পাচ্ছেন মরণোত্তর স্বাধীনতা পদক! কেন আবরার ফাহাদকে কখনও ভুলবে না বাংলাদেশ?
Abrar Fahad : আওয়ামী লীগের শাসন আমলে যে ঘটনাগুলি তীব্র সমালোচনার মুখে পড়েছিল আবরার ফাহাদ হত্যাকাণ্ড তার মধ্যে অন্যতম বলে মনে করেন রাজনৈতিক বিশ্লেষকেরা। এই ঘটনার পর ক্ষমতাসীনদের প্রতি তীব্র ক্ষোভ উগরে দেয় বাংলাদেশবাসী।
আবরার ফাহাদকে স্বাধীনতা পদক ২০২৫-এ ভূষিত করছে বাংলাদেশ। এটি বাংলাদেশের সরকারের দেওয়া সর্বোচ্চ বেসামরিক সম্মাননা। ১৯৭১ সালের বাংলাদেশের স্বাধীনতা যুদ্ধের শহিদদের স্মরণে ১৯৭৭ সাল থেকে প্রতি বছর ২৬ মার্চ স্বাধীনতা দিবসে এই পুরস্কার দেওয়া হয় থাকে। ৩ মার্চ বাংলাদেশের অন্তর্বর্তী সরকারের যুব ও ক্রীড়া উপদেষ্টা আসিফ মাহমুদ সজীব ভূঁইয়া সামাজিক মাধ্যমে এ কথা জানিয়েছেন। পোস্টে তিনি লেখেন, 'অন্যায়ের বিরুদ্ধে দাঁড়ানোর সাহসিকতার প্রতীক, মুক্ত চিন্তার এক প্রতিচ্ছবি- আবরার ফাহাদ। তার আদর্শ...আমাদের আলোকিত করে, ন্যায়বিচারের পথে এগিয়ে নিয়ে যেতে অনুপ্রেরণা দেয়। জাতি তোমাকে ভুলবে না, আবরার!' কে এই আবরার ফাহাদ?
আবরার বাংলাদেশ প্রকৌশল বিশ্ববিদ্যালয় বা বুয়েটের ইলেকট্রিক্যাল অ্যান্ড ইলেকট্রনিক্স ইঞ্জিনিয়ারিং বিভাগের শিক্ষার্থী ছিলেন। ২০১৯ সালের ৬ অক্টোবর রাতে বুয়েটের শেরে বাংলা হলে দ্বিতীয় বর্ষের এই পড়ুয়ার মৃত্যু হয়। অভিযোগ, ছাত্রলীগের নেতাকর্মীরা তাঁকে পিটিয়ে হত্যা করে। সম্প্রতি বাংলাদেশে আওয়ামী লীগ সরকার বিরোধী যে আন্দোলন গড়ে উঠেছিল সেখানেও আন্দোলনকারীদের মধ্যে তাঁর নাম বারবার উঠে এসেছিল। আওয়ামী লীগের শাসন আমলে যে ঘটনাগুলি তীব্র সমালোচনার মুখে পড়েছিল আবরার ফাহাদ হত্যাকাণ্ড তার মধ্যে অন্যতম বলে মনে করেন রাজনৈতিক বিশ্লেষকেরা। এই ঘটনার পর ক্ষমতাসীনদের প্রতি তীব্র ক্ষোভ উগরে দেয় বাংলাদেশবাসী।
আবরার ফাহাদ হত্যাকাণ্ড
আবরার ৫ অক্টোবর কুষ্টিয়ার বাড়ি থেকে বুয়েটে এসে শেরে বাংলা হলে নিজের ১০১১ কক্ষে এসেছিলেন। অভিযোগ, ফেসবুকে তাঁর দেওয়া ভারত বিরোধী একটি পোস্টের জের ধরে তাঁকে রাত ৮ টার দিকে নিয়ে যাওয়া হয়। অভিযোগ ওঠে, বুয়েট ছাত্রলীগের নেতাকর্মীরা তাঁকে ডেকে নিয়ে গিয়েছিল। পরে রাত ৩টে নাগাদ জানা গিয়েছিল আবরারের মৃত্যু হয়েছে। তাঁকে হত্যা করে একতলা ও দোতলার সিঁড়ির মাঝামাঝি ফেলে রাখা হয়েছিল। জানা গিয়েছিল, 'শিবির আখ্যা' দিয়ে দুই দফায় দুটি কক্ষে নির্মম নির্যাতনে নিহত হন আবরার। পরে বুয়েট মেডিক্যালের ডাক্তার এসে তাকে মৃত ঘোষণা করেন। সে সময় পুলিশ তরফেই জানানো হয়েছিল, আবরারকে পিটিয়ে হত্যা করা হয়েছে। এই হত্যাকাণ্ডের পর তীব্র ক্ষোভের জেরে অভিযুক্ত ছাত্রলীগের নেতাকর্মীদের আটক করা হয়েছিল।
আবরার 'ভারতীয় আগ্রাসন বিরোধী' আন্দোলনের প্রতীক
এই হত্যাকাণ্ডের পর আবরারকে 'ভারতীয় আগ্রাসন বিরোধী' আন্দোলনের প্রতীক বলে উল্লেখ করেছিল বাংলাদেশের বিভিন্ন রাজনৈতিক দল ও সংগঠন। হত্যাকাণ্ডের দুই দিন আগে ৫ অক্টোবর ফেসবুকে বাংলাদেশ ভারত সম্পর্ক নিয়ে একটি ফেসবুক পোস্ট করেছিলেন আবরার। হত্যাকাণ্ডের পর বুয়েটের পড়ুয়ার অনেকেই দাবি করেছিলেন যে মূলত এই পোস্টের জন্যই তাঁকে হত্যা করা হয়। আবরার হত্যাকাণ্ডের তদন্তের শেষে তখনকার কাউন্টার টেররিজম ইউনিটের প্রধান মনিরুল ইসলাম সংবাদ সম্মেলনে বলেছিলেন, আবরারকে শিবির হিসেবে সন্দেহ করাটাই হত্যাকাণ্ডের পেছনে একমাত্র কারণ নয়। সমীহ করে সালাম না দেওয়া, র্যাগিং-এর নামে আতঙ্ক তৈরি করাও অন্যতম কারণ ছিল।
পোস্টে যা ছিল
আবরার ফেসবুক পোস্টে লিখেছিলেন, '১. ৪৭-এ দেশভাগের পর দেশের পশ্চিমাংশে কোনও সমুদ্রবন্দর ছিল না। তৎকালীন সরকার ৬ মাসের জন্য কলকাতা বন্দর ব্যবহারের জন্য ভারতের কাছে অনুরোধ করল। কিন্তু দাদারা নিজেদের রাস্তা নিজেদের মাপার পরামর্শ দিচ্ছিলো। বাধ্য হয়ে দুর্ভিক্ষ দমনে উদ্বোধনের আগেই মোংলা বন্দর খুলে দেওয়া হয়েছিল। ভাগ্যের নির্মম পরিহাসে আজ ইন্ডিয়াকে সে মোংলা বন্দর ব্যবহারের জন্য হাত পাততে হচ্ছে। ২. কাবেরী নদীর পানি ছাড়াছাড়ি নিয়ে কানারি আর তামিলদের কামড়াকামড়ি কয়েকবছর আগে শিরোনাম হয়েছিল। যে দেশের এক রাজ্যই অন্যকে পানি দিতে চায় না সেখানে আমরা বিনিময় ছাড়া দিনে দেড় লাখ কেউবিক লিটার পানি দিব। ৩. কয়েক বছর আগে নিজেদের সম্পদ রক্ষার দোহাই দিয়ে উত্তরভারত কয়লা-পাথর রপ্তানি বন্ধ করেছে অথচ আমরা তাদের গ্যাস দিব। যেখানে গ্যাসের অভাবে নিজেদের কারখানা বন্ধ করা লাগে সেখানে নিজেদের সম্পদ দিয়ে বন্ধুর বাতি জ্বালাবো।'
হত্যা মামলা দায়ের
আবরারের বাবা রাজধানীর চকবাজার থানায় হত্যা মামলা দায়ের করেছিলেন। এই মামলায় ছাত্রলীগের ১৯ জনের বিরুদ্ধে অভিযোগ আনা হয়েছিল, তবে তদন্তের পর সেই সংখ্যা দাঁড়ায় ২৫। এই মামলার চার্জশিটে বলা হয়েছিল আবরার হত্যাকাণ্ডের সাথে ১১ জন সরাসরি সম্পৃক্ত এবং বাকিরা পরোক্ষভাবে জড়িত ছিল। পুলিশ তরফে জানানো হয়েছিল, আটক করা ৮ জন আদালতে স্বীকারোক্তিমূলক জবানবন্দী দিয়েছে। ২০২১ সালের ৮ ডিসেম্বর এই মামলার রায়ে বুয়েটের ২০ শিক্ষার্থীকে মৃত্যুদণ্ড এবং ৫ শিক্ষার্থীকে যাবজ্জীবন কারাদণ্ড দেয় আদালত।
ছাত্র রাজনীতি নিষিদ্ধ
আবরার হত্যাকাণ্ডে বুয়েটের ছাত্রলীগের ১৯ জনের বিরুদ্ধে অভিযোগ ওঠার প্রেক্ষাপটে শিক্ষার্থীরা ১০ দফা দাবিতে আন্দোলন করছিলেন। তাদের দাবিগুলির মধ্যে শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে ছাত্র রাজনীতি নিষিদ্ধ করার বিষয়টিও ছিল। কিন্তু ছাত্র রাজনীতি নিষিদ্ধ করার বিষয়টি নিয়ে প্রতিবাদ জানিয়েছিল বামপন্থী ছাত্র সংগঠনগুলো সহ আরও কিছু সংগঠন। তাদের বক্তব্য ছিল- সন্ত্রাস, চাঁদাবাজি বা টেন্ডারবাজির দায় পুরোটা ছাত্র রাজনীতির ওপর চাপিয়ে দেওয়া হচ্ছে।
আন্তর্জাতিক গণমাধ্যমে আবরার হত্যাকাণ্ড
আবরার ফাহাদের নির্মম হত্যাকাণ্ডের পর এই ঘটনা নিয়ে নিয়মিত সংবাদ প্রকাশ হত। জাতীয় সংবাদ মাধ্যমের পাশাপাশি আন্তজার্তিক গণমাধ্যমেও এই হত্যাকাণ্ড সমালোচিত হয়েছিল। বিবিসি এই ঘটনা নিয়ে লাগাতার সংবাদ প্রকাশ করেছিল। ২০১৯ সালের ৯অক্টোবর তাদের একটি প্রতিবেদনে বলা হয়েছিল, ৪ ঘণ্টা ধরে আবরারকে পিটিয়ে হত্যা করা হয়েছিল। বার্তা সংস্থা রয়টার্সের প্রতিবেদনে বলা হয়েছিল, 'ভারতের সঙ্গে বাংলাদেশের ক্ষমতাসীন সরকারের জল নিয়ে চুক্তির সমালোচনা করে ফেসবুকে পোস্ট দেওয়ায় আবরারকে পিটিয়ে হত্যা করা হয়।' ওই প্রতিবেদনে ক্যাম্পাসে ছাত্র রাজনীতি নিষিদ্ধ করার দাবির বিষয়টিও উল্লেখ ছিল। গার্ডিয়ানে আবরারের বাবার বক্তব্য ও আবরার হত্যার পর প্রতিবাদ ও ক্ষোভে উত্তাল হয়ে ওঠা পরিস্থিতি নিয়ে লেখা হয়েছিল।
বাংলাদেশের জন্য আবরারের হত্যাকাণ্ড এক কলঙ্কিত অধ্যায়। আবরারের বিচারের দাবিতে সোচ্চার হয়েছিল গোটা দেশ। উত্তাল হয়ে ওঠে বাংলাদেশ প্রকৌশল বিশ্ববিদ্যালয়। মিছিল, ব্যানার, প্ল্যাকার্ড, পোস্টার ও স্লোগানে আবরারের বিচারের দাবি ওঠে। গ্রাফিতি, কার্টুন, দেয়াল লিখন হয়ে ওঠে প্রতিবাদের ভাষা।
আবরারের এই মরণোত্তর পদকপ্রাপ্তিতে খুশি বাংলাদেশের সংখ্যাগরিষ্ঠ মানুষ। খুশি জেন ওয়াই। জনতার বক্তব্য, দেরিতে হলেও, ন্যায়বিচার পেলেন আবরার ফাহাদ।