ভাগবাটোয়ারার দিনগুলিতে সকলেই ব্যস্ত ছিল পাওনা বুঝে নিতে

The Great Calcutta Killings : আজকে যদি কেউ এই সমস্ত ব্যপারটার জন্য মুসলিম-সমাজকে দায়ী করেন, তাহলে সেটা অন্যায় হবে এই কারণে যে দীর্ঘদিন ধরে মুসলিম-সমাজ হিন্দুদের লাঞ্ছনার শিকার হয়ে এসেছে।

চল্লিশের দশকে, দেশভাগের পূর্ববর্তী পরিস্থিতির একটা দীর্ঘ ও জটিল ইতিহাস আছে। সেই ইতিহাসে দীর্ঘদিন ধরে কংগ্রেসের আধিপত্য, তার রাজনৈতিক ব্যর্থতা যেমন আছে, তেমনই মুসলিম লীগের জঘন্য সাম্প্রদায়িক রাজনীতিও রয়েছে। কংগ্রেস অন্তত সাম্প্রদায়িক সংগঠন ছিল না, দলটির মধ্যে নানাবিধ ভাগ ছিল। কারও-কারও মধ্যে হয়তো সাম্প্রদায়িক মনোভাব ছিল, আবার অনেকের মধ্যে তা ছিল-ও না। কিন্তু মুসলিম লীগ তৈরি-ই হয়েছিল একটা সাম্প্রদায়িক উদ্দেশ্য নিয়ে এবং ধীরে-ধীরে তারা সেই উদ্দেশ্য চরিতার্থ করার দিকে এগোতে শুরু করে।

অবশ্য, এরও একটা পটভূমি আছে। বাংলার কথা আমরা যদি বলি, শুধু বাংলা কেন ভারতের সর্বত্রই হিন্দুরা মুসলিমদের ঘৃণা করেছে। তাদের আর্থিক ও সাংস্কৃতিক দিক থেকে অবদমিত করে রাখার চেষ্টা করেছে। ১৯২০-র পর, মুসলিম-সমাজের মধ্যে শিক্ষার প্রসার হতে থাকে, তাদের মধ্যেও একটা মধ্যবিত্ত শ্রেণি গড়ে উঠতে থাকে। স্বভাবতই তাদের নিজস্ব আশা-আকাঙ্ক্ষা তৈরি হয়, যা খুবই সংগত। ১৯৩০-এর শেষ থেকে এবং ১৯৪০-এর দশকে, যখন বাংলায় মুসলিম লীগ প্রথমে আংশিকভাবে, পরে সামগ্রিকভাবে ক্ষমতায় এল, তখন তারা তাদের সেই সাম্প্রদায়িক উদ্দেশ্যের দিকেই ধীরে-ধীরে এগিয়ে যেতে লাগল। স্বাভাবিকভাবেই সেই সময় হিন্দুদের দিক থেকেও একটা প্রতিক্রিয়া দেখা দিয়েছিল।

আরও পড়ুন-

১৯৭১-এর মুক্তিযুদ্ধে যে কৌশলে পাকিস্তানকে নাস্তানাবুদ করেছিল ভারত

সে-সময়, শিক্ষাক্ষেত্রে মুসলিম লীগ তাদের নিজস্ব সংস্কৃতি প্রতিষ্ঠা করতে চাইছে, একাধিক ক্ষেত্রে হিন্দু যুবকের চাকরি পাওয়া প্রায় অসম্ভব হয়ে দাঁড়িয়েছে— অজস্র মানুষের লেখায় এ-ঘটনার উল্লেখ আছে। সেই মানুষগুলি কিন্তু সাম্প্রদায়িক নন। তাঁরা সেই সময়ের পরিস্থিতিটা কেবল মাত্র নিরপেক্ষভাবে বলেছেন। সর্বশেষে, ১৯৪৬ সালে মুসলিম লীগের ডাকা প্রত্যক্ষ সংগ্রাম, সেটা এক ভয়ানক মানুষ মারার রাজনীতি হয়ে ওঠে। যদিও প্রথমে আক্রান্ত হলেও, পরে হিন্দুরাও সমানভাবে হিংসায় যোগ দিয়েছিল। যেহেতু প্রত্যক্ষ সংগ্রাম ঘোষণা করেছিল মুসলিম লীগ, তাই তারপর হিন্দুদের সংগত কারণেরই ধারণা তৈরি হয় যে মুসলিম লীগের সঙ্গে আর থাকা যাবে না। ফলে, দেশভাগ অবশ্যম্ভাবী হয়ে পড়ে। সুনীতি কুমার চট্টোপাধ্যায়, যদুনাথ সরকার, মেঘনাদ সাহা— যাঁরা মোটেই সাম্প্রদায়িক নন, অত্যন্ত উদারমনা মানুষ, তাঁরাও কিন্তু সেই সময় বঙ্গ বিভাজন সমর্থন করেছিলেন এই কারণে যে, পরিস্থিতি তখন যা আকার নিয়েছিল, তাতে আর মুসলিম লীগের সঙ্গে থাকা যাচ্ছিল না।

দাঙ্গা বিধ্বস্ত কলকাতা

শ্যামাপ্রসাদ মুখোপাধ্যায়ের রাজনীতিকেও কিন্তু এই পরিপ্রেক্ষিতেই বিচার করতে হবে। বলা যেতে পারে, সেই সময়ের যে ক্ষুব্ধ তরুণ-মন, তার প্রতিনিধি হিসেবে শ্যামাপ্রসাদ একটা গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করেছিলেন, যা আমরা অস্বীকার করতে পারি না। তাঁর রাজনীতি আমাদের অনেকের পছন্দ নাও হতে পারে, কিন্তু তাঁর যে একটা ঐতিহাসিক ভূমিকা ছিল সেটা স্বীকার করতেই হয়।

আরও পড়ুন-

দেশভাগের দগদগে ঘা! কেন ১৮ অগাস্ট স্বাধীনতা দিবস পালিত হয় বাংলার এই জেলাগুলোতে?

আজকে যদি কেউ এই সমস্ত ব্যপারটার জন্য মুসলিম-সমাজকে দায়ী করেন, তাহলে সেটা অন্যায় হবে এই কারণে যে, দীর্ঘদিন ধরে মুসলিম-সমাজ হিন্দুদের লাঞ্ছনার শিকার হয়ে এসেছে। উলটো দিকে, মুসলিম লীগের জঘন্য সাম্প্রদায়িক রাজনীতি ধীরে-ধীরে দেশভাগের দিকে পরিস্থিতিকে এগিয়ে নিয়ে গেল, তা-ও আমরা অস্বীকার করতে পারি না। কিন্তু কোনও একটা নির্দিষ্ট সম্প্রদায়কে দায়ী করা যায় না। ভারতের তিনটি প্রধান সম্প্রদায়— হিন্দু, মুসলিম, শিখ— এরা প্রত্যেকেই তখন দায়ী ছিল। হয়তো ভূমিকায় কিছু তারতম্য থাকতে পারে। কিন্তু দায় কেউ-ই অস্বীকার করতে পারে না।

আজকে ভারতের যে সাম্প্রদায়িক অবস্থা, তার সঙ্গে '৪৬ সালের কিন্তু তেমন মিল নেই। মনে রাখতে হবে, সে-সময় অবিভক্ত বাংলায় মুসলিমরা ছিল সংখ্যা গুরু, তারা তখন ক্ষমতায় ছিল, ফলে হিন্দুদের তখন মুসলিমদের প্রতি ক্ষোভ থাকা হয়তো স্বাভাবিক-ই ছিল। সেই সময়, প্রায় প্রতিটি সম্প্রদায়ই বুঝতে পেরেছিল যে এবার ব্রিটিশরা ভারত থেকে চলে যাচ্ছে, এবার একটা ভাগবাটোয়ারার সময় এসেছে। এবং প্রত্যকেই কে কতটা কী পেতে পারে, সেই নিয়ে ব্যস্ত ছিল তখন। ফলে, সেই সময়ের রাজনীতির সঙ্গে এখনকার ভারতের কোনও মিল নেই।

More Articles