ট্রাম্প-মাস্কের হুঙ্কারকে দুয়ো! ইতিহাস গড়লেন জোহরান মামদানি
Zohran Mamdani Becomes New York Mayor: মামদানির প্রচারের বার্তাই তরুণ ভোটার, অভিবাসী এবং নিম্ন-মধ্যবিত্ত শ্রমজীবী শ্রেণির মধ্যে গভীর প্রভাব ফেলে।
নিউ ইয়র্ক সিটির নতুন মেয়র হলেন ভারতীয় বংশোদ্ভূত জোহরান মামদানি। মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের ইতিহাসে এই প্রথম কোনো দক্ষিণ এশিয় বংশোদ্ভূত ও মুসলিম ব্যক্তি দেশের অন্যতম গুরুত্বপূর্ণ শহরের মেয়র নির্বাচিত হলেন। ৩৩ বছর বয়সি মামদানি ডেমোক্র্যাটিক পার্টির প্রগতিশীল শাখার প্রতিনিধি। মঙ্গলবারের ভোটে তিনি তাঁর দুই প্রতিদ্বন্দ্বী— রিপাবলিকান কার্টিস স্লিওয়া ও স্বতন্ত্র প্রার্থী অ্যান্ড্রু কৌমো-কে পরাজিত করেছেন। এখনও অবধি পাওয়া তথ্য অনুযায়ী, মামদানি পেয়েছেন প্রায় ৫০.৪% (১,০২২,৪৪৪) শতাংশ ভোট। জয়ের পর তাঁর সমর্থকেরা নিউ ইয়র্কের রাস্তায় নেমে উল্লাসে মেতে উঠেছেন।
মামদানিকে হারাতে এক চমকপ্রদ কৌশল নিয়েছিলেন মার্কিন প্রেসিডেন্ট ডোনাল্ড ট্রাম্প। নিজের দলের প্রার্থী কার্টিস সিলভার পরিবর্তে মামদানির প্রধান প্রতিদ্বন্দ্বী ‘স্বতন্ত্র’ প্রার্থী অ্যান্ড্রু কৌমোকে ভোট দেওয়ার আহ্বান জানান তিনি। ট্রাম্পের যুক্তি ছিল স্পষ্ট— “রিপাবলিকান প্রার্থীর জেতার সম্ভাবনা নেই, তাই মামদানিকে পরাজিত করতে হলে ভোট নষ্ট না করে কৌমোকে ভোট দিন।”এক সাক্ষাৎকারে ট্রাম্প বলেছিলেন, “একজন খারাপ ডেমোক্র্যাটও একজন কমিউনিস্টের চেয়ে ভালো।” তিনি আরও হুঁশিয়ারি দেন, যদি মামদানি জেতেন, তবে নিউ ইয়র্কের জন্য ফেডারেল ফান্ড বন্ধ করে দেবেন। নির্বাচনী প্রচারে বারবারই ট্রাম্প মামদানিকে 'কমিউনিস্ট' আখ্যা দিয়েছেন। শুধু ট্রাম্পই নন, মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের ধনকুবের ইলন মাস্কও প্রকাশ্যে কৌমোকে সমর্থন জানান এবং ভোটারদের তাঁকেই বেছে নিতে অনুরোধ করেন। উল্লেখযোগ্যভাবে, ডেমোক্র্যাট পার্টির প্রাইমারি নির্বাচনে দক্ষিণপন্থী কৌমোকে হারিয়ে দলের আনুষ্ঠানিক প্রার্থী হন জোহরান মামদানি। এরপর থেকেই দক্ষিণপন্থী মহলের রোষের মুখে পড়েন তিনি। কৌমো পরবর্তীতে ‘ইন্ডিপেন্ডেন্ট’ প্রার্থী হিসেবে নির্বাচনে নামেন এবং ডানপন্থী ডেমোক্র্যাটদের সমর্থন পান। মামদানিকে ঘিরে শুরু হয় অভিযোগ— তিনি নাকি কমিউনিস্ট।
আরও পড়ুন
‘নো কিংস’ বিক্ষোভ! কেন ট্রাম্প বিরোধী আন্দোলনে নেমেছেন লাখ লাখ মানুষ?
এত আক্রমণ সত্ত্বেও তাঁর বিজয় কেবল নিউ ইয়র্ক নয়, সমগ্র বিশ্বের প্রগতিশীল রাজনীতির জন্য এক তাৎপর্যপূর্ণ বার্তা বহন করছে। ৮.৫ মিলিয়ন জনসংখ্যার এই শহরের বাজেটই ১১০ বিলিয়ন ডলার। জোহরান মামদানি উগান্ডায় জন্মগ্রহণ করেন, তবে তাঁর পরিবার ভারতের বংশোদ্ভূত। ছোটবেলায় তাঁর পরিবার যুক্তরাষ্ট্রে চলে আসে। রাজনীতিতে আসার আগে তিনি একজন সমাজকর্মী হিসেবে কাজ করেছেন— যারা ভাড়া থাকেন তাদের অধিকার, শিক্ষার সুযোগ এবং অভিবাসীদের ন্যায্য অধিকার নিয়ে আন্দোলন করেছেন। ২০২০ সালে তিনি নিউ ইয়র্ক স্টেট অ্যাসেম্বলিতে নির্বাচিত হন। সেই সময় থেকেই তিনি পরিচিতি পান 'জনগণের নেতা' হিসেবে।
মামদানির প্রচারের বার্তাই তরুণ ভোটার, অভিবাসী এবং নিম্ন-মধ্যবিত্ত শ্রমজীবী শ্রেণির মধ্যে গভীর প্রভাব ফেলে। মামদানির জয়কে মার্কিন সংবাদমাধ্যমগুলি 'রাজনৈতিক পালাবদলের ইঙ্গিত' বলে উল্লেখ করছে। বিশ্লেষকদের মতে, এই জয় প্রমাণ করে যে তরুণ ভোটাররা এখন এমন নেতৃত্ব চান, যারা শুধু প্রতিশ্রুতি নয়, বাস্তব পরিবর্তনের কথা বলেন।
আরও পড়ুন
মীরা নায়ারের পুত্র, মোদি সমালোচক— নিউ ইয়র্ককে দিশা দেখাবেন ভাবী মেয়র মামদানি?
প্রসঙ্গত, প্রথম থেকেই মামদানিকে নিয়ে ভারতের মিডিয়ায় চর্চা কম। মামদানি দক্ষিণ এশিয় সম্প্রদায়ের মধ্যে জোর প্রচার চালিয়েছিলেন। উর্দু ও হিন্দিতে বলিউড থিম ব্যবহার করেও প্রচার করেন। তিনি চলচ্চিত্র পরিচালক মীরা নায়ার ও শিক্ষাবিদ মাহমুদ মামদানির পুত্র। বিশ্লেষকরা বলছেন, ভারতের মিডিয়ার নীরবতার মূল কারণ মামদানির ধর্মীয় পরিচয়। তিনি একজন শিয়া মুসলিম। ঋষি সুনক বা প্রীতি প্যাটেলের মতো নেতাদের সাফল্যে গোদি মিডিয়া উচ্ছ্বসিত হয়, কিন্তু মামদানির জন্য সেই উচ্ছ্বাস নেই। গাজায় ইজরায়েলের হামলার বিরুদ্ধে জোহরান মামদানি বরাবরই প্রতিবাদ করেছিলেন। তাঁর এই অবস্থানের কারণেই হয়ত ভারতের মিডিয়া তাঁকে এড়িয়ে গিয়েছে, বলে মত ওয়াকিবহাল মহলের অনেকের।
এখন জোহরান মামদানির সামনে একাধিক বড়ো চ্যালেঞ্জ। তাঁর জয়ের পর মানুষ যেমন উচ্ছ্বসিত, তেমনি প্রত্যাশাও অনেক বেড়ে গিয়েছে। সবচেয়ে বড়ো সমস্যা হলো বাসস্থানের সংকট। নিউ ইয়র্কে বাড়ি ভাড়া অনেকটাই বেশি। সাধারণ মধ্যবিত্ত বা নিম্ন আয়ের মানুষদের পক্ষে ওই শহরে থাকা প্রায় অসম্ভব হয়ে উঠেছে। মামদানি প্রতিশ্রুতি দিয়েছেন, সাশ্রয়ী বাসস্থান নির্মাণ এবং ভাড়াটেদের অধিকার রক্ষার জন্য নতুন নীতি আনবেন। দ্বিতীয় বড়ো চ্যালেঞ্জ গণপরিবহন বা ট্রান্সপোর্ট ব্যবস্থা। শহরের সাবওয়ে ও বাস পরিষেবায় প্রতিদিন হাজার হাজার মানুষ যাতায়াত করেন, কিন্তু পরিষেবা অনিয়মিত ও নিরাপত্তা ব্যবস্থা দুর্বল। মামদানি বলেছেন, তিনি পরিবহন ব্যবস্থায় নতুন বাজেট বরাদ্দ করবেন। পাশাপাশি যাত্রী সুরক্ষায়ও কঠোর নজরদারি চালু করবেন। তৃতীয় চ্যালেঞ্জ আইনশৃঙ্খলা ও নাগরিক নিরাপত্তা। এছাড়াও পরিবেশ দূষণ, কর্মসংস্থান, অভিবাসীদের অধিকার এবং শিক্ষা সংস্কার— এই সব বিষয় নিয়েও তিনি কাজ করার প্রতিশ্রুতি দিয়েছেন।
তবে নিউ ইয়র্কের অনেকের বিশ্বাস, মামদানি তরুণ ও প্রগতিশীল নেতা। তাঁর নেতৃত্বে শহরটিতে সবার জন্য সমান সুযোগ করে দেওয়া হবে।

Whatsapp
