পরিযায়ী শ্রমিকরা কাজ চায়, সরকারের দয়া চায় না!

Migrant laborers : মনে আছে ২০২৩ সাল, অগাস্ট মাস। হরিয়ানা দাঙ্গা বিধ্বস্ত। মাত্র এক ঘণ্টার নোটিশে ঘর ছাড়তে হচ্ছে পরিযায়ী বাঙালি মুসলমানদের।

দিল্লি-গুরগাঁও মিলিয়ে পাঁচ বছর হয়ে গেল। ধীরে ধীরে এই দুটো শহরও আমার শহর হয়ে উঠছে। এখন এদের ভাষায় ওদের সঙ্গে ঝগড়া করতে পারি। এখন আমার হিন্দিভাষী ড্রাইভারকে বাংলা গান শোনাতে পারি। সে এখন চিনে গেছে ‘চন্দ্রবিন্দু’। গাড়িচালাতে চালানোর সময় বাংলা গান শুনলে তার আর ঘুম পায় না। আবার গুরগাঁও ফ্ল্যাটে কাজ করতে আসা প্রায় সকলের সঙ্গেই প্রাণ খুলে বাংলায় কথা বলতে পারি। ওরা কোচবিহারের লোক। ওদের থেকেই খবর পাই এবার দিনহাটায় চাষ কেমন হল, আলিপুরদুয়ারে বৃষ্টি কেমন! 

হরিয়ানা প্রদেশে বাৎসরিক উৎসব হল বাঙালি তাড়ানো (পড়ুন বাঙালি মুসলমান তাড়ানো)। তখন এই কোচবিহারের চেনা মুখগুলো পালায় এই ‘দেশ’ ছেড়ে। কেউ-কেউ ফিরে আসে, কেউ-বা চলে যায় অন্য ‘দেশে’। কিন্তু কেউ-ই আর নিজের দেশে ফেরে না। কেউ-কেউ সাময়িকভাবে নিজের গ্রামে ফিরলেও, অপেক্ষা করে পরিস্থিতি শান্ত হওয়ার জন্য। এখানকার স্থানীয় লোকদের সঙ্গে কথা বলে জানতে চেয়েছি, ওদের তাড়াও কেন? কেবলই মুসলমান বলে? উত্তর কিন্তু পুরোটাই 'হ্যাঁ' নয়। উত্তরের একটা বড় অংশ হল, ওরা ওদের (লোকালদের) কাজ খেয়ে নিচ্ছে।  

কোভিডে, পরিযায়ী শ্রমিকেরা নিজের রাজ্যে ফিরছেন

কাজ যে খেয়ে নিচ্ছে তা কিন্তু মিথ্যে নয়। গুরগাঁওতে আমরা সাধারণত পছন্দ করি বাঙালিদেরই কাজে রাখতে। কারণ তাদের কাজের পদ্ধতি অনেক পরিষ্কার। তারা সপ্তাহে চারদিন ছুটি নেয় না। কিন্তু হরিয়ানার 'জাঠ' নামক জাতির মধ্যে এসব নেই। চাষ এবং গাই পালনের পর কিছুটা শখের বসেই এরা কাজ করতে আসেন। তাই এই শখের কাজ থাকল কী গেল, এদের তাতে কিছুই যায় আসে না। কিন্তু কপাল-পোড়া ওই বাঙালিদের এই আহ্লাদটুকু করতে নেই। যে-টাকাতে তারা নিজের দেশে ঘর চালাত, এখানে এক বাড়িতে কাজ করলে সেই টাকা পাওয়া যায়। এই স্বচ্ছলতার জন্যই না তারা নিজের ঘর ছেড়েছে!

আরও পড়ুন-

দেশজুড়ে বাঙালি খেদাও অভিযান! কী বলছে বাংলার বুদ্ধিজীবী মহল?

হরিয়ানা-দিল্লিতে বাঙালি নিপীড়নের আরেকটা বড় কারণ হিসেবে আমি দেখি ‘দাবাকে রাখনা’-কে। যাতে শ্রাবণে মাছ না খায় বাঙালি, নবরাত্রির আগে বাজারে-বাজারে এসে আমিষ বিক্রির বিরুদ্ধে ফতেয়া দিয়ে যায়। আবার তারাও যেন উত্তর ভারতের নানান আশ্রম নামক শপিংমলের অংশ হয়ে থাকে। সর্বোপরি, স্থানীয়দের ভয় পেয়ে চলে। কারণ ওরা নাকি দিল্লিতে আদি! আর একটা বড় কারণ, উত্তরপ্রদেশ, পাঞ্জাবের পর এ-দুই রাজ্যে বাঙালির সংখ্যাই বেশি। ক্ষমতার আসন দখলে রাখাটা জরুরি। সেটা রাজনৈতিক কারণেও। কারণ, সম্পূর্ণ বাঙালি জাতিটা এখনও সাম্প্রদায়িক হয়ে উঠতে পারেনি।  

ভিন রাজ্যে বাঙালি পরিযায়ী শ্রমিক

বিজেপি এইসব দাঙ্গাবাজদের প্রশ্রয় দেয় বাংলা দখল নেবে বলে। আর তৃণমূল সরকার ভোটের আগে পরিযায়ী বাঙালির ‘মসিহা’ হয়ে নিজের পিছনের দুর্নীতি, অপশাসনের কলঙ্ককে মুছতে চায়। কেউ-কেউ সন্দেহ প্রকাশ করে এসবই দুই দলের ‘মিলি ভগত’। নিন্দুকরা বলে বিজেপি আসলে চায়ই না বাংলায় রাজ করতে, তারা চায় দিদি থাকুক, বাকিটা মিলেমিশে থাকা যাবে। আমি সে-তর্কে যেতে চাই না। কিন্তু সরকারের কাছে প্রশ্ন রাখতে চাই। যখন আগের বছরগুলোতে এই বাঙালিদেরই দাঙ্গা করে তাড়িয়ে ছিল বিজেপির নানান শাখা সংঘটন, তখন তাদের নিয়ে যাওয়ার জন্য ট্রেন-বাস ছেড়ে দিন, একটা হেল্প লাইন নম্বরও দেননি, কেন?

আরও পড়ুন-

দেশ জুড়ে ‘বাঙালি খেদাও’, একটি নির্দিষ্ট শ্রেণির ক্ষেত্রেই কি প্রযোজ্য?

মনে আছে ২০২৩ সাল, অগাস্ট মাস। হরিয়ানা দাঙ্গা বিধ্বস্ত। মাত্র এক ঘণ্টার নোটিশে ঘর ছাড়তে হচ্ছে পরিযায়ী বাঙালি মুসলমানদের। সে-সময় আমার ফ্ল্যাটে কাজ করত যে মেয়েটি তার ফোন এলো রাতে। আমি সে-সময় ভোপালে। তার একটা গাড়ি দরকার। দিল্লি স্টেশন পর্যন্ত যাতে পৌঁছাতে পারে। হরিয়ানার রাস্তায়-রাস্তায় দাঙ্গাবাজেরা পাহাড়া দিচ্ছে। গাড়ি থামিয়ে চেক করছে ‘ওরা হিন্দু না মুসলিম’। শহর ছাড়তে চাইলেও ছাড়তে পারছে না রুকসানারা। সে-সময় বাংলায় ভোটের হাওয়া ছিল না অথবা বাংলার সরকার বধিরও ছিল না। কিন্তু এদের ফেরাতে ব্যবস্থা তো দূরে থাক, একটি প্রেসবিবৃতিও দেননি মুখ্যমন্ত্রী। যদিও চার মাস কাটতে না কাটতেই ওরা আবার ফিরে এসেছিল গুরগাঁও, ফরিদাবাদে। ফ্রি রেশনের লোভ দেখিয়ে বাংলার ওই প্রান্তিক জেলাগুলোর মানুষকে আটকে রাখতে পারেনি সরকার।

লকডাউনেও একই রাজনীতি হয়েছিল। মুখ্যমন্ত্রী ঘোষণা করেছিলেন, রাজ্য ছাড়বেন না, এখানে প্রচুর কাজ আছে। কিন্তু ফ্লাইট, ট্রেন একটু-একটু করে চলতে শুরু করতেই মাইগ্রেশন শুরু হয়ে গিয়েছিল বন্যার মতন। সরকার ভুলে যায়, মানুষ কাজ চায়, সরকারের দয়া চায় না। কাজ চায় নিজের যোগ্যতায়, আর চায় সুষ্ঠু কাজের পরিবেশ। বাংলার সরকার নিভৃতেও নিজের বুকে হাত দিয়ে বলতে পারবে না, পশ্চিমবঙ্গে কাজ পাইয়ে দেওয়া এবং কাজের শেষে তোলা নেওয়ার মাফিয়ারাজ নেই।

More Articles