ভোট প্রচারের সময় আহত ইনকিলাব মঞ্চের মুখপাত্র! কী ঘটেছিল ওসমান হাদির সঙ্গে?
শনিবার (১২ ডিসেম্বর) ঢাকার বিজয়নগর এলাকায় এক সাধারণ রাজনৈতিক প্রচারের দুপুর হঠাৎই বেদনাদায়ক ও আতঙ্কের মুহূর্তে বদলে যায়। বাংলাদেশের ইনকিলাব মঞ্চের মুখপাত্র এবং ঢাকা-৮ আসনের স্বতন্ত্র প্রার্থী শরিফ ওসমান হাদি গুলিবিদ্ধ হন। ঘটনাটি ঘটে যখন তিনি তাঁর পথচলতি মানুষের কাছে তাঁর রাজনৈতিক ভাবনা পৌঁছে দিচ্ছিলেন।
হামলাকারীরা মোটরসাইকেলে চেপে আসে এবং দ্রুত পার্ক করা বাইকের কাছ থেকে বের হয়ে তাঁর দিকে গুলি ছোড়ে। তাঁর মাথায় একটি গুলি লাগে, আর সঙ্গে সঙ্গেই তিনি মাটিতে পড়ে যান। তাঁর সহকর্মীরা উদ্বিগ্ন হয়ে ওঠেন। আশপাশের মানুষজন ভয় পেয়ে সরে যান। কিছুক্ষণ পরেই গুরুতর আহত অবস্থায় তাঁকে দ্রুত নিয়ে যাওয়া হয় ঢাকা মেডিকেল কলেজ হাসপাতালের জরুরি বিভাগে।
ইনকিলাব মঞ্চের একজন সদস্য মোহাম্মদ ওসামা জানান, গুলির ঘটনায় যারা সংশ্লিষ্ট ছিলেন তারা নতুন কেউ ছিলেন না। প্রায় দু'সপ্তাহ আগে এই দুই ব্যক্তি হাদির প্রচারণা দলের সাথে যোগ দেয়। শুরুতে তারা দলের অন্যান্য সদস্যদের সাথে মেলামেশা আর কাজে অংশ নিত। কিন্তু কয়েকদিন তাদের দলের সাথে দেখা যায়নি। হঠাৎ কয়েকদিন আগে আবার তারা প্রচারণার কাজ চালাতে শুরু করে। ওসামা বলেন, প্রথমদিকে কারও মনে বিশেষ সন্দেহ তৈরি হয়নি। কিন্তু আজকের ঘটনার পর সন্দেহ আরও জোরদার হয়েছে যে তারা কোনো নিদিষ্ট উদ্দেশ্য নিয়ে টিমে যুক্ত হয়েছিল।
আরও পড়ুন
২৬ বছর পর বাংলাদেশে ফিরছেন তারেক রহমান! ক্ষমতার কুর্সি অপেক্ষমান?
ঘটনার পর পুলিশ এবং র্যাব দ্রুত ঘটনাস্থল ঘিরে ফেলে। আশপাশের সিসিটিভি ফুটেজ, ভিডিও রেকর্ডিং, ও প্রত্যক্ষদর্শীদের বিবৃতি সংগ্রহ করা হচ্ছে। নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক পুলিশ ও র্যাবের কর্মকর্তারা জানিয়েছেন, তাঁরা সব তথ্য খুব সতর্কতার সাথে যাচাই করে দেখছেন। ঘটনার প্রতিটি কোণ বিশ্লেষণ করা হচ্ছে যাতে দ্রুত সঠিক তিনটি প্রমাণ হাতে আসে এবং হামলাকারীদের শনাক্ত করা যায়।
ডাক্তাররা জানান, গুরুতর আহত অবস্থায় হাসপাতালে পৌছানোর পর ওসমান হাদিকে সরাসরি অপারেশন থিয়েটারে নেওয়া হয়। তাঁর মাথায় ও শরীরের অন্যান্য জায়গায় ক্ষত সৃষ্টি হওয়ায় অস্ত্রোপচার শুরু করা হয়। চিকিৎসকরা সর্বোচ্চ প্রচেষ্টা চালাচ্ছেন তাঁকে সুস্থ করার জন্য। অপারেশনের প্রথম ধাপ শেষ হওয়ার পর তাঁকে আইসিইউতে (Intensive Care Unit) নেওয়ার প্রস্তুতি নেওয়া হয়। সন্ধ্যার দিকে হাসপাতালের ডাক্তাররা ও স্বাস্থ্যকর্মীরা তাঁকে আরও উন্নত চিকিৎসার জন্য এভারকেয়ার হাসপাতালে স্থানান্তরের প্রস্তুতি শুরু করেন।
ওসমান হাদি শুধু একজন নির্বাচনের প্রার্থী নন। তিনি 'ইনকিলাব মঞ্চ' নামক একটি রাজনৈতিক-সাংস্কৃতিক প্ল্যাটফর্মের মুখপাত্র। এই মঞ্চ ২০২৪ সালের জুলাই মাসে গঠিত হয়েছিল বাংলাদেশ গণঅভ্যুত্থানকে কেন্দ্র করে। তাঁরা তাঁদের প্ল্যাটফর্মকে অভ্যুত্থানে অনুপ্রাণিত সাংস্কৃতিক শক্তি হিসেবে পরিচিত করেছে এবং তাঁদের লক্ষ্য এখানে পরিষ্কার, বাংলাদেশের স্বাধীনতা, সার্বভৌমত্ব ও ন্যায়ভিত্তিক রাষ্ট্রবিন্যাস গঠন। সেই কারণে তাঁরা বিভিন্ন রাজনৈতিক ইস্যুতে সরব থাকে এবং সমাজের প্রতিদিনের ঘটনাকে বৃহত্তর আলোচনার কেন্দ্রবিন্দুতে আনে। হাদি মঞ্চের অন্যতম মুখ্য নেতা এবং ঢাকাতে প্রচারণায় সক্রিয় অংশ নিতেন।
হাদির জনসংযোগ টিমের প্রধান আব্দুল্লাহ আল জাবের সাংবাদিকদের জানান, ঘটনাটি ঠিক কখন ঘটেছে এবং কীভাবে ঘটেছে, তা শনাক্ত করা কঠিন হয়ে পড়েছে কারণ সঙ্গে থাকা দুই সহকর্মী মানসিকভাবে বিভ্রান্ত হয়ে গিয়েছিলেন। তাঁরা এখনও পুরো ঘটনার বর্ণনা দিতে পারছেন না। জাবের আরও বলেন, দীর্ঘদিন ধরেই হাদি সামাজিক ও রাজনৈতিক প্রেক্ষাপটে বিভিন্ন মন্তব্য করে আসছিলেন। তিনি সর্বদা বাংলাদেশের স্বাধীনতা ও সার্বভৌমত্ব রক্ষার পক্ষে কথা বলতেন। এ অবস্থায় অনেকে তাঁকে হুমকি দিতে পারে বলে তিনি ভাবছিলেন। আবার কিছু মানুষ মনে করেন যে নির্বাচনের মাঠে তাঁর উপস্থিতি কিছু রাজনৈতিক দলের জন্য অস্বস্তিকর। এই পরিস্থিতিতে হামলার পেছনে কোন কারণ কাজ করেছে, তা তদন্তে সামনে আসবে।
ভিডিও ফুটেজ যাচাই করে হামলাকারীর পরিচয় নিশ্চিত করা সম্ভব হবে বলে আশা করেছেন জাবের। ভিডিও রেকর্ডিং ও আশপাশের নজরদারী ক্যামেরা সংগ্রহের মাধ্যমে ইতোমধ্যেই কিছু গুরুত্বপূর্ণ সংযোগ পাওয়া গিয়েছে। যদিও সবকিছু এখনও নির্ধারিত হয়নি, তবুও তদন্তকারীরা দৃঢ়ভাবে কাজ চালিয়ে যাচ্ছেন।
ঘটনার খবর শুনে রাজনৈতিক অঙ্গন থেকে একের পর এক প্রতিক্রিয়া আসে। বিএনপি মহাসচিব মির্জা ফখরুল ইসলাম আলমগীর সোশ্যাল মিডিয়ায় লেখেন,
গণতন্ত্রে রাজনৈতিক সহিংসতার কোনো জায়গা নেই। কোনো সময়ই না। আমাদের মতাদর্শ যাই হোক, যে কেউ ভয়ভীতি বা শক্তির আশ্রয় নিলে তাকে একসঙ্গে প্রত্যাখ্যান করতে হবে।
তিনি আরও বলেন,
যখন পুরো জাতি নির্বাচনের জন্য প্রস্তুতি নিচ্ছে, তখন খোদ ঢাকা শহরের প্রানকেন্দ্রে ঘটে যাওয়া এই ঘটনার নিন্দা জানানোর কোনো ভাষা নেই।
তিনি ওসমান হাদির দ্রুত সুস্থতা কামনা করেন এবং অন্তর্বর্তী সরকার যেন শক্ত হাতে এমন সহিংসতার বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নেয়, সে আশা প্রকাশ করেন।
জামায়াতে ইসলামী দলের আমির শফিকুর রহমানও একভাবে একই সুরে প্রতিক্রিয়া জানান। তিনি বলেন, রাজনৈতিক মতভিন্নতা কখনও গুলির মতো সহিংসতায় শেষ হয়ে যেতে পারে না। তিনি দ্রুত, স্বচ্ছ ও নিরপেক্ষ তদন্তের দাবি জানান এবং ওসমান হাদির জন্য দোয়া চান। এছাড়াও জাতীয় নাগরিক পার্টি (এনসিপি) এর নেতা হাসনাত আব্দুল্লাহ নিজের সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে লেখেন,
আল্লাহ আমার ভাইকে বাঁচাইয়া রাখুক।
এনসিপির অন্য শীর্ষ নেতৃত্বও এই ঘটনার তীব্র নিন্দা প্রকাশ করেন।
সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে অনেকেই মন্তব্য করেছেন, এই হামলার পেছনে রাজনৈতিক উদ্দেশ্য থাকতে পারে। কেউ অনেকেই বলেছেন, রাজনৈতিক প্রতিদ্বন্দ্বিতা থাকা স্বত্ত্বেও সহিংসতা কখনোই কাম্য নয়। কিছু মন্তব্যে বলা হচ্ছে, যারা স্বাধীনতা ও সার্বভৌমত্বের বিরুদ্ধাচরণ করে, বা নির্বাচনের মাঠে যারা হাদিকে হুমকি মনে করে, তাঁদের মধ্যে থেকেই এই ঘটনা ঘটতে পারে। আরেকটি অংশ মন্তব্যে উল্লেখ করেছেন, ওসমান হাদি আগে থেকেই বিভিন্ন হুমকি পেয়েছেন।
আরও পড়ুন
আসিফ, মাহফুজদের পদত্যাগ: বিএনপির দিকে ঝুঁকছেন তরুণ নেতারা?
ঘটনার পর ঢাকা মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে পরিস্থিতি খুব শান্ত নয়। হাসপাতালের সামনের সড়কে নিরাপত্তা বাহিনী মোতায়েন করেছে বিপুলসংখ্যক সেনাসদস্য, বিজিবি ও পুলিশ সদস্য। এর ফলে সাধারণ মানুষ এলাকা থেকে দূরে সরে গিয়েছে। কোথাও কোথাও উত্তেজনা দেখা গিয়েছে, কিন্তু কঠোর নিরাপত্তার কারণে বড় কোনো সংঘর্ষ বা বিশৃঙ্খলা হয়নি।
বিএনপির স্থায়ী কমিটির সদস্য ও ঢাকা-৮ আসনের প্রার্থী মির্জা আব্বাসও আহত হাদিকে দেখতে হাসপাতালে যান। সেখানে কিছু সময় উত্তেজনা সৃষ্টি হলেও পুলিশের উপস্থিতিতে পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণে থাকে। পরে তিনি হাসপাতাল থেকে চলে যান। এভাবে ওই দিনের ঘটনাটিকে কেন্দ্র করে রাজনৈতিক ও সামাজিক পর্যায়ে আলোচনা তৈরি হয়েছে। অনেকেই বলছেন, নির্বাচনের আগে এমন একটি ঘটনার ফলে সাধারণ মানুষের মনে শঙ্কা দেখা দিয়েছে। আবার অনেকে মনে করেন, বাংলাদেশের রাজনৈতিক পরিবেশকে শান্ত রাখা আবশ্যক।
অন্যদিকে, তদন্তকারীরা প্রতিটি প্রমাণ ও তথ্য দ্রুত সংগ্রহ করে যাচ্ছেন। ভিডিও ফুটেজ, প্রত্যক্ষদর্শীদের বিবৃতি, স্থানীয় তথ্য সবকিছু সংগ্রহ করে হামলাকারীদের ঠিকভাবে শনাক্ত করতে প্রস্তুত হচ্ছেন আইনশৃঙ্খলা বাহিনী। তদন্তের ভিত্তিতে যারা এই হামলা করেছে তাদের আইনের আওতায় আনা হবে বলে জানিয়েছে ইতোমধ্যেই সংশ্লিষ্ট কর্তৃপক্ষ।
হামলার পেছনের রাজনৈতিক উদ্দেশ্য, হামলাকারীদের পরিচয়, এবং তারা কি পরিকল্পিতভাবে ওসমান হাদির উপর গুলি চালিয়েছে— এসব প্রশ্নের উত্তর সময়ের সঙ্গে পরীক্ষা-নিরীক্ষা শেষে মিলবে।

Whatsapp
