ভারতে বাড়ছে মহিলাদের মদ্যপান, তবে কি সমাজ সাক্ষী থাকছে নতুন বদলের?

মদ্যপান নিয়ে ভারতীয় সমাজে যতই ট্যাবু থাকুক না কেন, বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থা-র সমীক্ষায় দেখা যাচ্ছে, ভারতের বাসিন্দা মদ্যপায়ীদের মধ্যে ৭.৫ শতাংশই মহিলা। আর তাঁরা বাড়িতে বসেই মদ্যপান করছেন। ধূমপান থেকে মদ্যপান- বিশেষত মেয়েদের নেশা করা নিয়ে সমাজের তির্যক দৃষ্টি প্রখর। তার পরেও ভারতের মতো দেশে, গেরস্থালির মধ্যেই মেয়েদের মদ্যপান সম্ভব হচ্ছে কী করে? সমাজতাত্ত্বিক সমীক্ষায় জানা গিয়েছে এর কারণগুলিও। যেমন, প্রকাশ্যে মদ্যপান করতে মেয়েরা নিরাপত্তাহীনতায় ভোগেন। সেই কারণে মদ্যপানের নিরাপদ জায়গা হিসেবে তাঁরা বেছে নিয়েছেন বাড়িকে। ভারতীয় সমাজে এই পরিবর্তনের কারণ, আধুনিক যুগের সঙ্গে সঙ্গে পারিবারিক মূল্যবোধের বিবর্তন।

মহিলাদের পানাসক্তির নিরিখে দেশের মধ্যে প্রথম স্থানাধিকারী রাজ্য অসম। কেন্দ্রীয় সরকারের 'হেলথ অ্যান্ড ফ্যামিলি ওয়েলফেয়ার'-এর সমীক্ষায় ধরা পড়েছে, অসমের বাসিন্দা ১৫ থেকে ৪৯ বছর বয়সি মেয়েরা ২৬.৩ শতাংশ ক্ষেত্রে নিয়মিত মদ্যপান করছেন।

তবে দেশের কয়েকটি রাজ্যে মদ বিক্রি নিষিদ্ধ। এই রাজ্যগুলোর মধ্যে রয়েছে বিহার, গুজরাত, মিজোরাম ও নাগাল্যান্ড। এছাড়া কেন্দ্রশাসিত এলাকাগুলির মধ্যে কেবলমাত্র লাক্ষাদ্বীপেই মদ বিক্রি নিষিদ্ধ। যদিও ভারতের অন্য রাজ্য এবং কেন্দ্রশাসিত এলাকাগুলোতে মদ বিক্রির ওপর সরকারি কোনও নিষেধাজ্ঞা নেই।

আরও পড়ুন: কোকে কোকেন ফেরাব, বলছেন এলন মাস্ক || সত্যিই কি ঠান্ডা পানীয়ে মিশত ভয়ানক মাদক?

সম্প্রতি বিহারের মুখ্যমন্ত্রী নীতিশ কুমার রাজ্য বিধানসভায় 'বিহার প্রোহিবিশন অ্যান্ড এক্সাইজ অ্যাক্ট'-এ প্রস্তাবিত সংশোধনী সম্পর্কে বিতর্কের জবাবি ভাষণে বলেছেন, যাঁরা মদ্যপান করেন, তাঁদের জীবনযাপনের ধারা মহাত্মা গান্ধীর আদর্শের পরিপন্থী। সেই কারণে মদ্যপায়ীরা প্রকৃত 'হিন্দুস্তানি' নন। মদ্যপায়ীরা আসলে 'মহাপাপী'। কিন্তু বাস্তবতা হল, দেশের অন্যতম দরিদ্র রাজ্য বিহারের বাসিন্দারা লুকিয়ে-চুরিয়ে মদ্যপান কিন্তু করছেনই। এমনকি বিষমদ পান করতেও পিছপা হচ্ছেন না। যার পরিণতিতে মাঝেমধ্যেই বেশ কিছু মানুষের প্রাণহানির সংবাদ খবরের কাগজ, টিভি চ্যানেলে ফলাও প্রচারিত হচ্ছে। সম্প্রতি একথাও মুখ্যমন্ত্রী নীতিশ কুমার জানিয়েছেন, মদ্যপানের ফলে অসুস্থ হয়ে পড়ে মৃত্যু হলে তাঁদের পরিবারকে রাজ্য সরকার কোনও ক্ষতিপূরণ দেবে না।

ভারতের হাতে গোনা কয়েকটি রাজ্যে মদ বিক্রি নিষিদ্ধ হলেও ভারতজুড়ে রমরমিয়েই চলেছে মদের ব্যবসা। যেমন, নাগাল্যান্ড ও মিজোরামে মদ বিক্রি নিষিদ্ধ হওয়া সত্ত্বেও এই দুই রাজ্যের পুরুষদের মধ্যে যথাক্রমে ২৪ শতাংশ এবং ২৩.৮ শতাংশই নিয়মিত মদ্যপান করে থাকেন। মিজোরাম, নাগাল্যান্ডের মতো রাজ্যে মদ বিক্রি প্রতিরোধে যদিও আইন আছে। এসত্ত্বেও দেখা যাচ্ছে, সেই আইন অকেজো বেশিরভাগ ক্ষেত্রেই।

গুজরাত ১৯৬১ সালে পৃথক রাজ্যের তকমা পাওয়ার পর থেকে সেখানে মদ বিক্রি নিষিদ্ধ হয়। এর পরে মদ্যপায়ীর সংখ্যা সারা দেশের তুলনায় গুজরাতে সর্বনিম্ন। সমীক্ষায় জানা গিয়েছে, গুজরাতের বাসিন্দাদের মধ্যে মোটে ৫.৮ শতাংশ পুরুষ মদ্যপান করে থাকেন। অন্যদিকে, কেন্দ্রশাসিত এলাকা লাক্ষাদ্বীপেও মদ বিক্রি বেআইনি হওয়ার ফল পাওয়া গিয়েছে। এখানকার বাসিন্দাদের মধ্যে ০.৪ শতাংশ পানাসক্ত।

কেন্দ্রীয় সরকার ন্যাশনাল ফ্যামিলি হেলথ সার্ভে-র সাম্প্রতিক যে রিপোর্ট প্রকাশ করেছে, তাতে দাবি করা হয়েছে, গত পাঁচ বছরের তুলনায় ভারতে ১৫ বছরের বেশি বয়সের ছেলেমেয়েদের ভেতর মদ্যপানের হার খানিক কমেছে। এর আগে প্রকাশিত ন্যাশনাল ফ্যামিলি হেলথ সার্ভে-তে ধরা পড়েছিল, ভারতে ২৯.২ শতাংশের ক্ষেত্রে ১৫ বছরের বেশি বয়সি ছেলেমেয়েরা মদ্যপান করছে। সম্প্রতি প্রকাশিত রিপোর্ট অনুসারে, ১৫ বছর পেরোলেই ছেলেমেয়েদের নিয়মিতভাবে মদ্যপানের হার কিছুটা কমে ১৮.৮ শতাংশে দাঁড়িয়েছে।

ভারতের তৈরি বিদেশি মদের চাহিদা সবচেয়ে বেশি অরুণাচল প্রদেশ, কেরল, কর্নাটক, তেলেঙ্গানা, অন্ধ্রপ্রদেশ, হরিয়ানা, সিকিম, মনিপুরের মতো রাজ্যগুলোতে। সেইসঙ্গে ভারতে তৈরি বিদেশি মদের বাজারও ফি বছর ৮ থেকে ৯ শতাংশ হারে বাড়ছে।

ন্যাশনাল ফ্যামিলি হেলথ সার্ভে-র রিপোর্ট অনুসারে, তেলেঙ্গানায় সবচেয়ে বেশিসংখ্যক পুরুষ পানাসক্ত। এই রাজ্যের মোট জনসংখ্যার ৪৩ শতাংশের বেশি পুরুষ পানাসক্ত। এছাড়া সারা দেশে শহরাঞ্চলের বাসিন্দা ১৪ শতাংশ পুরুষ এবং গ্রামাঞ্চলের বাসিন্দা ১৫.৮ শতাংশ পুরুষই নিয়মিত দেশে প্রস্তুত বিদেশি মদ্যপান করছেন।

কেন ভারতে নারী-পুরুষ নির্বিশেষে মদ্যপান করছেন, এর কারণ হিসেবে গবেষকরা মনে করছেন, ভারতে অতি দ্রুত হারে নগরায়ন ঘটে চলেছে। এর জেরে জীবনযাপনের ধরনের রদবদলই নারীপুরুষের পানাসক্তি বৃদ্ধির অন্যতম প্রধান কারণ।করোনা পরিস্থিতিতে ২০২০ সালে ভারতে ৫ বিলিয়ন লিটারের মদের ফোয়ারা ছুটেছে অবিশ্রান্তভাবে। গবেষকদের পূর্বাভাস, আগামী দু'বছর, অর্থাৎ ২০২৪ সালের মধ্যে ভারতে তৈরি বিদেশি মদের চাহিদা বেড়ে দাঁড়াবে ৬.২১ বিলিয়ন লিটারে। 

বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থা জানিয়েছে, মদ্যপানের ফলে প্রতি বছরই ভারতে অন্তত ২ লক্ষ ৬০ হাজারের বেশি মানুষের নানা রোগভোগে মৃত্যু হচ্ছে। এর মধ্যে রয়েছে লিভার সিরোসিস থেকে ক্যান্সারে কিংবা হৃদরোগে আক্রান্ত হয়ে অহরহ মৃত্যুর ঘটনা। এছাড়া মদ্যপায়ীদের মধ্যে একাংশের মৃত্যু হচ্ছে পথ দুর্ঘটনায়। মদ্যপানের ফলে বিভিন্ন ধরনের অসুখের কবলে পড়ে সারা পৃথিবীতে দৈনিক ৬ হাজার মদ্যপায়ীর মৃত্যু হচ্ছে। এছাড়া মদ্যপায়ীদের একাংশ নানা ধরনের মানসিক রোগেরও শিকার বলে জানিয়েছে বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থা। বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থার প্রকাশিত তথ্যানুসারে, প্রতি বছর ভারতে মদ্যপায়ীদের মধ্যে অন্তত ৩০ হাজার মানুষের মৃত্যু হচ্ছে ক্যান্সারে। আর মদ্যপান করে অসাবধানতার ফলে পথ দুর্ঘটনায় মৃত্যু হচ্ছে অন্তত এক লক্ষ মানুষের।

বিষমদ বা অত্যধিক মদ্যপানজনিত মৃত্যু রোধ করার প্রয়োজন আছে বইকি, তবে ভারতীয় সমাজে মদ্যপানের সংস্কৃতিকে ঘিরে এই পরিবর্তন অবশ্যই উল্লেখযোগ্য!

More Articles