জলাতঙ্ক র‍্যাবিস হাজারো ভয়, পথ-কুকুরদের সরিয়ে দেওয়াই একমাত্র পথ?

Stray Dogs : বাইরের দেশগুলিতে কিন্তু পথ-কুকুরদের তুলে নিয়ে গিয়ে কোনও দ্বীপে ছেড়ে দিয়ে আসে না। সেখানেও স্টেরিলাইজেশন ও ভ্যাক্সিনেশনের মাধ্যমেই পথ-কুকুরদের সংখ্যা কমেছে।

পথ-কুকুরদের ঘর, খোলা রাস্তা। আমরাই ওদের চেনা প্রতিবেশী। শহরের কিংবা গ্রামের সমস্ত পাড়াতেই পথ-কুকুরদের একটা দল থাকে। কাছে গিয়ে আদর করলে, একটু খেতে দিলে, তাদের মতো বন্ধু পাওয়া ভার! আপনার দিকে মায়াভরা চোখ নিয়ে তাকিয়ে থাকা, আপনাকে দেখা-মাত্র আনন্দে লাফানো, অনর্গল লেজ নাড়তে থাকা এইসব প্রাণীরা আমাদের প্রতিদিনের জীবনের অংশ। পাড়ায় পাড়ায় ওরাই রাতের অলিখিত পাহারাদার।

আরও পড়ুন-

কুকুরের দিকে তাকালেই তাদের মস্তিষ্কের সঙ্গে জুড়ে যায় মানুষের মস্তিষ্ক? কী বলছে গবেষণা?

সম্প্রতি সুপ্রিম কোর্ট নির্দেশ দিয়েছে, দিল্লির সমস্ত রাস্তা থেকে আট সপ্তাহের মধ্যে সরিয়ে ফেলতে হবে পথ-কুকুরদের। এর প্রধান কারণ, পথ-কুকুরদের কামড়ে দিল্লিতে অনেকেরই জলাতঙ্ক হচ্ছে। সুপ্রিম কোর্ট নির্দেশ দিয়েছে, পথ-কুকুরগুলিকে রাস্তা থেকে তুলে নিয়ে গিয়ে একটা নির্দিষ্ট আশ্রয়স্থলে রাখতে হবে। সুপ্রিম কোর্টের এই আদেশের সঙ্গে দেশের বিপুল অংশের পশুপ্রেমীরা একমত নন।

পথ-কুকুর

দেশের প্রখ্যাত ফ্যাশন ডিজাইনার অভিষেক রায়, ব্যক্তিজীবনে একজন পশুপ্রেমী মানুষ। দিল্লিতে কুকুরদের এভাবে রাস্তা থেকে তুলে নিয়ে যাওয়ার প্রসঙ্গে তাঁর বক্তব্য,

আমি ও আমার পাড়ার প্রতিবেশীরা, আমাদের আশেপাশের পথ-কুকুরদের নিয়মিত যত্ন নিই। আমাদের দৈনন্দিন জীবনে ওরা কখনওই কোনও অসুবিধা সৃষ্টি করেনি। আমি বুঝতে পারছি না, এমন কি পরিস্থিতি হল যে সারা শহর থেকে পথ-কুকুরদের সরিয়ে দিতে হবে? এবং সরিয়ে নিয়ে গিয়ে এমন একটা ছোট জায়গায় পথ-কুকুরগুলিকে রাখা হচ্ছে, যা দেখলে হতবম্ব হয়ে যেতে হয়। এটা খুবই অমানবিক কাজ।

তাহলে এর প্রতিকার কী? অভিষেক কয়েকটি গুরুত্বপূর্ণ দিক নির্দেশ করে বলেছেন,

সচেতন মানুষেরা এগিয়ে এসে যদি এর প্রতিবাদ করেন, তাহলে নিশ্চয়ই বিষয়টির কোনও সুরাহা হবে। একটা সভ্যসমাজে এতগুলো পথ-কুকুরকে এভাবে শহর থেকে তাড়িয়ে দেওয়া যায় না। সরকার এলাকা ভিত্তিক ভ্যক্সিনেশন করুক। কর্পোরেশন বা মিউনিসিপালটি এর দায়িত্ব নিক।

এ ১ অ্যানিমেলস কাম ফার্স্ট (A1 ANIMALS COME FIRST) নামক এনজিও বহু দিন ধরেই পথ-পশুদের নিয়ে কাজ করে আসছে। সংস্থার অন্যতম ব্যক্তি সুকন্যা ভট্টাচার্য এই পুরো বিষয়টিকেই একটি অমানবিক পদক্ষেপ বলে মনে করছেন। সুকন্যার বক্তব্য,

যে রাস্তায় জন্মেছে কুকুরগুলো, যেখানে বড় হয়েছে, সেখান থেকে রাতারাতি তুলে নিয়ে চলে যাওয়া হবে তাদের, এটা কি কোনও মানবিক আচরণ? ওরা কি কোনও আবর্জনা যে এভাবে তুলে নিয়ে চলে যাবে? কুকুরগুলির যেহেতু ভোটাধিকার নেই, তাই ওদের তুলে নিয়ে গেলে কারও কোনও অসুবিধে হবে না।

আরও পড়ুন-

সভ্য দেশে পথকুকুর থাকে না? কেন ৪০ লক্ষ কুকুরের নিধনযজ্ঞে মাতছে তুর্কি সরকার?

এ-প্রসঙ্গে কয়েকটি যুক্তি-সংগত প্রশ্ন করেছেন সুকন্যা। প্রশ্নগুলি এমন,

আমার প্রশ্ন, সরকারের কি সেই পরিকাঠামো আছে যেখানে সরকার দু-তিন লক্ষ কুকুরকে একসঙ্গে জায়গা দিতে পারবে? যতদূর জানি, তা নেই। শুধু দিল্লি কেন? কোনও রাজ্যেই কি এই ব্যবস্থা রয়েছে? দ্বিতীয়ত, কুকুরগুলির ভরণপোষণ কী করে হবে? এখন পথ-কুকুরগুলি নিজেদের খাবার জোগাড় করে নিচ্ছে রাস্তা থেকে অথবা কোনও ফিডার তাদের খাওয়াচ্ছে। খাদ্যের বিষয়ে তো কাউকে তাদের দায়িত্ব নিতে হচ্ছে না। একেকটা কুকুরের গড় আয়ু ৬-১০ বছর। এতগুলি বছর ধরে, কুকুরগুলিকে খাওয়ানো, তাদের জন্যে লোক রাখা, তাদের ওষুধের ব্যবস্থা, এর জন্য বিপুল অর্থের প্রয়োজন। সেই অর্থ রাষ্ট্র খরচ করতে রাজি তো? তৃতীয়ত, যদি এই অর্থ রাষ্ট্রের কাছে থেকে থাকে, তাহলে এতদিন ধরে সেই অর্থে কুকুরগুলিকে স্টেরিলাইজড ও ভ্যাক্সিনেট করা হল না কেন? তাহলেই সমস্যা মিটে যেত।

সুকন্যা আরও বলেছেন,

বাইরের দেশগুলিতে কিন্তু পথ-কুকুরদের তুলে নিয়ে গিয়ে কোনও দ্বীপে ছেড়ে দিয়ে আসে না। সেখানেও স্টেরিলাইজেশন ও ভ্যাক্সিনেশনের মাধ্যমেই পথকুকুরদের সংখ্যা কমেছে। স্বাধীনতার বহু বছর পার করেও এই উদ্যোগটা সরকার কেন নিল না? এটা তো জনস্বাস্থ্যর প্রশ্ন! আসলে সকলেই জেগে ঘুমোই। কত তাড়াতাড়ি কাঁধ থেকে ঝামেলা ঝেড়ে ফেলতে পারব, তারই পথ খুঁজি আমরা। আর, এভাবে কোনও জায়গা থেকে কোনওদিন কুকুরকে সরানো যায় না। আপনি, আপনার পাড়ার পরিচিত কুকুরদের দশ দিনের জন্য সরিয়ে দিয়ে দেখুন, সেই জায়গায় অন্য কুকুররা চলে আসবে। জায়গাটা ফাঁকা থাকবে না। কারণ, সেখানে খাদ্যের সংস্থান আছে। তাই অন্য কুকুর চলে আসবে। আর কোনও অঞ্চলই পৃথক একটা দ্বীপ নয়। সল্টলেকের সঙ্গে যেমন নিউটাউনের যোগ আছে, তেমনই নিউটাউনের সঙ্গে ইএমবাইপাস সংযুক্ত। ফলে, একটা জায়গার কুকুর সরে গেলে, অন্য অঞ্চলের কুকুর সেই জায়গাটা নিয়ে নেবে।

সুকন্যা ভট্টাচার্যের মতোই ভোটাধিকারের প্রসঙ্গ তুলেছেন আরেকজন পশুপ্রেমী মানুষ। দেবত্রী গোস্বামী (বুকুন) জীবিকায় একজন প্রতিষ্ঠিত ফ্যাশন ডিজাইনার। ব্যক্তিজীবনে কুকুর-বিড়ালদের বিপদ থেকে বাঁচানো, অসুস্থদের সারিয়ে তোলা, নিজের বাড়িতে এনে রাখা, এসবই দেবত্রী বহুদিন ধরে করছেন। সুপ্রিম কোর্টের নির্দেশ প্রসঙ্গে তাঁর বক্তব্য,

পথ-কুকুররা দেশের ভোটার নয়, তাই ওদের জীবনের কোনও দাম নেই। আমি আপনার সঙ্গে যখন কথা বলছি, তখন ভারতের কোথাও-না-কোথাও একজন মহিলাকে ধর্ষিত হতে হচ্ছে। কিন্তু আমরা তো বলতে পারছি না যে সমস্ত পুরুষদের সমাজ থেকে তুলে নাও? বলতে পারছি না কারণ, তারা রেপিস্ট হলেও তারা দেশের ভোটার। ‘ভোট’ এদেশের ক্ষমতাকে নিয়ন্ত্রণ করে। যেহেতু পথ-কুকুরদের কোনও ভোটাধিকার নেই, তাই তাদের তুলে নিয়ে যাওয়া হচ্ছে।

দেবত্রী আরও বলেছেন,

আমার যতদূর মনে পড়ছে, ভারতে গত বছর কুকুরের কামড়ে মারা গেছে ৫৪ জন মানুষ। যদি দেখি সারা বছরে সারা দেশে ক-জন মানুষ না খেতে পেয়ে মারা গেছেন? কজন মহিলাকে ধর্ষণ করা হয়েছে, সেই হিসেবের তুলনায় পথ-কুকুরদের কামড়ে মৃত্যুর সংখ্যা প্রায় কিছুই নয়। আসলে পথ-কুকুররা যেহেতু অসহায়, তারা প্রতিবাদ করতে পারবে না, তাই তাদের ওপর এই অত্যাচার করাই যায়। বলা হচ্ছে, পথকুকুরদের একটা আশ্রয়স্থলে রাখা হবে। প্রশ্ন হল, কত বড় আশ্রয়স্থল এদেশে আছে যেখানে লক্ষ-লক্ষ কুকুরদের একসঙ্গে রাখতে পারবে সরকার? একটা ছোট জগায়গার ভেতর কুকুরগুলো থাকবে। একবেলা খেতে পাবে। রোগ হবে। তারপর মারা যাবে। আসলে সরকার ঘোরানো-পথে ওদের মৃত্যুই চায়। এরকম অমানবিক পদক্ষেপ কিছুতেই মেনে নেওয়া যায় না।

অভিষেক, সুকন্যা, দেবত্রীদের মতোই সারা দেশজুড়ে আরও অনেক পশুপ্রেমীরাই বিষয়টির প্রতিবাদ করছে। মঙ্গলবার দিল্লিতে পশুপ্রেমীদের একটি দল ইন্ডিয়া গেটের কাছে বিক্ষোভ করলে, পুলিশ চল্লিশজনকে ঘটনাস্থল থেকে গ্রেপ্তার করে। বিষয়টিকে ঘিরে দেশের বিভিন্ন অঞ্চলেই শুরু হয়েছে বিতর্ক, আন্দোলন। দেশের সর্বোচ্চ আদালত কি এই নির্দেশ আবার পালটাবেন? সেই দিকেই তাকিয়ে আছে সারা দেশের পশুপ্রেমী মানুষের চোখ। 

More Articles