টাকার লোভ আর ক্ষমতার দেমাক,মেসি আসায় যে নর্দমার ঢাকনা খুলে গেল

Messi Kolkata chaos: ভাঙা চেয়ার বদলানো হবে, কিন্তু ভাঙা বিশ্বাস? ভাঙা সম্মান? মেসি এসেছিলেন আনন্দ দিতে। কিন্তু রেখে গেলেন লজ্জা

শনিবার যুবভারতী ক্রীড়াঙ্গনে একটা অস্বস্তি যেন বুকের ভিতর চেপে বসল। উৎসব হওয়ার কথা ছিল। ইতিহাস রচনার কথা ছিল। কিন্তু...

কলকাতা দেখেছে এই শহরের রাস্তায় মারাদোনা হেঁটেছেন, পেলে মাঠে নেমেছেন। মেসিও এসেছেন আগে। কিন্তু সেই সব স্মৃতি ছিল উচ্ছ্বাসের,গর্বের। শনিবারের যুবভারতী  হয়ে উঠল এক বিশৃঙ্খলার দলিল, ভারতীয় ফুটবলের এক কলঙ্কিত পাতা। 

সারা ভারত থেকে ৫০০০ থেকে ৫০০০০ টাকায় টিকিট কেটে মেসির ভক্তরা স্টেডিয়ামে এসেছিলেন, এক ঝলক মেসিকে দেখবেন বলে। চোখের সামনে ইতিহাস হাঁটবে, এই স্বপ্ন নিয়েই।  বেলা সাড়ে এগারোটা নাগাদ মেসির গাড়ি যুবভারতীতে ঢোকে। সঙ্গে লুই সুয়ারেজ, রদ্রিগো ডি’পল। গ্যালারিতে তখন জনজোয়ার। মেসি গাড়ি থেকে নামার সঙ্গে সঙ্গেই নেতা, মন্ত্রী, তাঁদের আত্মীয়-পরিজন ও ঘনিষ্ঠরা তাঁকে ঘিরে ধরেন। ভিড় এতটাই যে গ্যালারি থেকে দাঁড়িয়ে মেসিকে দেখার কোনও সুযোগই ছিল না।

এখানেই প্রথম প্রশ্ন আসে, এই অনুষ্ঠান কাদের জন্য ছিল? আদপে ক্রীড়ানুষ্ঠান ছিল, নাকি ছিল  ক্ষমতাবানদের ব্যক্তিগত প্রচার আর বাণিজ্যিক প্রদর্শনের মঞ্চ? ক্রীড়ামন্ত্রী অরূপ বিশ্বাসের ঘনিষ্ঠ বৃত্তকে সামনে রেখে যুবভারতীতে যে ছবি উঠে এল, তাতে মনে হচ্ছে, একটি পারিবারিক অ্যালবামকে ‘আরও ঝকঝকে’ করার প্রকল্পের খেসারত দিল গোটা কলকাতা।

তারপর যা হল, সেটা শুধু ক্ষোভ নয়, একটা বিস্ফোরণ। বাকেট চেয়ার ভাঙল। বোতল উড়ল। হাজার হাজার মানুষ মাঠে নেমে পড়লেন। গোলপোস্টের জাল খুলে নেওয়া হল। যুবভারতী ক্রীড়াঙ্গন, মুহূর্তে পরিণত হল বিশৃঙ্খলার মঞ্চে। যদিও ‘মিট অ্যান্ড গ্রিট’ প্যাকেজ। ১০ লক্ষ টাকা খরচ করে একটি হোটেলে গিয়ে মেসির সঙ্গে হাত মেলানো, ছবি তোলা, প্রিমিয়ার লাউঞ্জে বিশেষ আপ্যায়নের সুযোগের  খবর পূর্বেই কিছুটা ইঙ্গিত দিয়েছিল; গোটা আয়োজনটিই সাধারণ দর্শকের জন্য নয় বরং বিত্তশালী ও প্রভাবশালীদের কথা ভেবেই সাজানো । তবু প্রশ্ন ওঠেই পুলিশ কোথায় ছিল? নিরাপত্তার দায়িত্বে কারা ছিলেন? এত মানুষের জমায়েতের অনুমতি দিল কে, কী শর্তে? পশ্চিমবঙ্গের দূর দূরান্ত থেকে যারা মেসিকে দেখতে এলেন? তাঁরা কী পেলেন? নিরাশা, প্রতারণা, পুলিশের বাটাম!

যেই দর্শকদের নিরাপত্তার অজুহাতে জলের বোতল পর্যন্ত সঙ্গে নিয়ে ঢুকতে দেওয়া হয়নি, উল্টে তাঁদের স্টেডিয়ামের ভিতরে বাধ্য করা হয়েছিল ২০ টাকার জল ২০০ টাকায় কিনতে। খেসারত কি বারবার সেই সাধারন দর্শকই দেবেন? কেউ হয়তো বিয়ের দিনেও মেসিকে এক ঝলক দেখতে এসেছিলেন। পরিবার, পরিজন, আত্মীয়, বন্ধুবান্ধব সবাইকে সঙ্গে নিয়ে যারা কাজ ছুটি নিয়ে সময় বের করে, টাকার অঙ্ককে তোয়াক্কা না করে শুধু এক ঝলক মেসিকে দেখতে এসেছিলেন তাদের দোষটা কোথায়? সঠিক সমন্বয়ের অভাবে পুলিশ এই ক্ষোভ সামলাতে পারলেন না। নীরব দর্শকও পরে দর্শকদের পিটিয়ে মনের জ্বালা মেটালেন। অনেকে মেসিকে না দেখতে পাওয়ার আক্ষেপ পূরণ করলেন স্টেডিয়াম থেকে ফুলের টব বাড়ি নিয়ে গিয়ে। কলকাতায় কিন্তু এই কাজটা সুষ্ঠ ভাবে করে দেখিয়েছিলেন মদন মিত্র। আজ যাঁরা মদন মিত্রকে দূরে সরিয়ে রাখলেন তাঁরা কি সুষ্ঠ ভাবে কাজটা করতে পারলেন? পারলেন না।

আর ঠিক এই নৈরাজ্যের মাঝেই সবচেয়ে যন্ত্রণাদায়ক দৃশ্যটা চোখে পড়ল। মোহনবাগান ও ডায়মন্ড হারবার অলস্টারের প্রাক্তন ফুটবলারদের সঙ্গে মেসির পরিচয় করানোর কথা ছিল। কিন্তু লালকমল ভৌমিক,অসীম বিশ্বাস, সংগ্রাম মুখোপাধ্যায় ,দীপক মণ্ডল- বাংলা ফুটবলের পরিচিত মুখগুলো যাঁরা একদিন দেশের জার্সিতে খেলেছেন, আন্তর্জাতিক ম্যাচে গোল করেছেন, বিদেশি কোচের প্রশংসা কুড়িয়েছেন আজ তাঁরাই ধাক্কা খেলেন তাও আবার বিশ্ববন্দিত এক ফুটবলারের সামনে। এটা কি শুধু কয়েকজন ফুটবলারের অপমান? হয়তো না, একটা গোটা দেশের ফুটবল সংস্কৃতিকে মাড়িয়ে দিল  বাণিজ্যিক আকাঙ্খা ।

আরও পড়ুন-বুড়ো না হলে মেসির জ্বলে ওঠা অধরাই থেকে যেত

ফিফা র‌্যাঙ্কিয়ে ভারত ১৪২। লিগের ভবিষ্যৎ অনিশ্চিত। কবে শুরু হবে, কতদিন চলবে—কেউ জানে না। এই অবস্থায় মেসির মতো কিংবদন্তিকে এনে কী লাভ হল? কয়েকটা ছবি? কয়েকটা ফটোসেশন? নাকি রাজনৈতিক প্রদর্শনী? মেসির নামে মূর্তি বসানো হল। বড় নেতার ক্লাবে তাঁকে নিয়ে যাওয়া হল। কিন্তু মাঠের ভিতরে নিরাপত্তা নিশ্চিত করা গেল না? দর্শকদের সম্মান রাখা গেল না। নিজের রাজ্যের ফুটবলারদের মর্যাদা দেওয়া গেল না?

এই জায়গায় যদি প্রাক্তন ক্রিকেটাররা থাকতেন, তাহলে কি এমন ধাক্কা খেতেন? তাহলে কি এমন নির্লজ্জ অব্যবস্থা চলত? ফুটবলার বলেই কি তাঁরা সফট টার্গেট? খেলার মাঠ শুধু খেলা শেখায় না, সহবতও শেখায়। কিন্তু শনিবারের যুবভারতী দেখাল, চরিত্র বদলাচ্ছে মাঠের। অসম্মান, অব্যবস্থা, ক্ষমতার দাপট সব একসঙ্গে মিশে গেল।

ঘটনার পর রাজনৈতিক তরজাও শুরু হয়েছে। বিরোধী নেতা শুভেন্দু অধিকারী টিকিটের সম্পূর্ণ টাকা ফেরত, আয়োজক ও দায়িত্বপ্রাপ্ত মন্ত্রীদের গ্রেফতারের দাবি তুলেছেন।  তৃণমূল কংগ্রেসের তরফে দায় এড়িয়ে মুখ খুলেছেন দেবাংশু ভট্টাচার্য। পুলিশ জানিয়েছে, পরিস্থিতি খতিয়ে দেখা হচ্ছে । ক্ষতিপূরণের বিষয়টিও বিবেচনাধীন। গ্রেফতার করা হয়েছে শতদ্রু দত্তকেও। কিন্তু ক্ষতিটা কি শুধু টাকার? আবার যুবভারতীর সংস্কার হবে, আবার নতুন ফলক লাগবে, আবার উদ্বোধন হবে ভোটের আগে নবরূপে সজ্জিত বলে, ভাঙা চেয়ার বদলানো হবে, কিন্তু ভাঙা বিশ্বাস? ভাঙা সম্মান? মেসি এসেছিলেন আনন্দ দিতে। কিন্তু রেখে গেলেন লজ্জা। গোটা বিশ্বের সামনে আবার একবার বেরিয়ে এলো ভারতীয় ফুটবলের কঙ্কাল। 

More Articles