রিচা-জেমিমাদের লড়াই মাঠ পেরিয়ে সমাজে

Women Players Harrasment: অলিম্পিক পদকজয়ী অ্যাথলিট মেরি কম পর্যন্ত বলেছিলেন, মহিলারা মাঠে লড়াই করেন আর মাঠের বাইরে টিকে থাকার জন্য আরও বড় লড়াই করেন।

MG

ইন্দোরে অস্ট্রেলিয়ান মহিলা ক্রিকেটারদের সঙ্গে যা ঘটেছে, তা শুধু এক 'দুঃখজনক ঘটনা' নয়, বরং এক জ্বলন্ত প্রশ্নচিহ্ন। ২০২৫ সালে, বিশ্বকাপ খেলতে আসা আন্তর্জাতিক খেলোয়াড়রাও যদি নিরাপদ না হন, তবে এই দেশের সাধারণ মহিলারা ঠিক কতটা নিরাপদ?

কিন্তু ঘটনাটি এখানেই থেমে যায়নি। কয়েক ঘণ্টার মধ্যেই মধ্যপ্রদেশের মন্ত্রী কৈলাশ বিজয়বর্গীয় মন্তব্য করেন— “ঘটনাটা দুর্ভাগ্যজনক, তবে এখন তাঁরা শিখবে... নিজের নিরাপত্তা নিয়ে ভাবতে হবে।” এই ‘শিখবে’ শব্দটাই আসলে পুরো সমস্যার প্রতিচ্ছবি। মহিলাদের উপর অপরাধ ঘটলে— সমাজ ও রাজনীতি প্রথমে তাদেরই শেখাতে চায়, অপরাধীকে নয়। ‘নিজের নিরাপত্তা’— নাকি নিজের দোষ? বিজয়বর্গীয়ের মন্তব্য আসলে ভারতীয় পুরুষতান্ত্রিক রাজনীতির পুরনো ছাঁচে ঢালা। যখনই কোনো নারী নির্যাতনের খবর আসে, কেউ না কেউ বলে—
“ওই সময় বাইরে যাওয়া ঠিক ছিল না”,
“পোশাকটা বোধহয় একটু আলাদা ছিল”,
“ওরাও সতর্ক হতে পারত।”
এগুলো শোনার পর মনে প্রশ্ন জাগে, দায় কার? ধর্ষকের, না ভুক্তভোগীর?

এই বক্তব্যগুলোই অপরাধীর দায়, ভুক্তভোগীর কাঁধে চাপায়। আর রাষ্ট্র নির্বিকার থাকে, এই ঘটনার নেপথ্যে যেন বড় কোনো সামাজিক অসুখ নেই। তবে এটাই প্রথম নয়। ২০২২ সালে কুস্তিগির বিনেশ ফোগাট, সাক্ষী  মালিক যৌন হয়রানির অভিযোগে ভারতীয় কুস্তি ফেডারেশনের প্রধান ব্রিজভূষণ সিং-এর বিরুদ্ধে সরব হয়েছিলেন। তখন তাঁদের বলা হয়েছিল, তাঁরা রাজনীতি করছেন। আবার ২০২৪ সালে দিল্লিতে এক আন্তর্জাতিক দৌড় প্রতিযোগিতায় দুই বিদেশি অ্যাথলিট, হয়রানির অভিযোগ আনলে কর্তৃপক্ষ বলেছিল, তাঁরা মিডিয়া-অ্যাটেনশন চান। আর এখন অস্ট্রেলিয়ান মহিলা ক্রিকেটাররা, যাঁরা বিশ্বকাপ খেলতে এসেছেন— তাঁদের বলা হচ্ছে, নিজেদের নিরাপত্তা দেখতে হবে। প্রশ্ন উঠছে, নারী কি সর্বদা নিজের দোষে আক্রান্ত হয়? আর রাষ্ট্রের কাজ কি তাহলে শুধু ‘পরামর্শ দেওয়া’? সুরক্ষা দেওয়া নয়?

আরও পড়ুন - মাঠে জয়, সমাজে লড়াই; খেলাধুলোর মেয়েরা যে লড়াই লড়ছে

খেলাধুলোর মাঠেও মহিলারা সবসময়ই টার্গেট। ক্রিকেটার, ফুটবলার, কুস্তিগির হোক বা অন্যান্য খেলোয়াড়েরা— রেহাই পাননি কেউই। ক্রীড়াজগৎ, যাকে একসময় মুক্তির মঞ্চ মনে করা হতো, তা কেবল পুরুষদেরই থেকে গেছে। সেখানে এখনও মহিলাদের বস্তু হিসেবেই দেখা হয়। ২০২৩ সালে পাকিস্তানে দুই মহিলা ফুটবলারকে প্রশিক্ষণের সময় কোচের বিরুদ্ধে হেনস্থা করার অভিযোগ ওঠে। ২০২৪ সালে ইংল্যান্ডে, এক ভারতীয় ক্রিকেটারকে অনলাইনে অশালীন মন্তব্যে ভরিয়ে দেওয়া হয়েছিল। এমনকি, অলিম্পিক পদকজয়ী অ্যাথলিট মেরি কম পর্যন্ত বলেছিলেন, মহিলারা মাঠে লড়াই করেন আর মাঠের বাইরে টিকে থাকার জন্য আরও বড় লড়াই করেন। এইরকম ঘটনার অজস্র উদাহরণ রয়েছে। বিশ্বকাপ সেমিফাইনালে অস্ট্রেলিয়ার মতো শক্তিশালী দলকে ভারতীয় খেলোয়াড়রা ক্রিকেটের মাঠে অনায়াসে হারাতে পারেন। কিন্তু, সমাজের মধ্যযুগীয় মানসিকতাকে হারানো বোধহয় ততটা সহজ নয়।

এই ঘটনা রাষ্ট্রের নির্লজ্জ নীরবতা দেখিয়েছে। কোনো দৃঢ় নিন্দা শোনা যায়নি। না কোনো তৎপরতা, না কোনো  সংবেদনশীলতা। এরপর যখন ক্ষমতাশীল দলের এক মন্ত্রী বলেন, 'ওরাও শিখবে'— তখন সেটি শুধুমাত্র ব্যক্তিগত মতামত থাকে না, বরং হয়ে ওঠে এমন এক রাজনৈতিক মানসিকতা, যেখানে মহিলাদের সুরক্ষার দায় তাঁদের নিজেদের। রাষ্ট্রের মৌলিক দায়িত্ব নাগরিকের সুরক্ষা। কিন্তু আজ বাস্তব চিত্র এমনই, যে, রাষ্ট্র মহিলাদের থেকে সতর্কতা চায়, কিন্তু পুরুষের থেকে আত্মসংযম নয়।

তাহলে কি সমাধান বন্দুকধারী প্রহরী? যদি প্রতিটি নারীকে বাঁচাতে নিরাপত্তারক্ষী রাখতে হয়,
তাহলে কি এই সমাজে প্রতিটি পুরুষই সম্ভাব্য ধর্ষক?
তাহলে কি মহিলাদের বাইরে যেতে হলে সশস্ত্র প্রহরার প্রয়োজন?

আরও পড়ুন - ক্রিকেট বিশ্বকাপের স্বপ্নভঙ্গ থেকে সাক্ষীর কুস্তি ত্যাগ, ফিরে দেখা ২০২৩-এর খেলার দুনিয়া

এই প্রশ্নগুলো এখন তীব্রতর হচ্ছে, কারণ প্রতিবার ঘটনার পর সরকার নিরাপত্তা বাড়ানোর কথা বলে, কিন্তু মানসিকতার পরিবর্তনের বিন্দুমাত্র দায় নেই তাদের। যে সমাজে নারীর স্বাধীন চলাফেরার জন্য ‘সুরক্ষা’ লাগে, সেই সমাজ আদপেই ব্যর্থ। মুখে মুখে, গণমাধ্যমে, নানা জায়গায় বলা হয়,“বেটি বাঁচাও, বেটি পড়াও”। কিন্তু সেই ‘বেটি’ যখন বিশ্ববিদ্যালয়ে যায়, বাস ধরে, অফিসে কাজ করে, হাসপাতালে যায়, খেলার মাঠে নামে, বা সন্ধ্যায় এক কাপ চা খেতে বেরোয় তখন সমাজ তাঁর পোশাক, তাঁর হাঁটাচলা, তাঁর বাইরে বেরোনোর সময়ের দিকে তাকিয়ে থাকে। তাহলে কি এখন থেকে প্রতিটি মেয়েকে হাতে অস্ত্র নিয়ে বেরোতে হবে? তাহলে কি এখন থেকে প্রতিটি মেয়ের স্বাধীনতা পুলিশি অনুমতিতে মাপা হবে? যদি তাই হয়, তবে এটা গণতন্ত্র নয়— এক ঘেরাও সমাজ। মহিলাদের স্বাধীনতা কেবল উৎসবের দিনে দেওয়া ফুল নয়— এটি রাষ্ট্রের, সমাজের, এবং প্রতিটি মানুষের দায়। যতক্ষণ না পর্যন্ত এই দায় স্বীকার করা হচ্ছে, ততক্ষণ পর্যন্ত প্রতিটি “ভুল ওরাও করেছে” মন্তব্যই অপরাধীদের সুযোগ দেওয়া।

অস্ট্রেলিয়ান ক্রিকেটাররা হয়তো এই ঘটনার পর আরও সতর্ক হওয়া শিখবেন। কিন্তু আমাদের সমাজ কি শিখবে? আমাদের দেশের রাজনৈতিক নেতা-নেত্রীরা কি বুঝবেন, ‘সতর্ক হও’ বলার চেয়ে ‘দায় নাও’ বলাটা অনেক বড় সাহসের কাজ? মহিলারা এখন শুধু শিকার নয়, সাক্ষীও। তাঁরা দেখছেন কীভাবে এই সমাজ তাঁদের স্বাধীনতাকে নিরাপত্তার মোড়কে বন্দি রাখছে।

সময় এসেছে স্বীকার করার, অপরাধীর নয়, মানসিকতার বিচার দরকার। কারণ, এই যুদ্ধ দুই ক্রিকেটারের নয়, প্রতিটি মহিলারই জীবনের যুদ্ধ।

More Articles