সোশ্যাল মিডিয়া ভরে যায় মিমে আর ঠাট্টায়। কিন্তু হাসির আড়ালে যে বড় রাজনৈতিক বাস্তবতা আছে, তা আমরা খুব কমই দেখি। প্রশ্নটা শুধু ট্রাম্পের ব্যক্তিগত উচ্চাকাঙ্ক্ষা নয়, প্রশ্নটা নোবেল শান্তি পুরস্কারের বদলে যাওয়া চরিত্র নিয়ে।
আজকের নোবেল শান্তি পুরস্কার আর সেই পুরস্কার নেই, যা যুদ্ধবিরোধী আন্দোলনের প্রতীক ছিল। বরং তা ধীরে ধীরে এমন এক স্বীকৃতিতে পরিণত হয়েছে, যেখানে বড় বড় শক্তিধর রাষ্ট্র, সামরিক আধিপত্য ও কূটনৈতিক প্রদর্শনী অন্য যে কোনো কিছুর চেয়ে বেশি মূল্য পায়। তাই ট্রাম্পের দাবি অযৌক্তিক নয়, বরং পুরস্কারের ইতিহাসই তাঁর এই চাওয়াকে সম্ভব করেছে।
'শান্তি' বলতে তো আসলেই যুদ্ধ না হওয়া বা যুদ্ধ থেমে যাওয়াকে বোঝায়। তবে শান্তির আরও ভিন্ন অর্থ আছে। শান্তি মানে সামরিক শক্তির আধিপত্যকে চ্যালেঞ্জ করা; শান্তি মানে অস্ত্রবাণিজ্য, সামরিক হস্তক্ষেপ, রাষ্ট্রনেতার আগ্রাসী নীতি, এসবের বিরুদ্ধে অবস্থান নেওয়া। এই অর্থে ট্রাম্প কখনোই শান্তির দূত নন। মুসলিম অভিবাসন নিষেধাজ্ঞা থেকে শুরু করে ইরানের বিরুদ্ধে হুমকি, কোরিয়া উপদ্বীপে অস্থিরতা— সবটাই ছিল তাঁর ক্ষমতা প্রদর্শনের রাজনীতি। আসলে নোবেল শান্তি পুরস্কার বহু দিন ধরেই আর এই শান্তির প্রতীক নয়। বরং পুরস্কার দিয়ে এসেছে এমন নেতাদের, যাঁরা নিজেরাও যুদ্ধের অংশ ছিলেন।
আরও পড়ুন
ট্রাম্প-পুতিন-আম্বানি, ত্রয়ীর মধ্যে মিলটা কোথায়?
হেনরি কিসিঞ্জার তার সবচেয়ে বড় উদাহরণ। ভিয়েতনাম যুদ্ধের ভয়াবহতায় তিনি ওতপ্রোত ভাবে জড়িত। তবু তিনি শান্তি পুরস্কার পেয়েছিলেন। এই একটি ঘটনাই স্পষ্ট করে দেয়, নোবেলের সংজ্ঞা শুধুই শান্তি নয়, কূটনৈতিক চুক্তিও।
গত কয়েক দশকে নোবেল কমিটি যে বার্তা দিয়েছে তাতে মনে হয়, যুদ্ধে না থেকে যুদ্ধকে 'ম্যানেজ' করাও যেন এক ধরনের শান্তি। বড় শক্তিধর রাষ্ট্রের নেতা যদি দু'দেশের মধ্যে একটি অস্থায়ী চুক্তি করিয়ে দেন, কিছু ছবি তোলেন এবং কিছু বিবৃতি দিয়ে দেন— তাহলেই তিনি শান্তির দাওয়েদার।
এখানেই ট্রাম্পের চাহিদা যৌক্তিক হয়ে ওঠে। তিনি নিজে যে বড় কোনো শান্তির প্রতীক, তা নয়; কিন্তু তিনি আন্তর্জাতিক রাজনীতিতে কেন্দ্রে ছিলেন। উত্তর কোরিয়ার নেতা কিম জং উনের সঙ্গে তাঁর ঐতিহাসিক বৈঠক, মধ্যপ্রাচ্যে তথাকথিত 'শান্তি-চুক্তি', আফগানিস্তান নিয়ে আলোচনায় তাঁর সরকারের ভূমিকা— সবকিছুরই প্রচার হয়েছিল বিশ্বমঞ্চে। এই প্রচার, এই আলোচনাই নোবেলের বর্তমান মানদণ্ডে 'শান্তির কাজ' হিসেবে গণ্য হয়। ফলে ট্রাম্প নিজেকে পুরস্কারের যোগ্য মনে করেন, এটা তাঁর ব্যক্তিগত অহংকার যতই হোক, নোবেলের সাম্প্রতিক ইতিহাস সেটা সমর্থন করে।
ট্রাম্পের নোবেল পাওয়ার ইচ্ছার পিছনে রয়েছে তাঁর রাজনৈতিক ব্র্যান্ড ইমেজও। নিজের সমর্থকদের কাছে তিনি বারবার দেখাতে চান তিনি এক শক্তিশালী নেতা, বিশ্বরাজনীতির কেন্দ্রবিন্দু, যাঁকে প্রতিপক্ষরা ভয় পায়। নোবেল পুরস্কার তাঁর জন্য এক ধরনের রাজনৈতিক 'ট্রফি', যা তিনি ব্যবহার করতে পারেন মার্কিন ভোটারদের সামনে নিজের ক্ষমতা প্রমাণ করতে।
আরও পড়ুন
ট্রাম্প বনাম মাদুরো: কিউবান মিসাইল সংকটের ছায়া কি ফিরছে?
ট্রাম্প খুব ভালোভাবেই জানেন, নোবেল শান্তি পুরস্কার পেলে তাঁর রাজনৈতিক প্রচারে নতুন জোর আসবে। রিপাবলিকান দলেও তাঁকে হালকা ভাবে দেখা কমবে। এর সঙ্গে রয়েছে আরেকটি ব্যক্তিগত কারণ, বারাক ওবামা। তিনি প্রেসিডেন্ট হওয়ার কিছুদিনের মধ্যেই নোবেল পেয়েছিলেন। ট্রাম্প মনে করেন, তিনি ওবামার চেয়েও বেশি শান্তি এনেছেন। তাই নোবেল আসলে তাঁরই পাওয়া উচিত। এটা শুধু ট্রাম্প ও ওবামার পুরনো প্রতিদ্বন্দ্বিতা নয়। এটা মার্কিন রাজনীতিতে কে বড় নেতা, সেই মর্যাদারও লড়াই।
সব শেষে এসে প্রশ্নটা একই জায়গায় দাঁড়ায়, ট্রাম্প নোবেল চাইছেন ঠিকই, কিন্তু আজকের নোবেল কি সত্যিই শান্তির পুরস্কার? না কি রাজনৈতিক আলোচনার, কূটনৈতিক ফটোসেশনের, বিশ্বশক্তির মধ্যস্থতার পুরস্কার?যদি নোবেল সত্যিই শান্তির, মানবিক আদর্শ ও যুদ্ধবিরোধী নীতির প্রতীক হত, তাহলে ট্রাম্পের দাবি নিছক রসিকতা হিসেবে উড়িয়ে দেওয়া যেত। কিন্তু পুরস্কার যখন বহু আগেই তার চরিত্র বদলে ফেলেছে, তখন ট্রাম্পের দাবি আর অবাস্তব নয়। শান্তির ভাষা যেন এখন শক্তির দ্বারা নিয়ন্ত্রিত। আর সেই শক্তির খেলার মধ্যে ট্রাম্পের মতো নেতা নোবেল চাইবেন, এটাই স্বাভাবিক।

Whatsapp
