আইনস্টাইনের চোখে গান্ধী: অহিংসার পথেই মানবতার ভবিষ্যৎ?
Albert Einstein and Mahatma Gandhi: প্রথম বিশ্বযুদ্ধের শেষের দিকে এবং দ্য লিগ অব নেশনস গঠন পর্যন্ত গান্ধী বিশ্বে সেরকম পরিচিতি পাননি। কিন্তু, ইতোমধ্যে, আইনস্টাইন তাঁর শান্তিবাদের প্রচার শুরু করেছিলেন।
গান্ধী সম্পর্কে আইনস্টাইন বলেছেন,
“আমি বিশ্বাস করি যে আমাদের সমকালীন সকল রাজনৈতিক ব্যক্তিদের মধ্যে গান্ধীর বিচার সবচেয়ে
উজ্জ্বল, আমাদের তাঁর দেখানো পথ অনুসরণ করা উচিত। কোনো মহৎ উদ্দেশ্য নিয়ে রচিত লড়াইয়ে
হিংসার পথ পরিহার করা উচিত, মন্দ বা অশুভ বলে বিবেচিত কোনো কিছুতে অংশগ্রহণ করা থেকে বিরত থাকা উচিত।”
বিশ্বের সমস্ত রাজনৈতিক নেতাদের মধ্যে, অতীত ও তৎকালীন সমসাময়িক কালে, অ্যালবার্ট আইনস্টাইনের কাছে নায়ক ছিলেন একজন ভারতীয়, যাঁর পরনে থাকতো স্যান্ডেল ও এক জোড়া পাতলা চশমা, হাতে একটি কাঠের লাঠি। মোহনদাস করমচাঁদ গান্ধী, মহাত্মা গান্ধী নামেই সুপরিচিত। বলতে হয়, এই ‘মহাত্মা’ উপাধিটি কবিগুরু রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের দেওয়া। নিউ জার্সির প্রিন্সটনে আইনস্টাইনের বাড়ির দেওয়ালে পদার্থবিদদের ছবির পাশে মহাত্মা গান্ধীর ছবিও টাঙানো ছিল।
“মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের প্রিন্সটন বিশ্ববিদ্যালয়ে যাওয়ার মূল রাস্তা থেকে একটি শাখাপথ বের হয়ে যায় মারসার স্ট্রিট। মারসার স্ট্রিটের ১১২ নম্বর দোতলা বাড়িটির উপরতলার কক্ষে মহাত্মা গান্ধীর একটি প্রতিকৃতি শোভা পাচ্ছে। গান্ধীর ছবি ছাড়াও সেখানে পদার্থবিদ মিশেল ফ্যারাডে ও জেমস ক্লার্ক ম্যাক্সওয়েলের ছবি রয়েছে।”
গান্ধীর প্রতি আইনস্টাইনের আকর্ষণ ও মুগ্ধতা বর্ণনা করতে গিয়ে সিস্টেমেটিক থিওলজির অধ্যাপক
সরোজিনী হেনরি বলেছেন আইনস্টাইনের বাড়িতে গান্ধীর পতিকৃতি এটাই ইঙ্গিত দেয় যে বিশ্ব-রূপান্তরকারী এই দুই ব্যক্তিত্বের বিচরণক্ষেত্র ভিন্নতর হলেও তাঁদের মধ্যে ছিল এক অন্তরলীন সাযুজ্য।
আরও পড়ুন
বারবার হত্যার পরিকল্পনা || কারা ছিল গান্ধী-নিধনের নেপথ্যে?
১৮৬৯ সালে জন্মগ্রহণ করা গান্ধী বয়সে আইনস্টাইনের চেয়ে দশ বছরের বড় ছিলেন। তাঁদের গড়ে ওঠার সামাজিক ও শৈক্ষিক প্রেক্ষাপট ছিল সম্পূর্ণ ভিন্ন। কিন্তু, শান্তি নীতিতে আস্থা, রাজনৈতিক সমস্যা সমাধানে অহিংসার পথ, স্বাধীনতা ও মানবাধিকার-সহ মানুষের প্রতি দয়া ও জীবনের প্রতি শ্রদ্ধা— এই বিষয়গুলিতে তাঁদের মধ্যে মিল ছিল লক্ষণীয়।
“এমন একটি সময়ে যখন বিজ্ঞান এবং আধ্যাত্মিকতাকে প্রায়শই পরস্পর বিরোধী বলে মনে করা হত, বিজ্ঞানীদের ধ্বংসাত্মক শক্তি ও যুদ্ধ প্রযুক্তির কারিগর হিসেবে বিবেচনা করা হত, সেই সময় এই দুই মহামানবের দৃষ্টিভঙ্গির সাদৃশ্য তাঁদের অবস্থানের সত্যতার সাক্ষ্য দেয়।”
এই মন্তব্যটি করেছেন আইনস্টাইন নিয়ে গবেষণা করা লেখক রাসউল সোরখাবি। আইনস্টাইনের সমস্ত বৈজ্ঞানিক কাজের পিছনে ছিল এক অপরিবর্তনীয় নীতি যাকে বলা হয় ইনভেরিয়েন্ট প্রিন্সিপল। যেমন,
‘শূন্যস্থানে আলোর গতি প্রকৃতিতে একটি ধ্রুবক যা পরিবর্তন করা যায় না।’
তাঁর এই অপরিবর্তনীয় নীতির দর্শন ছিল ‘বস্তুগত বাস্তবতা’। পাশাপাশি, আইনস্টাইন ও গান্ধীর শান্তিবাদ ছিল সমবর্তী।
প্রথম বিশ্বযুদ্ধের শেষের দিকে এবং দ্য লিগ অব নেশনস গঠন পর্যন্ত গান্ধী বিশ্বে সেরকম পরিচিতি পাননি। কিন্তু, ইতোমধ্যে, আইনস্টাইন তাঁর শান্তিবাদের প্রচার শুরু করেছিলেন। তাই, একজন ওপরজন থেকে অনুপ্রাণিত হয়েছেন এমনটা নয়। সোরখাবি যেমন বলেছেন, আইনস্টাইন গান্ধীজির নীতিতে সহমত থাকলেও, অনেকক্ষেত্রে তাঁর মৃদু সমালোচনা করতে দ্বিধা করেননি। গান্ধীর অপরিবর্তনীয় নীতি ছিল অহিংসা। দক্ষিণ আফ্রিকায় থাকা ভারতীয়দের একটি সভায় গান্ধী মন্তব্য করেছিলেন যে ভারতের স্বাধীনতা আন্দোলন হিংসার পথ ধরতে শুরু করেছে। তিনি দৃঢ় প্রত্যয়ে বলেছিলেন,
“এমন কোনো কারণ নেই যার জন্য আমি হত্যা করতে উদ্যত হব। এমনকি স্বাধীনতার জন্যও নয়।”
গান্ধীর এই অবস্থানে স্বতঃস্ফুর্ত সমর্থন করাকে স্বাভাবিক বলে মনে করেছিলেন আইনস্টাইন। তাঁদের একে অপরের সঙ্গে সাক্ষাৎ হয়নি, যদিও সাক্ষাতের বাসনা দুজনেরই ছিল। ১৯২৯ সালের জুলাই মাসে খ্রিস্টান সেঞ্চুরির নেওয়া এক সাক্ষাৎকারে গান্ধী সম্পর্কে প্রথম প্রশংসাসূচক মন্তব্য করেছিলেন আইনস্টাইন। (সূত্র : জেরুজালেমের হিব্রু বিশ্ববিদ্যালয়)।
“মহাত্মা গান্ধীর জীবনের কৃতিত্ব পৃথিবীর রাজনৈতিক ইতিহাসে অনন্য। এক নিপীড়িত দেশের মুক্তি লাভের সংগ্রামে তিনি এক সম্পূর্ণ নতুন মানবিক উপায় উদ্ভাবন করেছেন এবং পরম শক্তি ও নিষ্ঠার সঙ্গে তিনি তা অনুশীলন করেছেন। সমগ্র সভ্য জগতের সচেতনভাবে চিন্তাশীল মানুষের উপর তিনি যে নৈতিক প্রভাব ফেলেছেন
তা সম্ভবত আমাদের সময়ের নৃশংস হিংস্র শক্তির অতিমূল্যায়নের চেয়ে অনেক বেশি স্থায়ী হবে। কারণ, কেবল এই ধরণের রাষ্ট্রনায়কদের প্রতিমূর্তিই দীর্ঘস্থায়ী হয় যাঁরা তাঁদের জীবন ও শিক্ষামূলক কাজের মাধ্যমে জনগণের নৈতিক শক্তিকে জাগ্রত করেন, শক্তিশালী করেন। আমরা সকলেই উৎফুল্ল ও কৃতজ্ঞ হতে পারি যে নিয়তি আমাদেরকে এমন একজন আলোকিত সমসাময়িক ব্যক্তিত্ব উপহার দিয়েছে যিনি আগামী প্রজন্মের জন্য একজন রোল-মডেল হিসেবে অবশ্যই বিবেচিত হবেন।”
আরও পড়ুন
শরৎচন্দ্র থেকে গান্ধীজি, সকলেই শিকার হয়েছিলেন রসিকতার, আসলে কেমন মানুষ ছিলেন রবীন্দ্রনাথ?
১৯৩১ সালের অক্টোবরে গান্ধীকে লেখা আইনস্টাইনের চিঠি। (সূত্র: সরস্বতী আলবানো-মুলার)
শ্রদ্ধেয়
গান্ধীজি,আমার বাড়িতে উপস্থিত আপনার এক বন্ধুর মাধ্যমে আমার এই লাইনগুলি পাঠাচ্ছি। আপনি আপনার কাজের মাধ্যমে দেখিয়েছেন, যাঁরা হিংসার পথ পরিত্যাগ করেননি তাঁদের সঙ্গেও হিংসা ছাড়াই সফল হওয়া সম্ভব। আমরা আশা করতে পারি যে আপনার উদাহরণ আপনার দেশের সীমানা ছাড়িয়ে ছড়িয়ে পড়বে এবং আন্তর্জাতিক কর্তৃত্ব প্রতিষ্ঠা করতে সাহায্য করবে, যা সকলের কাছে গ্রহণযোগ্য হবে ও যুদ্ধ-সংঘাত প্রতিস্থাপন করবে।
আন্তরিক প্রশংসা-সহ,
আপনার এ. আইনস্টাইন (স্বাক্ষর)।আশা করি, কোনও দিন আপনার মুখোমুখি সাক্ষাতের সৌভাগ্য হবে আমার।
উত্তরে গান্ধী লিখেছিলেন –
লন্ডন, ১৮ অক্টোবর, ১৯৩১
প্রিয় বন্ধু,সুন্দরমের মাধ্যমে আপনার সুন্দর চিঠিটি পেয়ে আমি আনন্দিত হয়েছি। এটি আমার জন্য একটি বড় সান্ত্বনা যে আমার সংগ্রাম আপনার দৃষ্টিগোচর হয়েছে। আমার আকাঙ্ক্ষা, আমরা যেন
মুখোমুখি দেখা করতে পারি এবং তাও ভারতে আমার আশ্রমে।আপনার বিশ্বস্ত,
এম কে গান্ধী
(সূত্র: ‘মহাত্মা গান্ধীর সংগৃহীত কাজ’, সংখ্যা ৫৪, www.gandhiserve.org/cwmg/VOL054.PDF)
১৯৩৯ সালে গান্ধীর ৭০তম জন্মদিন উপলক্ষে আইনস্টাইনের মন্তব্য ‘আউট অব মাই লেটার ইয়ার্স’-এ (নিউ ইয়র্ক: ফিলোসফিক্যাল লাইব্রেরি, ১৯৫০) প্রকাশিত হয়েছে। আইনস্টাইন বলেছেন,
“বাইরের শাসনতন্ত্র দ্বারা অসমর্থিত হলেও তিনি একজন জনগণের নেতা, একজন রাজনীতিবিদ যিনি ধূর্ততা বা প্রযুক্তিগত যন্ত্রের রহস্যের উপর নির্ভর করেননি। তিনি তাঁর ব্যক্তিত্বের শক্তির উপর দৃঢ়বিশ্বাসী একজন বিজয়ী যোদ্ধা, যিনি সব সময় ক্ষমতার ব্যবহারকে উপেক্ষা করেছেন। সংকল্প ও অনমনীয় ধারাবাহিকতায় সজ্জিত একজন প্রজ্ঞা ও মানবতার মানুষ যিনি দেশবাসীর উন্নতির জন্য তাঁর সবকিছু উৎসর্গ করেছেন, একজন ব্যক্তি যিনি সাধারণ মানুষের মর্যাদায় আসীন হয়ে ইউরোপের বর্বরতার মোকাবিলা করেছেন এবং এইভাবে তিনি নিজেকে উচ্চাসনে
প্রতিষ্ঠিত করেছেন।”
বলা বাহুল্য, গান্ধীর মতো একই মূল্যবোধ না থাকলে আইনস্টাইন প্রশংসার এই বিজয়গাথা শোনাতে পারতেন না। মৃত্যুর আগে, ১৯৫৫ সালে, আইনস্টাইন জনহিতার্থে যে সর্বশেষ নথিতে স্বাক্ষর করেছিলেন তা ছিল রাসেল-আইনস্টাইন ইস্তেহার। এই ইস্তেহারে শান্তির লক্ষ্যে মানবজাতির সমৃদ্ধির প্রশস্ত পথের ধারণা ছিল, যে মন্ত্র আইনস্টাইন সারা জীবন ধরে প্রচার করে গিয়েছেন গান্ধীর মতোই।
Whatsapp
