স্বাধীন কাজের ইন্দ্রজালে কীভাবে প্রতারিত হচ্ছেন গিগ শ্রমিকেরা?

Gig Workers : যদি ব্লিংকিট কোম্পানিকে জিজ্ঞেস করা হয়, আপনারা গিগ শ্রমিকদের ইচ্ছে মতো সময়ে কাজ করতে দেন? তাঁরা বলবেন, হ্যাঁ, যে যখন খুশি ঢুকতে পারে, যখন খুশি বেরোতে পারে। কিন্তু বিষয়টা আলাদা।

গিগ শ্রমিকদের সম্পর্কে যখনই কোনও কথা ওঠে, তখন প্রথমেই যে বাক্যবন্ধটির দ্বারা গিগ শ্রমিকদের সবার থেকে আলাদা করে দেওয়া হয়, তা হল, ‘গিগ শ্রমিকরা স্বাধীন’ বা ‘গিগ শ্রমিকদের কাজে অসম্ভব স্বাধীনতা রয়েছে’। আপনি যদি ভাবেন একটা বাইক নিয়ে বেরিয়ে খাবার ডেলিভারি করবেন, বা কোনও যাত্রীকে একটি জায়গা থেকে অন্য জায়গায় পৌঁছে দেবেন, তাহলে আপনি চাইলেই উবার, ওলা কিংবা ইন্ড্রাইভ প্রভৃতির অ্যাপে লগ ইন করেই কাজটিতে সংযুক্ত হতে পারেন। খাবারের ক্ষেত্রেও একই কথা বলা যায় সুইগি, জোম্যাটো ইত্যাদি অ্যাপগুলি সম্পর্কে। একইভাবে, আপনি যদি জরুরি পণ্য (যেমন, মুদিখানার মালপত্র, সবজি, ফলমূল) পৌঁছে দেওয়ার কাজ করতে চান, ব্লিংকিটের অ্যাপে লগ ইন করেই তা করতে পারেন।

এগুলো শুনলে মনে হয় গিগ শ্রমিকরা সত্যিই কত স্বাধীন! কারোর কাছে তাঁদের শ্রমের টিকিটি বাধা নেই। তাঁরা যেখানে খুশি নিজের শ্রম বিনিয়োগ করতে পারেন। নিজের ইচ্ছেমতো সময়ে অ্যাপ থেকে লগ আউট করে কাজ নাও করতে পারেন।

আরও পড়ুন-

দেশ জুড়ে বাঙালি পরিযায়ী শ্রমিক নির্যাতন কীভাবে থামাতে পারে সরকার?

 

পুঁজিবাদের শুরুর দিকে, যখন থেকে কলকারখানা তৈরি হচ্ছে, সেই সময় শ্রমিকদের বারো থেকে চোদ্দ ঘণ্টা করে খাটানো হত। তারপর অনেক লড়াই, আন্দোলনের পর শ্রমিকদের শ্রম-সময়কে আট ঘণ্টায় নামিয়ে আনা হয়। এখন আবার, গিগ শ্রমিকেরা আট ঘণ্টার অনেক বেশি সময় পরিশ্রম করছেন। কোম্পানিগুলি এমন ছকে তাঁদের আটকে রেখেছে যে, বাইরে থেকে দেখে মনে হয় গিগ শ্রমিকদের সারাদিনের কাজ স্বাধীনতায় পূর্ণ। কিন্তু আদতে তা নয়।গিগ শ্রমিকরা নিজেদের ইচ্ছেমতো দিনের যে-কোনও সময় কাজ করতে পারবেন— এই ধারণাটি শুনতে ভালো লাগে। প্রাথমিকভাবে হয়তো মনে হয় গিগ শ্রমিকদেরই হয়তো এতে লাভ হচ্ছে। কিন্তু এটা সম্পূর্ণভাবেই উপরিতলের সত্য। এর ভেতরের ছবিটা ঠিক কীরকম?

বিভিন্ন কোম্পানির গিগ শ্রমিক

দিল্লি হাইকোর্টের একটি কেস-এর কথা বলি। একজন মহিলা ক্যাব ড্রাইভারের একটি পিটিশন থেকে ঘটনাটি সকলের সামনে আসে। সেই মহিলা ক্যাব ড্রাইভার উবার-এর হয়ে ক্যাব চালান। মহিলাটি সন্তানসম্ভবা হওয়ার পর, উবার-এর কাছে মেটারনিটি লিভ-এর আবেদন করেন। তাঁর আবেদনের পরিপ্রেক্ষিতে উবার-এর কর্তৃপক্ষ জানান, “উনি (মহিলা ক্যাব ড্রাইভার) তো আমাদের কর্মচারী নন, উনি হয়তো কখনও ওলা-র হয়েও গাড়ি চালিয়েছেন, কখনও হয়তো ইন্ড্রাইভ-এর হয়েও গাড়ি চালিয়েছেন। ওর দায়িত্ব আমাদের কোম্পানি কেন নেবে?’

এখান থেকে স্পষ্ট হয়, যে স্বাধীনতার মোহ দেখিয়ে ক্যাব ড্রাইভারগুলিকে এই পেশায় নিয়ে এসেছে কোম্পানিগুলি সেই স্বাধীনতাকেই তাঁদের বিরুদ্ধে ব্যবহার করা হচ্ছে। আসলে এইভাবে ওলা-উবার-সুইগি-জোম্যাটো-ব্লিংকিট গিগ শ্রমিকদের প্রতি সাধারণ দায়িত্ব থেকেও নিজেদের স্বাধীন করে রাখছে। এ-কথা ঠিক যে কোম্পানিগুলি বলেছে, যখন খুশি লগ ইন ও লগ আউট করা যেতে পারে, কিন্তু এর বাইরেও অনেক নিয়মের বেড়া-জাল আটকে রেখেছে গিগ শ্রমিকদের।

যেমন, ব্লিংকিট-এর ক্ষেত্রে আমি ধরে নিচ্ছি একটি এলাকায় একটি ব্লিংকিট স্টোরে প্রতিদিন প্রায় দেড় হাজার অর্ডার আসে। সেখানে সেই স্টোরের গিগ শ্রমিকের সংখ্যা হয়তো আশিজন। এবার সেই আশিজন যদি ইচ্ছেমতো কাজে আসে তাহলে তো ব্লিংকিট গ্রাহকের কাছে পণ্য পৌঁছে দিতে পারবে না। তখন এই কোম্পানিগুলি কী করে? এরা গিগ শ্রমিকদের একটা ‘টার্গেট পয়েন্ট’ ঠিক করে দেয়। স্টোরের ম্যানেজার আগের দিন রাত্রিবেলায় একটা রোস্টার বানিয়ে দেন গিগ শ্রমিকদের। এবং দেখা যায়, দিনের যে-যে সময় সব থেকে বেশি ডেলিভারির চাপ থাকে, তখন গিগ শ্রমিকদের নিজেদের টার্গেট পূর্ণ করতে আসতেই হয়। ফলে, হিসেব করলে দেখা যায়, সারাদিনে দশ ঘণ্টার অনেক বেশি সময় কাজ করছেন একজন গিগ শ্রমিক। কিন্তু তাঁকে এমন কায়দায় আটকে রাখা হয়েছে যে সে কিছুই বলতে পারছে না।

আরও পড়ুন-

পরিযায়ী শ্রমিকরা কাজ চায়, সরকারের দয়া চায় না!

যদি ব্লিংকিট কোম্পানিকে জিজ্ঞেস করা হয়, আপনারা গিগ শ্রমিকদের ইচ্ছে মতো সময়ে কাজ করতে দেন? তাঁরা বলবেন, হ্যাঁ, যে যখন খুশি ঢুকতে পারে, যখন খুশি বেরোতে পারে। কিন্তু বিষয়টা আলাদা। অর্থাৎ কোম্পানিগুলি মুখে এসব কথা বলেও আসলে কিন্তু সেই বাধাধরা ছকেই গিগ শ্রমিকদের কাজ করাচ্ছে। শ্রম-সময়ের যে ছক বারো ঘণ্টা-চোদ্দ ঘণ্টা থেকে ৮ ঘণ্টায় নেমে এসেছিল, তা আবারও দশ-বারো ঘণ্টার দিকে চলে গেছে।

প্রশ্ন হল, তাহলে আসল স্বাধীনতা কাদের? যে স্বাধীনতার মোহে আমরা সুতোর টানে নাচছি, সুতোর পেছনে কারিগরদের স্বাধীনতা সেখানে কতটা আছে, কীভাবে আছে, সেটা যাচাই না করলে ‘স্বাধীনতা’ শব্দটির আসলে কাদের জন্য, তা বোঝা মুশকিল। এবং এই বিষয়গুলি যাচাই করলে তবেই একমাত্র শোষণের সঙ্গে গিগ শ্রমিকদের সম্পর্ক কোথায়, সেটাও বেরিয়ে আসবে।

More Articles