১ বছর পার! প্রতিশ্রুতি রাখতে পারল অন্তর্বর্তী সরকার?

Bangladesh: রিপোর্টে এই ব্যক্তিদের নাম, ছবি, বয়স এবং ঠিকানার পূর্ণাঙ্গ তালিকাও প্রকাশ করা হয়েছে। পরিসংখ্যান মিলিয়ে দেখা গিয়েছে, গণহিংসায় মৃত্যু বেড়েছে বারো গুণ।

বাংলাদেশের প্রাক্তন প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা ক্ষমতাচ্যুত হওয়ার পর এক বছর অতিক্রান্ত হয়েছে। পরিবর্তিত পরিস্থিতিতে অন্তর্বর্তী সরকার প্রতিশ্রুতি দিয়েছিল আইনশৃঙ্খলা, দ্রব্যমূল্য, অর্থনীতি, নির্বাচন-সহ বিভিন্ন বিষয়ে পরিবর্তন আনবে। অন্তর্বর্তী সরকারের এক বছর পূর্তিতে দেশবাসীর উদ্দেশে দেওয়া ভাষণে প্রধান উপদেষ্টা মুহাম্মদ ইউনূস বলেছিলেন, শুধু জুলাই-অগাস্টের হত্যাকাণ্ডেরই নয়, গত দেড় দশক যে অপকর্ম করেছে হাসিনা সরকার সে সব কিছুর বিচার হবে। সংস্কার কমিশনগুলো যে পদক্ষেপ নিয়েছে তার কথাও উল্লেখ করেছিলেন তিনি। দেখা যাক, এই এক বছরে কী কী প্রতিশ্রুতি পূরণ হল? এবং কী কী চ্যালেঞ্জের মুখে পড়েছে এই অন্তর্বর্তীকালীন সরকার?

গত বছর ৫ অগাস্ট বাংলাদেশের আওয়ামী লীগ সরকারের পতন হয়। এক টানা ষোলো বছর ক্ষমতায় ছিলেন আওয়ামী লীগ সরকারের সভানেত্রী তথা প্রাক্তন প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা। ২০২৪ সালের বাংলাদেশের সাধারণ নির্বাচনের কিছু মাস পরই বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলন এবং রক্তক্ষয়ী গণঅভ্যুত্থানের জেরে ক্ষমতাচ্যুত হন শেখ হাসিনা।

বৈষম্য বিরোধী ছাত্র আন্দোলনকে নিষ্ঠুরভাবে দমন করতে লেগে পড়েছিলেন শেখ হাসিনা। শিক্ষার্থীদের দাবি ছিল, স্থায়ী সমাধান না হওয়া পর্যন্ত আন্দোলন চলবে। জাতিসংঘের প্রতিবেদন অনুযায়ী, জুলাই আন্দোলনে মৃতের সংখ্যা অন্তত ১,৪০০। বাংলাদেশের ইতিহাসে প্রথম কোনো আন্দোলনে এত কম সময়ে এত মানুষের মৃত্যু হয়েছিল। এই ঘটনার এক বছর অতিবাহিত হয়েছে। শেখ হাসিনার পতনের পর ছাত্র প্রতিনিধি-সহ শপথ নেয় নতুন অন্তর্বর্তী সরকার। এখনও তারাই ক্ষমতায় রয়েছে। প্রশ্ন হল, এমন একটি শক্তিশালী আন্দোলনের পর গড়ে ওঠা সরকার এক বছরে কতটা বৈষম্য দূর করতে পারল?

অন্তর্বর্তী সরকার হিসেব দিয়েছিল, জুলাই-অগাস্টের গণহত্যায় বেশিরভাগ মানুষই গুলিবিদ্ধ হয়ে মারা গিয়েছেন। এই নিয়ে কয়েক শো মামলা করা হয়েছে। পুলিশ সদস্যদের পাশাপাশি অভিযুক্ত করা হয়েছে প্রাক্তন প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা-সহ আওয়ামী লীগের একাধিক নেতাকর্মীদের। অভিযুক্তদের বিরুদ্ধে গ্রেফতারি পরোয়ানাও জারি করা হয়েছে। মামালাগুলির বিচার শুরু হয়েছে আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইব্যুনালে। ট্রাইব্যুনালের প্রধান কৌঁসুলির কার্যালয়, আন্তজার্তিক পুলিশ সংস্থা ইন্টারপোলের কাছে অনুরোধ জানিয়েছে, প্রাক্তন প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনাকে গ্রেফতারের রেড অ্যালার্ট জারির জন্য। 

আরও পড়ুন- ৬ মাসেই পদত্যাগ! কেন বাংলাদেশ ছেড়ে পালাতে হয়েছিল শেখ হাসিনাকে?

সরকারের প্রতিনিধিরা বলেছিলেন, গণঅভ্যুত্থানে কুড়ি হাজারের বেশি মানুষ আহত হয়েছেন। আহতরা কেউ চোখ, কেউ হাত, কেউ পা হারিয়েছেন। অসংখ্য মানুষ পঙ্গু হয়ে গিয়েছেন। নতুন সরকার আহতদের চিকিৎসার জন্য এবং নিহত পরিবারগুলিকে আর্থিক সাহায্যের জন্য 'জুলাই শহিদ স্মৃতি' গঠন করেছিল। কিন্তু বাংলাদেশে এখনও আহতরা সুচিকিৎসার জন্য বিক্ষোভ করছেন।

ক্ষমতা পাওয়ার এক মাসের মধ্যেই সংবিধান, নির্বাচন ব্যবস্থা, পুলিশ, বিচারবিভাগ, দুর্নীতিদমন ও জনপ্রশাসন সংস্কার সব মিলিয়ে ছ-টি আলাদা কমিশন গঠন করে বাংলাদেশের অন্তর্বর্তীকালীন সরকার। পরবর্তী সময়ে আরও চারটি সংস্কার কমিশন (স্বাস্থ্যবিষয়ক, গণমাধ্যম, শ্রমিক অধিকারিক, নারী বিষয়ক) যুক্ত করা হয়েছিল। এই দশটি কমিশনের কোথায় কী সংস্কার হওয়া প্রয়োজন সেই নিয়ে কাজও শুরু হয়েছিল। এরপর রাজনৈতিক দলগুলোর মতামত নিয়ে চূড়ান্ত সংস্কার কাজের সিদ্ধান্ত নেওয়া হবে জানিয়েছিল সরকার কর্তৃপক্ষ। তবে এই সংস্কার-কাজ কবে শেষ হবে তা এখনও জানানো হয়নি। রাজনৈতিক বিশ্লেষকেরা সংস্কার-কাজ নিয়ে সুনাম করলেও, তাঁরা বলছেন আরও দ্রুত এবং সক্রিয় ভূমিকা পালন করা উচিত ছিল।

হাসিনা সরকারের প্রতি বাংলাদেশবাসীর ক্ষোভের অন্যতম কারণ ছিল দ্রব্যমূল্য বৃদ্ধি। বাংলাদেশ পরিসংখ্যান ব্যুরো (বিবিএস)-এর তথ্য অনুযায়ী, হাসিনা ক্ষমতা হারানোর আগে বাংলাদেশে মুদ্রাস্ফীতি ছিল ১১.৬৬%। অন্তর্বর্তীকালীন সরকার আসার পর মুদ্রাস্ফীতি কমলেও খুচরো বাজারে এর তেমন প্রভাব পড়েনি। বর্তমান সরকার সুদের হার বাড়ানোর পাশাপশি নতুন করে টাকা না ছড়িয়ে মুদ্রাস্ফীতির পরিস্থিতি সামাল দিতে চেয়েছিল। কিন্তু তেল, চিনির মতো নিত্য প্রয়োজনীয় পণ্যের শুল্কহার কমিয়েও দাম নিয়ন্ত্রণ করতে পারছে না সরকার।

হাসিনা আমলের শেষ দিকে বাংলাদেশের বৈদেশিক মুদ্রার রিজার্ভ কমে পনেরো বিলিয়ন মার্কিন ডলারের নিচে নেমে গিয়েছিল। অন্তর্বর্তী সরকার ক্ষমতা নেওয়ার পর সেটি বৃদ্ধি পেয়েছে। এটিএম ও অন্যান্য ব্যবস্থায় টাকা তোলার ক্ষেত্রে সীমা নির্ধারণ-সহ নানা পদক্ষেপ নেওয়া হলেও, ব্যাঙ্কখাতের যে সংকট ছিল তা এখনও কাটিয়ে ওঠা যায়নি বলেই মনে করছেন বিশেষজ্ঞরা। সরকার পক্ষ জানিয়েছিল, ব্যাঙ্কখাত সংস্কার ও অনিয়ম-দুর্নীতিরোধে একটি ব্যাঙ্কিং কমিশন গঠনের সিদ্ধান্ত নেওয়া হয়েছে। কিছু ব্যাঙ্কের বোর্ড নতুন করে গঠন করা হয়েছে। খেলাপি ঋণ ও বিদেশে পাচার হওয়া অর্থ ফেরত আনতে প্রয়োজনীয় পদক্ষেপ নেওয়া হয়েছে। বাংলাদেশ ব্যাঙ্ক, দেশের দুর্বল ব্যাঙ্কগুলিকে আর টাকা ধার দিচ্ছে না। তবে কেন্দ্রীয় ব্যাঙ্ক পরামর্শ দিয়েছে, যাতে বাণিজ্যিক ভাবে ভালো পরিস্থিতিতে থাকা ব্যাঙ্কগুলি দুর্বল ব্যাঙ্কগুলিকে উঠে আসতে সাহায্য করে। বাংলাদেশ ব্যাঙ্কের গভর্নর আহসান এইচ মনসুর সাংবাদিকদের বলেছিলেন, "গত পনেরো বছর ধরে দুর্বৃত্তায়নের মাধ্যমে ব্যাঙ্কিং খাত থেকে কোটি কোটি টাকা লুটপাট করা হয়েছে। তবে এখন কোনও আর্থিক প্রতিষ্ঠান যেন বন্ধ হয়ে না যায় সেজন্য সর্বোচ্চ চেষ্টা করছি।' যদিও এখনও দুর্বল ব্যাঙ্কগুলি গ্রাহকের টাকা দিতে নাজেহাল পরিস্থিতিতে পড়ছে।

অন্তর্বর্তী সরকার দেশটির আইনশৃঙ্খলা নিয়ে সবচেয়ে বেশি চ্যালেঞ্জের মুখে পড়েছে। ৫ অগাস্টের পর হামলার শিকার হওয়া সব পুলিশ ফাঁড়ি এবং থানাগুলিকে এখনও পুরোপুরি কাজ করার মতো পরিস্থিতিতে আনা যায়নি। এতে বিভিন্ন এলাকায় অপরাধের ঘটনা অনেকটাই বেড়ে ছিল। ছিনতাই, ডাকাতি, চাঁদাবাজি ও হত্যাকাণ্ডের ঘটনা এখনও বন্ধ করা যায়নি। তবে, জুলাই আন্দোলনের তিন মাস পর সেনাবাহিনীরা এক ব্রিফিং-এ জানিয়েছিল, গণঅভ্যুত্থানে পর থানা থেকে লুট হওয়া ৭,০০০ অস্ত্র দুই লক্ষের বেশি গুলি উদ্ধার করা গিয়েছে। এর পাশাপশি, লুঠপাটের সঙ্গে জড়িত আড়াই হাজার ব্যক্তিকে গ্রেফতার করা সম্ভব হয়েছে।

আরও পড়ুন- ‘মার্চ টু ঢাকা’ কর্মসূচি! গত বছর ৫ অগাস্ট কী হয়েছিল বাংলাদেশে?

কানাডার ‘গ্লোবাল সেন্টার ফর ডেমোক্র্যাটিক গর্ভন্যান্স’ সংস্থার রিপোর্ট অনুযায়ী, গত এক বছরে গণহিংসার ঘটনায় বাংলাদেশে মৃত্যু হয়েছে ছ-শো সাঁইত্রিশ জনের। রিপোর্টে এই ব্যক্তিদের নাম, ছবি, বয়স এবং ঠিকানার পূর্ণাঙ্গ তালিকাও প্রকাশ করা হয়েছে।  ২০২৩ সালে বাংলাদেশে পিটিয়ে মারার ঘটনায় মৃত্যুর সংখ্যা একান্ন জনের। পরিসংখ্যান মিলিয়ে দেখা গিয়েছে, গণহিংসায় মৃত্যু বেড়েছে বারো গুণ।

উল্লেখ্য, গণঅভ্যুত্থানে সবচেয়ে উল্লেখযোগ্য ভূমিকা রেখেছিল বৈষম্য বিরোধী ছাত্র আন্দোলনের সঙ্গে যুক্ত ছাত্ররা। কিন্তু বছর ঘুরতে-না-ঘুরতেই তাল কাটছে। দেখা যাচ্ছে, বাংলাদেশ জুড়ে মভ সন্ত্রাস চলছে এ বং দুর্নীতির মতো অভিযোগ উঠছে। বৈষম্য বিরোধী ছাত্র আন্দোলনের সাবেক মুখপাত্র ও সমন্বয়ক উমামা ফাতেমা সম্প্রতি সেই আন্দোলন থেকে বিযুক্ত হওয়ার বার্তা দিয়েছেন সমাজমাধমে। তাঁর বক্তব্য জুলাই আন্দোলন এখন একটা 'মানি মেকিং-মেশিন' হয়ে গিয়েছে। ২৭ জুলাই দীর্ঘ ফেসবুক লাইভে আন্দোলনের অভ্যন্তরীণ নানা অনিয়ম, দুর্নীতি ও তাঁর ব্যক্তিগত অভিজ্ঞতা তুলে ধরে আলোচনার ঝড় তুলেছেন উমামা। তিনি মন্তব্য করেছেন, ‘‘জুলাই কেন ‘মানি-মেকিং মেশিন’ হবে? আনফরচুনেটলি সেটা হয়েছে’’। ২ ঘণ্টা ২৪ মিনিটের এই লাইভে তিনি জানান, কীভাবে একটি ছাত্রভিত্তিক আদর্শিক আন্দোলন ধীরে ধীরে কিছু মানুষের জন্য ‘আয়-উপার্জনের উৎস’-এ পরিণত হয়েছে।

বাংলাদেশে হাসিনা সরকারের পতনের পর থেকে বহুবার জনগণ নির্বাচন অনুষ্ঠিত করার দাবি তুলেছে। একশো দিনের পূর্তিতেও প্রধান উপদেষ্টা ইউনূস বলেছিলেন, "কখন নির্বাচন হবে, সেটি সম্পূর্ণ রাজনৈতিক সিদ্ধান্ত, এটা আমার সিদ্ধান্ত নয়।" তবে সম্প্রতি চাপের মুখে পড়েই অন্তর্বর্তী সরকারকে আশ্বাস দিতে হয়েছে। অন্তর্বর্তীকালীন সরকারের প্রধান উপদেষ্টা ইউনূস বর্ষপূর্তির ভাষণে জানিয়েছেন, ১৭ বা ১৮ ফেব্রুয়ারি রমজান মাস শুরু হওয়ার আগেই যেন নির্বাচন করা হয় যেন তার জন্য নির্বাচন কমিশনকে অনুরোধ করা হবে। কবে দেশটির নির্বাচন-সহ বাকি প্রতিশ্রুতি পূরণ হবে, সেটারই এখনও অপেক্ষা করছেন বাংলাদেশবাসী। প্রশ্ন উঠছে, বৈষম্যবিরোধীরা আসলে অভ্যন্তরীণ সংঘাতে ছিন্নবিচ্ছিন্ন? তাই যদি হয়, কার উপর বিশ্বাস রাখবে বাংলাদেশের মানুষ?

More Articles