Fact Check: ব্রিগেডে প্যাটি বিক্রেতা ভেজ বলে চিকেন প্যাটি বিক্রি করছিলেন?

Chicken Patties Fact Check: ভিডিওতে স্পষ্ট দেখা যাচ্ছে, বাক্সে একদিকে তিন কোনা প্যাটি (যেগুলো সাধারণত ভেজ প্যাটি হয়), আরেক দিকে চৌকো (চিকেন প্যাটি) রয়েছে।

গত ৭ ডিসেম্বর, রবিবার ব্রিগেডে গীতাপাঠের অনুষ্ঠানের আয়োজন করা হয়। সনাতন সংস্কৃতি সংসদ আয়োজিত এই অনুষ্ঠানে আগত কয়েকজন চিকেন প্যাটি বিক্রির অপরাধে এক ব্যক্তিকে মারধর করে বলে অভিযোগ ওঠে। সমাজমাধ্যমে ওই বিক্রেতাকে হেনস্থা করার ভিডিও ভাইরাল (ভাইরাল ভিডিওর সত্যতা যাচাই করেনি ইনস্ক্রিপ্ট) হয়। যেখানে দেখা যায়, ওই বিক্রেতাকে ঘিরে ধরে কয়েকজন হুঁশিয়ারি দিচ্ছে, “এখানে চিকেন বিক্রি করবে! এত সাহস হয় কী করে?” দেওয়া হয় গলা ধাক্কা। কান ধরে উঠবস করানোও হয়। চাপ দেওয়া হয়, নাম বলার জন্য। বিক্রেতার নাম রিয়াজুল শুনেই ফের মারধর। ক্ষমা চাইলেও নিস্তার নেই, প্যাটি ফেলে দেওয়া হয় মাটিতে। লাথি মেরে ভেঙে দেওয়ার চেষ্টা হয় প্যাটি বাক্স। ভিডিওতে দেখা যায়, প্যাটি বিক্রেতাকে মারধরকারীদের কারোর মাথায় গেরুয়া পাগড়ি, কারোর পরনে নামাবলীর মতো পোশাক। এই ভিডিও ভাইরাল হতেই, নিন্দার ঝড় ওঠে সচেতন বাঙালি সমাজে।

এরপরই সামাজিক মাধ্যমে আরও একটি ভিডিও ছড়িয়ে দিয়ে দাবি করা হয়, ওই প্যাটি বিক্রেতা মিথ্যে কথা বলে, ভেজ প্যাটি বলে চিকেন প্যাটি বিক্রি করছিলেন। ভাইরাল ওই ভিডিওতে দেখা যায় প্যাটির থেকে চিকেন বের করে দেখাচ্ছেন এক ব্যাক্তি। কিন্তু সত্যিই কি শুধু চিকেন প্যাটি বিক্রি করছিলেন ওই বিক্রেতা? ভিডিওতে স্পষ্ট দেখা যাচ্ছে, বাক্সে একদিকে তিন কোনা প্যাটি (যেগুলো সাধারণত ভেজ প্যাটি হয়), আরেক দিকে চৌকো (চিকেন প্যাটি) রয়েছে। এখানে ছোঁয়াছুঁয়ির কোনো বিষয় নেই। এ ধরনের সংস্কার যাদের আছে, তারা সাধারণত বাইরের খাবার খান না।

প্যাটি বিক্রেতা শেখ রিয়াজুল

ইনস্ক্রিপ্টকে শেখ রিয়াজুল জানিয়েছেন, চিকেন এবং ভেজ দু’রকমের প্যাটিই বিক্রি করেন তিনি। রবিবারও ময়দানে তাই বিক্রি করছিলেন। তিনকোনা প্যাটিগুলি ভেজ প্যাটি এবং চৌকোগুলি চিকেন প্যাটি। এমনকি ক্রেতাকে জিজ্ঞেস করেই বিক্রি করছিলেন, “ভেজ নাকি চিকেন?” এদিকে চিকেন প্যাটি বিক্রি করা হচ্ছিল বলে সমাজমাধ্যমে যে প্রচার চালানো হচ্ছে, তাতে আরও প্রকট হচ্ছে ঘৃণার পরিবেশ। ভুল বার্তা ছড়িয়ে দিয়ে মানুষের মন বিষিয়ে দেওয়ার চেষ্টা চলছে। যে বাংলা এতদিন সাম্প্রদায়িক সম্প্রীতির ছবি তুলে ধরেছে। সেখানেই ছড়িয়ে পড়ছে সাম্প্রদায়িক দ্বেষ। উদ্দেশ্যটা কী?   

Comment Screenshot

প্যাটি বিক্রেতার বিরুদ্ধে যেভাবে ঘৃণার বার্তা ছড়াচ্ছে সমাজমাধ্যমে

গীতাপাঠের অনুষ্ঠানে ঠিক কী ঘটেছিল? রিয়াজুল জানান, “হঠাৎই দশ-বারো জন এসে ঘিরে ধরে জিজ্ঞেস করতে থাকে কী বিক্রি করছিস।” দু’রকম প্যাটির কথায় বলেন রিয়াজুল। চিকেন শুনেই মারধোর শুরু করে, বিশজন মতো লোক জড়ো হয়ে যায় বলে জানান ওই প্যাটি বিক্রেতা। “কেউ কেউ মারতে বারণ করছিল। কিন্তু তারপরও ছাড়েনি। গালে চড় মারে, কান ধরে উঠবস করতে বাধ্য করা হয়। আমি ক্ষমা পর্যন্ত চেয়েছি কিন্তু ছাড়েনি। অথচ সেদিন ব্রিগেডে চিকেন প্যাটিই বেশি বিক্রি হয়েছে। সবাইকে জিজ্ঞেস করেই বিক্রি করছিলাম। কিন্তু এতজন মিলে হুমকি দেওয়ায় ভীষন ভয় পেয়ে গেছিলাম সে’সময়। কুড়ি বছর ধরে কলকাতায় ব্যবসা করছি। এত হেনস্থা কখনও হইনি।” বলেন শেখ রিয়াজুল। রিয়াজুলের তিন হাজার টাকার খাবার নষ্ট হয়। বাক্সটিও ঠিক করতে তিনশো টাকা খরচ করতে হয়েছে বলে জানান তিনি।

আরও পড়ুন- নরম হিন্দুত্ব! কেজরিওয়ালের পথেই হাঁটছেন মমতা?

ময়দান ছাড়াও কলকাতার বিভিন্ন জায়গায় ঘুরে ঘুরে প্যাটি বিক্রি করেন রিয়াজুল। যেখানে কোনো অনুষ্ঠানের খোঁজ পান, অনেক মানুষের জমায়েত হয়, সেখানে প্যাটি নিয়ে পৌঁছে যান হুগলির আরামবাগের বাসিন্দা শেখ রিয়াজুল। এদিন গীতাপাঠের ময়দানে রিয়াজুল ছাড়াও হেনস্থার শিকার হন তপসিয়ার মোহম্মদ সালাউদ্দিনও। খবর, প্যাটি বিক্রেতাকে মারধরের ঘটনায় ১১ ডিসেম্বর তিনজনকে গ্রেফতার করেছে ময়দান থানায় পুলিশ। ধৃতদের মধ্যে রয়েছেন উত্তর ২৪ পরগনার গোবরডাঙার সৌমিক গোলদার, হুগলির উত্তরপাড়ার তরুণ ভট্টাচার্য এবং অশোকনগরের স্বর্ণেন্দু চক্রবর্তী। 

তবে, রিয়াজুলের বক্তব্য, “আমার তো যা ক্ষতি হওয়ার হয়েছে। আমি শুধু চাই, আর কারোর সঙ্গে যেন এমন ঘটনা না ঘটে। কাউকে যেন ভয়ে ভয়ে থাকতে না হয় আমিষ খাবার বিক্রি করার জন্য।”

কথায় আছে, মাছে-ভাতে বাঙালি। বাঙালির রোজকার খাদ্যাভ্যাসে আমিষ খাবার সাধারণত থাকেই। ধর্মচারণের সঙ্গে আহারের যোগ নেই বলেই ধরা হয়ে থাকে প্রগতিশীল বাংলায়। স্বাভাবিকভাবেই প্রশ্ন উঠেছে, বাংলার, বাঙালির জীবনধারাতেই কি তবে পরিবর্তন আসছে? আমিষ খাওয়াটাও কি আতঙ্কের কারণ হয়ে উঠছে পশ্চিমবঙ্গে? এটাই বিজেপির উদ্দেশ্য ছিল? সংখ্যালঘু মুসলিম সম্প্রদায়ের মানুষের বিরুদ্ধে হিন্দুদের দাঁড় করানো। সেটা ভাষা, পোশাক, খাদ্য যা দিয়ে করা যায়, তাই শ্রেয়। বলাই বাহুল্য, সে'পথে সফলভাবেই এগোচ্ছে গেরুয়া শিবির। মানুষের রুটি-রুজি নয়, রাজনীতিতে-চায়ের ঠেকে এখন চর্চার বিষয় মন্দির-মসজিদ। প্রগতিশীল বাঙালি সমাজ কি এর বিরোধিতা করতে পারবে? বাংলার সংস্কৃতি, সাম্প্রদায়িক সম্প্রীতি বজায় রাখতে পারবে?  

More Articles