গীতাপাঠে প্যাটি বিক্রেতাকে হেনস্থা! কে কী খাবে, তা ঠিক করবে কে?

Gita recitation event controversy: রিয়াজুলের অভিযোগ, আক্রমণকারীরা প্রথমেই জানতে চেয়েছিল তিনি মাংস বিক্রি করছেন কি না। তিনি হ্যাঁ বলতেই তারা একটা কথাও শুনতে চায়নি। তর্ক-বিতর্ক তো দূরের কথা।

কলকাতার ব্রিগেড প্যারেড গ্রাউন্ড, শহরের সবচেয়ে বড় আর খোলামেলা ভিড়ের জায়গাগুলির মধ্যে একটি। রোববার সেখানে গীতাপাঠের অনুষ্ঠান চলছিল, চারদিকে মানুষ আর মাইকের শব্দ। ঠিক সেই সময় হঠাৎই ভিড়ের মধ্যে অস্বস্তিকর একটা গোলমাল তৈরি হয়। ধর্মীয় পরিবেশের মধ্যে সেই গর্জন একেবারেই মানায়নি। মুহূর্তেই বোঝা গেল, কলকাতার উদারতার পরিচিতি যেন কোথাও যাচ্ছেতাই ভাবে টাল খাচ্ছে।

বছরের পর বছর ধরে হুগলির বাসিন্দা শেখ রিয়াজুল মাঠে ঘুরে ঘুরে প্যাটি বিক্রি করে জীবনসংগ্রাম চালিয়েছেন। আমিষ-নিরামিষ দুই ধরনের খাবার নিয়ে প্রতিদিনের মতো তিনি ব্রিগেড প্যারেড গ্রাউন্ডে এসেছিলেন। তবে তাঁর কাছে দিনটি অন্য দিনের মতো ছিল না। এদিন তাঁকে প্রশ্নের মুখোমুখি হতে হলো, চিকেন প্যাটি আছে কিনা? সেই প্রশ্নের উত্তর দিতে না দিতেই শুরু হলো ধাক্কাধাক্কি, হেনস্তা, চড়-থাপ্পড়, খাবার মাটিতে ছুঁড়ে ফেলা। যেন কোনো অপরাধীকে শাস্তি দেওয়া হচ্ছে। যেন একজন বিক্রেতা আমিষ প্যাটি বিক্রি করলেই তিনি আইনভঙ্গ করেন। কে বলবে এটি কলকাতা— যে শহর নিজের খাদ্যাভ্যাসকে নিয়ে কখনোই সংকীর্ণ ছিল না? যে শহর নানারকম স্বাদের জন্য পরিচিত? সেই কলকাতাতেই কি আমিষ বিক্রির অভিযোগে কেউ হেনস্থার শিকার হবেন?

রিয়াজুলের অভিযোগ, আক্রমণকারীরা প্রথমেই জানতে চেয়েছিল তিনি মাংস বিক্রি করছেন কি না। তিনি হ্যাঁ বলতেই তারা একটা কথাও শুনতে চায়নি। তর্ক-বিতর্ক তো দূরের কথা। সরাসরি হাত তুলেছে, প্যাটি রাখা বাক্স ফেলে দিয়েছে, আর তাঁকে কান ধরে উঠবস করিয়েছে। প্রায় তিন হাজার টাকার খাবার এক মুহূর্তেই নষ্ট হয়ে যায়। একজন পরিশ্রমী মানুষের দিনের উপার্জনই শুধু নয়, তাঁর সম্মানটুকু পর্যন্ত কেড়ে নেওয়া হয়।

আরও পড়ুন

লক্ষকণ্ঠে গীতাপাঠের আয়োজক ঠিক কারা, নেপথ্যে রয়েছে যে রাজনৈতিক ইতিহাস

একই ধরনের হেনস্তার মুখে পড়েন আরেক খাদ্যবিক্রেতা মোহাম্মদ সালাউদ্দিন। বয়স ৫০, ২০ বছর ধরে এই পেশায় যুক্ত। শুধুমাত্র আমিষ খাওয়ার বিক্রির অভিযোগেই তাঁদের অপরাধী হিসেবে চিহ্নিত করা হলো। এই আক্রমণকারীরা কারা? তাদের পরিচয় এখনও স্পষ্ট নয়। তবে অভিযোগ উঠেছে, গীতাপাঠ অনুষ্ঠানে অংশ নিতে এসেছিল তারা। প্রশ্ন হলো, ধর্মীয় আচার পালনের নামে কি কোনো ভাবেই অন্যের খাদ্যাভ্যাস বা পেশায় এমন হস্তক্ষেপ করা যায়?

ময়দান থানায় অভিযোগ দায়ের হয়েছে। ডিসিপি সাউথ জানিয়েছেন, তদন্ত শুরু হয়েছে। ৩ জনকে গ্রেফতারও করা হয়েছে। কিন্তু প্রশ্ন হলো, এই যে মানুষের মধ্যে আমিষ খাওয়া নিয়ে একটা আতঙ্ক তৈরি হলো, তার দায় কে নেবে? আয়োজকদের দাবি, তাঁরা কখনও আমিষ বিক্রি করতে নিষেধ করেননি। কেউ সহিংসতা করলে আইনি ব্যবস্থা নেওয়া উচিত বলেও তাঁরা নিন্দা জানিয়েছেন। কিন্তু নিন্দা কি যথেষ্ট? লাখ লাখ মানুষের জন্য আয়োজন করা গীতাপাঠে কি আলাদা নজরদারি দল ছিল, যারা নিশ্চিত করবে বাইরে যেন কোনো মত-বিশ্বাসের নামে বিশৃঙ্খলা না ছড়ায়? এখন নিন্দাই যেন তাদের শেষ দায়িত্ব। আয়োজকদের বোঝা উচিত, শুধু অনুষ্ঠান করলেই দায়িত্ব শেষ হয় না; মানুষের নিরাপত্তা নিশ্চিত করাও দায়িত্বের মধ্যে পড়ে।

২০২৩ সালের ডিসেম্বরেও কলকাতায় এমনই এক অনুষ্ঠান হয়েছিল, লোকসভা নির্বাচনের আগে যার প্রতি গেরুয়া শিবিরের আগ্রহ ছিল স্পষ্টভাবে নজরকাড়া। আর চলতি বছর সেই আয়োজন আরও বড় পরিসরে হয়েছে— জমায়েতও বেড়েছে। জমায়েত প্রসঙ্গে শুভেন্দু অধিকারীর মতো নেতাদের প্রকাশ্যে মন্তব্য করতেও শোনা গিয়েছে।
রবিবারের গীতা পাঠের এই অনুষ্ঠানে উপস্থিত ছিলেন রাজ্যের বিরোধী দলনেতা শুভেন্দু অধিকারী, বিজেপির রাজ্য সভাপতি শমীক ভট্টাচার্য, কেন্দ্রীয় মন্ত্রী সুকান্ত মজুমদার, দিলীপ ঘোষ, তথাগত রায়, রাহুল সিনহাসহ গেরুয়া শিবিরের বহু শীর্ষনেতা।

হেনস্তাকারী যে-ই হোক, তারা যে বার্তাটা দিতে চেয়েছে, তা ভয়ঙ্কর। এই মানসিকতা জনসমক্ষে ছড়িয়ে পড়লে সমাজ ভয়াবহ বিপন্ন হয়ে পড়ে। এসব ঘটনার পর বহু নাগরিক প্রশ্ন তুলছেন, যদি ব্রিগেডের মতো উন্মুক্ত জায়গায় হাজারো মানুষের সামনে একজন বিক্রেতা মারধরের শিকার হন, তবে সাধারণ মানুষের নিরাপত্তা কোথায়?আয়োজকরা দাবি করেছেন তারা সহিংসতার পক্ষে নন, কিন্তু প্রশ্ন ওঠে, তাঁরা কি ঘটনা ঘটার সঙ্গে সঙ্গে পুলিশ বা নিরাপত্তারক্ষীদের সতর্ক করেছিলেন? তাঁরা কি ভবিষ্যতে এমন ঘটনা প্রতিরোধে কোনো ব্যবস্থা নেবেন?

আরও পড়ুন

‘বেটি বাঁচাও, বেটি পাড়াও ’, ‘স্বচ্ছ ভারত অভিযান’! সরকারী অনুদান দেখিয়ে টাকা নিয়েছিল বিজেপিই?

রাজনৈতিক প্রতিক্রিয়া বরাবরই দ্রুত আসে। বিরোধীরা দাবি তুলেছে, এটি উত্তর প্রদেশ-মডেলের ‘খাদ্য নিয়ন্ত্রণ’ রাজনীতির প্রতিফলন। তারা সরব একটি নিরীহ বিক্রেতাকে ধর্মীয় আবেগের অজুহাতে হেনস্তা করা কখনোই এই রাজ্যের সংস্কৃতি নয়। তৃণমূল, বাম, কংগ্রেস সবাই বলছে, এই ঘটনা অত্যন্ত লজ্জাজনক। কিন্তু রাজনৈতিক প্রতিক্রিয়া বা বিরোধীদের সমালোচনাই বা আর কতদিন চলবে?

একটি ব্যাপার না বললেই নয়, কোনো সংগঠন দায় নিচ্ছে না, পুলিশ ৩ জনকে গ্রেফতার করেছে ৪ দিন পর, তাহলে কি ধরে নিতে হবে যে পশ্চিমবঙ্গে এখন মাংস বিক্রি করাও ঝুঁকির? যে কেউ এসে বলবে, 'এটা নিষিদ্ধ' আর মুহূর্তে মারধর শুরু করে দেবে? পশ্চিমবঙ্গে কি তবে আমিষ খাবার বিক্রি করা অপরাধ হয়ে দাঁড়াল? প্রশ্ন হলো, এ রাজ্যের সাধারণ মানুষ কি তবে নতুন করে ভাববে, তারা কী খাবে? কোথায় কোন খাবার বিক্রি করলে বিপদ হতে পারে? কোনো ধর্মীয় অনুষ্ঠানের কাছাকাছি গেলে কী বিপত্তি ঘটতে পারে?

গীতা পাঠের অনুষ্ঠানে কেউ যদি একজন প্যাটি বিক্রেতাকে তাঁর কাজ করার জন্য অপমান ও মারধর করে, তবে সেটি কি আদৌ ধর্মীয় আবহ? নাকি এটি সমাজে ভয়ের পরিবেশ ছড়ানোর এক সুস্পষ্ট প্রচেষ্টা? যে শহর ফিশ ফ্রাই থেকে বিরিয়ানি, লুচি থেকে চিকেন প্যাটি সবকিছুকে নিজের সংস্কৃতির অংশ হিসেবে মনে করত, সেই শহর কি ধীরে ধীরে বদলে যাচ্ছে? আমরা কি এমন এক অবস্থার দিকে যাচ্ছি যেখানে যে কেউ এসে বলে দেবে, আজ তোমার এই খাওয়া নিষিদ্ধ, কাল তোমার ব্যবসা বন্ধ, আরেক দিন এসে বলবে তোমার উপস্থিতিই অপছন্দ?

এই ঘটনার পিছনে শুধু কিছু উত্তেজিত মানুষের বেপরোয়া আচরণ নেই; আছে সমাজকে ভয় দেখানোর প্রবণতা, আছে দৈনন্দিন জীবনে অনধিকার হস্তক্ষেপের চেষ্টা। যদি এই প্রবণতা রুখে না দেওয়া যায়, তবে আগামী দিনে আরও বড় সমস্যার সৃষ্টি হবে। ব্রিগেডের এই ঘটনা তাই শুধু একজন রিয়াজুল বা সালাউদ্দিনের সঙ্গে ঘটে যাওয়া ঘটনা নয়, এটি এই শহরের বিবেককে নাড়া দেওয়া একটি সতর্ক সংকেত। মাংস খাওয়া কি সত্যিই এত বড় অপরাধ? নাকি কারও রাজনৈতিক বা সামাজিক বিশ্বাসের নামে মানুষকে নিগ্রহ করার পথ তৈরি করা হচ্ছে? কে কী খাবে, তা ঠিক করার অধিকারই বা কার?

More Articles