২৭ বছর পর রহস্য উদঘাটন! পুরুলিয়ায় অস্ত্রবর্ষণ ঘটনায় আসলে দায় ছিল কার?

Purulia arms drop case: ২০১১ সালে এক ইন্টারভিউতে কিম ডেভি জানিয়েছেন, এই আর্মস ড্রপের প্ল্যানে পুরো মদত ছিল তদানীন্তন ভারত সরকারের।

১৭ ডিসেম্বর, ১৯৯৫। করাচি থেকে একটি রাশিয়ান বিমান অ্যান্টোনোভ-২৬ ভারতের আকাশসীমায় ঢুকে পড়ে। সেটি প্রথমে বারাণসীতে ল্যান্ড করে এবং সেখান থেকে রিফুয়েল করে পশ্চিমবঙ্গের উপর দিয়ে থাইল্যান্ডের উদ্দেশ্যে বেরিয়ে যায়। অদ্ভুতভাবে, এই প্লেনটির গতিবিধি ভারতের র‍্যাডারে ধরা পড়েনি। পরের দিন সকালবেলা, অর্থাৎ ১৮ ডিসেম্বর পশ্চিমবঙ্গের পুরুলিয়ার এক ধান ক্ষেতে একদল চাষি চাষ করতে গেছেন। ক্ষেতে ঢুকতেই তারা দেখলেন ক্ষেতের মধ্যে বেশ কয়েকটি বাক্স পড়ে রয়েছে। সেগুলি খুলতেই চক্ষু চড়কগাছ! বাক্সে রয়েছে একগাদা একে-৪৭, একে-৫৬, ছয়টি রকেট লঞ্চার, বেশ কয়েকটি লাইট ওয়েট বন্দুক, হ্যান্ডগান, নাইট ভিশন এবং ১৫ হাজার রাউন্ড গুলি! মোটামুটি অস্ত্রের যা সম্ভার তাতে একটা ছোটখাটো যুদ্ধ লড়ে নেওয়া যাবে। এত বন্দুক দেখতেই শোরগোল পড়ে যায় গ্রামে। চাষিরা নিজেদের ইচ্ছেমতো বন্দুক তুলে বাড়ি নিয়ে চলে যান। রাজ্য সরকারের কানে খবরটি যেতেই সঙ্গে সঙ্গে একটি স্পেশাল টিম পুরুলিয়া পাঠানো হয়। জানানো হয় কেন্দ্রীয় সরকারকেও। গ্রামবাসীদের বাড়ি ঢুকে ঢুকে বন্দুক খুঁজে আনতে হয় পুলিশকে। কিন্তু প্রশ্ন হচ্ছে, এই এত বিপুল অস্ত্র কে, কেন এবং কার জন্য ফেলে গেল?

এর তিনদিন পর, অর্থাৎ ২১ ডিসেম্বর ওই একই প্লেন আবার ভারতের আকাশসীমায় ঢোকে। তবে এবার সেটিকে মুম্বইয়ের বিমানবন্দরে আটকে দেওয়া হয়। প্লেন থেকে গ্রেফতার করা হয় ৬ জনকে। এদের মধ্যে পাঁচজন ছিলেন লাটভিয়ার বাসিন্দা এবং একজন ছিলেন ব্রিটিশ। এই ব্রিটিশ ভদ্রলোকের নাম পিটার ব্লিচ। পূর্ব ব্রিটিশ ইন্টেলিজেন্স সংস্থা অর্থাৎ এমআই৫-এর (MI5) এজেন্ট এবং অধুনা অস্ত্র ব্যবসায়ী ছিলেন তিনি। পুলিশ তদন্ত করে জানতে পারে, প্লেনটির মালিক ব্লিচ নিজেই এবং যে অস্ত্রগুলি পুরুলিয়ায় ফেলা হয়েছিল সেগুলিও ব্লিচের। তখন এদের যাবজ্জীবন কারাদণ্ড হলেও ২০০৪ সালে সকলকেই মুক্তি দেওয়া হয়। তবে তখনও এই ঘটনার মুখ্য চরিত্র তদন্তকারীদের সামনে আসেনি। সেই প্লেনে ৭ জন ছিলেন, তার মধ্যে ৬ জনকে গ্রেফতার করা হয় এবং সপ্তম জন পালিয়ে যান। এই ব্যক্তিটিই হলেন কিম ডেভি। ডেনমার্কের বাসিন্দা ডেভি, মুম্বই এয়ারপোর্ট থেকে পালিয়ে সোজা নিজের দেশ ডেনমার্কে ফিরে যান। তথ্য সামনে আসতেই ভারত সরকারের তরফে প্রভূত চেষ্টা করা হয় ডেভিকে ভারতের প্রত্যর্পণ করানোর। কিন্তু প্রত্যেকটি চেষ্টাই বিফল হয়। পরবর্তীকাল কিম ডেভি এমন বেশ কয়েকটি তথ্য ফাঁস করেন যা এই ঘটনাটিকে সম্পূর্ণ অন্যরূপ দেয়।

আরও পড়ুন- গুয়াহাটির জঙ্গলে ভূতের নাচ! সরাইঘাটের যুদ্ধে যেভাবে মুঘলদের হারিয়েছিল অহমরা 

পিটার ব্লিচ

ডেভি দাবি করেন, ভারতের তদানীন্তন কেন্দ্রীয় সরকারের নির্দেশেই তিনি এরকম করেছেন। পশ্চিমবঙ্গে জ্যোতি বসুর নেতৃত্বাধীন কমিউনিস্ট সরকার ফেলার পরিকল্পনার অংশ ছিল এটি। কিম ডেভি এই দাবি করতেই তা সঙ্গে সঙ্গে নাকচ করে দেয় কেন্দ্রীয় সরকার। সরকারের তরফে দাবি করা হয়, নিজে বাঁচতে কেন্দ্রীয় সরকারের নামে এমন উদ্ভট দাবি করছেন ডেভি। তখনকার কেন্দ্রীয় সরকার নাকচ করলেও বেশ কয়েকটি প্রশ্নের উত্তর আজও অধরা। প্রথমত, ডেভি এবং ব্লিচ পশ্চিমবঙ্গে কাকে অস্ত্র গুলি পাঠাচ্ছিলেন? দ্বিতীয়ত, যেদিন পুরুলিয়ায় অস্ত্রগুলি ফেলা হল সেদিন প্লেনটি র‍্যাডারে ধরা পড়লো না কেন? তৃতীয়ত, মুম্বই বিমানবন্দর থেকে পালালেন কী করে ডেভি? চতুর্থত, এই ঘটনাটি সম্বন্ধে কি সত্যিই জানতো না র এবং এমআই৫?

কিম ডেভি

এই প্রসঙ্গে বলতে গিয়ে বেশ কয়েকটি তাৎপর্যপূর্ণ তথ্য তুলে ধরেন পিটার ব্লিচ। ১৯৯৫-এর গোড়ার দিকে পিটার ব্লিচের থেকে একটি অস্ত্রের কনসাইনমেন্ট কিনতে চান কিম ডেভি। এর আগে অন্যান্য অনেক দেশের সামরিক বাহিনীকে অস্ত্র বিক্রি করেছিলেন ব্লিচ। তার কাছে এটা কিছুই নতুন নয়। কিন্তু ব্লিচ যখন জানতে পারলেন যে ডেভি একটি সন্ত্রাসবাদী সংগঠনের সঙ্গে যুক্ত, তিনি তৎক্ষণাৎ এমআই৫-কে এই সম্পূর্ণ ঘটনা সম্পর্কে জানান। পুরো ঘটনা শুনে এমআই৫-এর তরফে জানানো হল, যা হচ্ছে হতে দাও। পিটার ব্লিচ ভেবেছিলেন, এমআই৫ এই কিম ডেভি সম্পর্কে আরও তথ্য উদঘাটন করতে চায়। তাই তাকে কাজ চালিয়ে যেতে বলছে তারা। নির্দেশ মতো পিটার ব্লিচও কিম ডেভিকে সব অস্ত্রশস্ত্রের কনসাইনমেন্ট দেখাতে থাকেন। দুই পক্ষের মধ্যে ডিল হয়ে যায়। তবে ডেভি পিটারকে একটি শর্ত দেন। শর্তটি হল ডেলিভারির সময় তারা দু’জনেই একসঙ্গে যাবেন। পিটার ব্লিচ ভেবেছিলেন এমআই৫ তাকে ক্রমাগত ট্র্যাক করছে সুতরাং যেতে অসুবিধা নেই। কিন্তু যেতে গিয়েই তিনি বুঝতে পারেন কিছু একটা গণ্ডগোল আছে।

এই প্রসঙ্গে পিটার ব্লিচ বলেন, “আমাকে যখন কিম ওর সঙ্গে ডেলিভারির জন্য যেতে বলল আমি রাজি হয়ে গেলাম। ভেবেছিলাম যেহেতু এমআই৫ আমায় ট্র্যাক করছে, তাই তারা ডেলিভারিটা সম্পূর্ণ হতে দেবে না। ভারতে ঢুকলেই সেখানকার সেনা আমাদের গ্রেপ্তার করবে এবং আমি আমার পূর্ব পরিচয় দিয়ে ছাড়া পেয়ে যাব। কিন্তু যখন দেখলাম প্লেন বেনারস ঢুকে গেল কিন্তু কেউ কিছু করল না, আমি ভয় পেয়ে গেছিলাম। ভাবছিলাম এই বোধহয় একটা মিসাইল ধেয়ে এল। কিন্তু তাও যখন হল না, আমি বুঝতে পারলাম কিছু একটা গণ্ডগোল আছে। আমরা কোনও সমস্যা ছাড়াই পশ্চিমবঙ্গে এয়ার ড্রপ করে দিয়ে থাইল্যান্ড চলে যাই।”

আরও পড়ুন- হিন্দির বিরুদ্ধে, বাংলার পক্ষে রক্তঝরা আন্দোলন! যেভাবে জন্মেছিল পুরুলিয়া জেলা

আসল গণ্ডগোলটা হয় এই এয়ার ড্রপেই। রাতের অন্ধকারে পাইলট ভুল জায়গায় ড্রপ করে দেন কন্সাইনমেন্টটি। আর তাতেই এত শোরগোল পড়ে যায় দেশজুড়ে। তবে এই অস্ত্রগুলি ছিল কাদের জন্য? পিটার ব্লিচ জানান, তাকে কিম ডেভি বলেছিল এই অস্ত্রগুলি ‘আনন্দমার্গ’ নামে এক সংগঠনের জন্য। ভারত-সহ বিশ্বের বিভিন্ন প্রান্তে তাদের শাখা ছড়িয়ে রয়েছে। পশ্চিমবঙ্গে সিপিএম এবং আনন্দমার্গীদের মধ্যে সংঘাতের খবর নতুন কিছু নয়। দুই পক্ষের মধ্যেই বিভিন্ন সময় সংঘর্ষ হয়েছে, যার অন্যতম উদাহরণ বিজন সেতু ম্যাসাকার। এছাড়াও বেশ কিছু হিংসাত্মক ঘটনার সঙ্গে নাম জড়িয়ে ছিল আনন্দমার্গের। ব্লিচকে, কিম ডেভি জানিয়েছিলেন তিনি একজন আনন্দমার্গের সদস্য। বাংলার কমিউনিস্ট পার্টির থেকে যাতে আনন্দমার্গীরা নিজেদের রক্ষা করতে পারে তাই অস্ত্রের ব্যবস্থা। কিন্তু অস্ত্রগুলি ভুল জায়গায় পড়ায় সমস্যা হয়ে যায়। ২০০৪ সালে ব্লিচ-সহ বাকিরা ছাড়া পেয়ে গেলেও কিম ডেভি তখনও পলাতক ছিলেন। কেন্দ্রীয় সরকার বারবার চেষ্টা করলেও ড্যানিশ কোর্ট প্রত্যর্পণে বাধা হয়ে দাঁড়ায়। ২০১১ সালে এক ইন্টারভিউতে কিম ডেভি জানিয়েছেন, এই আর্মস ড্রপের প্ল্যানে পুরো মদত ছিল তদানীন্তন ভারত সরকারের। তারা চেয়েছিল, আনন্দমার্গীদের হাতে হাতিয়ার তুলে দিতে যাতে তারা বাংলায় বিদ্রোহ শুরু করতে পারে এবং অরাজকতার দোহাই দিয়ে বাংলার কমিউনিস্ট সরকার ফেলে দেওয়া যায়।

কিম ডেভির এই দাবি অবশ্য নাকচ করে দেয় সিবিআই। আনন্দমার্গের তরফেও এই দাবি ভিত্তিহীন বলে জানিয়ে দেওয়া হয়। তবে কীভাবে একটি প্লেন র‍্যাডারে না ধরা পড়েই ভারতের আকাশ সীমায় ঢুকে বেরিয়ে গেল, সেই প্রশ্নের যথাযথ উত্তর আজও পাওয়া যায়নি। পিটার ব্লিচ অবশ্য জানিয়েছিলেন, যে পরিমাণ হাতিয়ার উদ্ধার করা হয়েছে, তারা তার থেকে অনেক বেশি পরিমাণ হাতিয়ার এয়ার ড্রপ করেছিলেন। তাহলে বাকি অস্ত্র গেল কোথায়? এর যথাযথ উত্তর দিতে পারেনি সিবিআই। অপরপক্ষে এমআই৫ জানায়, এই বন্দুকের কনসাইনমেন্ট এবং এয়ার ড্রপ সম্বন্ধে সব তথ্য ভারত সরকারকে আগেই দেওয়া ছিল। অবশ্য সেই দাবিও নাকচ করে দেয় ভারত সরকার। যখন মনে করা হচ্ছিল, পুরো বিষয়টা কেন্দ্রীয় সরকার এবং পশ্চিমবঙ্গের কমিউনিস্ট সরকারের মধ্যে, তখনই সামনে আসে আরও কয়েকটি তথ্য।

২০১১ সালে বেশ কিছু সার্টিফিকেট পেশ করে সিবিআই। ইন্টারন্যাশনাল আর্মস ডিলের এই সার্টিফিকেটগুলিতে লেখা ছিল, ২৫ নভেম্বর ১৯৯৫ তারিখে বুলগেরিয়া থেকে অস্ত্রগুলি বাংলাদেশের সেনার জন্য কেনা হয়েছে। ওই সার্টিফিকেটের নিচে সই ছিল বাংলাদেশ সেনাবাহিনীর তৎকালীন চিফ অব স্টাফ মেজর জেনারেল মহম্মদ আলি ভূঁইয়ার। সেই সময় বাংলাদেশ সরকারের তরফে দাবি করা হয় মেজর জেনারেল ভূঁইয়ার সইটি নকল, বাংলাদেশের এর সঙ্গে কোনও সম্পর্ক নেই। আবার অনেক বিশেষজ্ঞরা দাবি করেন এই হাতিয়ারগুলি মায়ানমারের বিদ্রোহী অথবা শ্রীলঙ্কার এলটিটিই-র জন্য ছিল। তবে ঘটনা আসলে কী, তা এখনও সামনে আসেনি।

More Articles