রাহুল গান্ধী, ক্রমেই ভরসাযোগ্য হয়ে উঠছেন যেভাবে
Rahul Gandhi : যত রাহুল গান্ধীর প্রতি সাধারণ মানুষের সমর্থন বাড়ছে, তত শাসকদল আরও হিংস্র হয়ে উঠছে। বিজেপি-র নেতারা হয়তো বুঝতে পারছেন যে তাঁদের পায়ের তলা থেকে মাটি সরে যাচ্ছে।
রাজনীতিতে ছবি কথা বলে। আগেও হয়তো কথা বলত। কিন্তু আজকের সামাজিক মাধ্যমে এক-একটি ছবি এমন বার্তা দিচ্ছে যে সারা দেশ নড়ে উঠছে সেই ছবি দেখে। বিরোধী দলনেতা রাহুল গান্ধীর ছবি তার একটি প্রকৃষ্ট উদাহরণ। সংসদভবনের মকরদ্বার থেকে বিরোধী সাংসদেরা বিক্ষোভ দেখাতে চলেছেন নির্বাচন কমিশনের দপ্তরের দিকে। সামনে থেকে নেতৃত্ব দিচ্ছেন রাহুল গান্ধী। কে নেই সেই বিক্ষোভে? কংগ্রেসের তরফ থেকে রাহুল গান্ধী, প্রিয়াঙ্কা গান্ধী তো আছেনই, সঙ্গে আছেন তৃণমূলের মহুয়া মৈত্র, সায়নী ঘোষ-সহ অন্যান্যরা। সিপিআইএম-এর জন ব্রিটাস, সিপিআইএমএল-এর রাজারাম সিং, সুদামা প্রসাদ, সমাজবাদী পার্টির অখিলেশ যাদব, আরজেডির মনোজ ঝা এবং আরও অনেকে আজ রাস্তায়। একটাই দাবি ‘চুনাব চোর গদ্দি ছোড়’ অর্থাৎ ভোট চোররা চেয়ার ছাড়ো। সবার একটাই দাবি সংসদে এই ভোট চুরি এবং বিহারের বিশেষ নিবিড় সংশোধনীর মধ্যে দিয়ে যে-অসাধুপথ অবলম্বন করছে বিজেপি তা নিয়ে আলোচনা করতে হবে, পরিচ্ছন্ন ভোটার তালিকা প্রকাশ করতে হবে। আঙুল তুলে হুঁশিয়ারি দিচ্ছেন দেশের বিরোধী দলনেতা রাহুল গান্ধী, এটাই এখন মূল আকর্ষণের কেন্দ্রীয়-ছবি।
বলা বাহুল্য, এই ছবি কিন্তু রাহুল গান্ধী একদিনে তৈরি করেননি, কিংবা কোনও ভোটকুশলী তাঁর এই ছবি তৈরি করে দেননি, যেমনটা করা হয়েছিল নরেন্দ্র মোদীর ক্ষেত্রে। এই ছবি তিল-তিল করে তৈরি হয়েছে। তার জন্য কেরালা থেকে কাশ্মীর ৫০০০ কিলোমিটার হাঁটতে হয়েছে তাঁকে। এমনি হাঁটা নয়, উত্তর থেকে দক্ষিণ, পূর্ব থেকে পশ্চিম মানুষের সঙ্গে পায়ে পা মিলিয়ে হাঁটতে হয়েছে। মানুষ সেই ছবি দেখেছে, তাঁর ব্যক্তিগত সততাকে কুর্নিশ জানিয়েছে।
আরও পড়ুন-
দেশ জুড়ে বাঙালি পরিযায়ী শ্রমিক নির্যাতন কীভাবে থামাতে পারে সরকার?
রাহুল গান্ধীর নিজের দলের মধ্যে থেকেই বহু প্রশ্ন উঠেছে, যে সারা ভারত-জুড়ে 'হেঁটে' কী হবে, কিন্তু তাও তিনি হেঁটে গেছেন, সাধারণ মানুষকে জড়িয়ে ধরেছেন, তাঁদের কাছে টেনে নিয়েছেন, কথা বলেছেন তাঁদের সঙ্গে। তাঁদের সুখ-দুঃখের অংশ যে তিনি হয়ে উঠতে পারেন, তা প্রতিদিন বুঝিয়েছেন। সেই জন্যেই শুধু দেশের বিরোধী সাংসদেরা নন, দেশের প্রতিটি কোণ থেকে সাধারণ মানুষ আজ রাহুল গান্ধীর পাশে দাঁড়াতে চাইছেন।

ভারত জোড়ো আন্দোলনের সময়
কোনও প্রচলিত সংবাদমাধ্যম তাঁকে দেখায়নি, তাঁর কাজ সম্পর্কে কোনও খবর করেনি, তিনিও তাঁদের এড়িয়ে গেছেন। ছোট-ছোট বিকল্প সংবাদমাধ্যম, ছোট ইউটিউবের মধ্যে দিয়ে তাঁর কথাকে সাধারণ মানুষের কাছে পৌঁছে দিয়েছেন রাহুল গান্ধী। মানুষের মধ্যে একটা কথা পৌঁছে দিতে তিনি সক্ষম হয়েছেন যে, এই বিজেপি-কে এবং তাঁদের দোসর সঙ্ঘ পরিবারকে আটকাতে পারলে একমাত্র তিনিই পারবেন। তাঁদের ঘৃণার রাজনীতির বিপরীতে তাঁর ‘ভালোবাসার দোকান’ মানুষের মনে দাগ কেটেছে বলেই আজকে তাঁর ছবি হয়তো দেশের প্রতিটি মানুষের মোবাইলে ঘুরছে। শুধু রাস্তায় নেমে নয়, তিনি এবং তাঁর দলের পক্ষ থেকে সামাজিক মাধ্যমে এই ‘ভোট চুরি’-র বিরুদ্ধে মতামত সংগঠিত করার জন্য প্রচার শুরু হয়েছে। নির্বাচন কমিশন এবং বিজেপি যে মিলেমিশে দেশের নির্বাচন লুট করছে, এ-কথা যাঁরা সমর্থন করছেন, তাঁদের জন্য একটা ‘মিসড কল নম্বর’ দেওয়া হয়েছে। ওই ফোন নম্বরে একদিনে ১৫ লক্ষ মানুষ ‘মিসড কল’ দিয়েছেন। অত্যন্ত দ্রুত হারে এই সমর্থন বাড়ছে।
যত রাহুল গান্ধীর প্রতি সমর্থন বাড়ছে, তত শাসকদল আরও হিংস্র হয়ে উঠছে। বিজেপি-র নেতারা হয়তো বুঝতে পারছেন যে তাঁদের পায়ের তলা থেকে মাটি সরে যাচ্ছে। সংসদ-বিষয়ক মন্ত্রী কিরণ রিজিজু সরাসরি হুমকি দিচ্ছেন, সংসদ চলতে না দিলে তাঁরা জোর করে বিল পাশ করাবেন। ইতিমধ্যেই বিরোধী সাংসদদের দমন করতে অকল্পনীয়ভাবে সিআরপিএফ বাহিনীকে রাজ্যসভায় নামানো হয়েছে। ভারতে যে আর গণতন্ত্র নেই, তা যে সংসদীয় ফ্যাসিবাদে রূপান্তরিত হয়ে গেছে, তা এখন সবাই স্বীকার করছেন। সেই কারণেই সমস্ত বিরোধী দল ধীরে-ধীরে ঐক্যবদ্ধ হচ্ছে। তাঁরা হয়তো বুঝতে পারছেন, যে এখনও যদি ছোট-খাটো বিষয়ে মতপার্থক্যকেই প্রধান করে রাখা হয় তাহলে আগামীদিনে আর কিছুই হয়তো অবশিষ্ট থাকবে না।
আরও পড়ুন-
দেশ জুড়ে ‘বাঙালি খেদাও’, একটি নির্দিষ্ট শ্রেণির ক্ষেত্রেই কি প্রযোজ্য?
প্রাক্তন কেন্দ্রীয় মন্ত্রী, ‘গোলি মারো শালো কো’ বলে বিখ্যাত হওয়া অনুরাগ ঠাকুর রাহুল গান্ধীর কায়দাতেই একটা সাংবাদিক সম্মেলন করে দেখানোর চেষ্টা করেছেন, বিরোধীরাও কারচুপি করেই ভোটে জিতে এখন সাংসদ হয়েছেন। এই বক্তব্য সামনে আসার পরে সাধারণ মানুষ কিন্তু বলছেন যে, তাহলে তো রাহুল গান্ধীর কথাই ঠিক!

বৃষ্টির মধ্যেই বক্তব্য রাখছেন রাহুল গান্ধী
২০১৪ সালে প্রধানমন্ত্রী হওয়ার আগে নরেন্দ্র মোদীর একটি ‘ছবি’ তৈরি করা হয়েছিল, যে-ছবিতে গুজরাট গণহত্যাকারীর পরিচয় পালটে, তাঁকে একজন বিকাশপুরুষ, উন্নয়নের কান্ডারী হিসেবে তুলে ধরা হয়। তাঁকে তাঁর পার্টি বলে দিয়েছিল, যদি কোনও সাংবাদিক তাঁর অতীত সম্পর্কে প্রশ্ন করেন, সেই প্রশ্নকে যেন তিনি এড়িয়ে গিয়ে ভবিষ্যতের কথা বলেন। সেইমতোই ঠিক স্ক্রিপ্ট মেনে তিনি কাজ করেছিলেন। মানুষের কাছে একটা বার্তা পৌঁছে দিতে চেয়েছিলেন যে দুর্নীতির পাঁকে জর্জরিত কংগ্রেসের থেকে তিনিই মুক্তি দিতে পারেন। মহিলাদের রক্ষা করতে পারেন একমাত্র তিনিই। সেই ছবি থেকে শ্লোগান তৈরি হয়েছিল ‘আব কী বার মোদী সরকার’ বা ‘বহুত হুয়া নারী পর অত্যাচার, আব কী বার মোদী সরকার’। মানুষের মনে একটা স্বপ্নকে বুনে দেওয়া হয়েছিল যে, ভারতকে এগিয়ে নিয়ে যেতে পারলে একমাত্র তিনিই পারবেন। তখন এমনও বাতাবরণ তৈরি করা হয়েছিল যে, ডলারের প্রেক্ষিতে ক্রমবর্ধমান টাকার দাম তিনিই কমাতে পারেন, পেট্রল-ডিজেলের দাম তিনিই কমাতে পারেন, বেকারদের তিনিই চাকরি দিতে পারেন।
বহু মানুষ তখন মোদী-র ওই বানিয়ে তোলা ছবি দেখে আশান্বিত হয়েছিলেন, কিন্তু সেই ছবির পিছনে যে-মুখটা লুকিয়ে ছিল তা প্রকাশ্যে আসার পরে বহু মানুষের মোহভঙ্গ হয়েছে। এগারো বছর পরে সেই ছবি আজ মলিন হয়ে গেছে, ওই ছবি আর কথা বলছে না। ওই ছবিকে আর কেউ বিশ্বাস করছেন না। সেই ছবির বিপরীতে এখন এক অন্য ছবিতে মানুষ ভরসা করতে চাইছেন। সেই ছবি, রাহুল গান্ধীর। সারা দেশেই তাঁর প্রভাব বাড়ছে। প্রদেশ কংগ্রেসের বহু মাথারা এখনও হয়তো এই কথাটা বিশ্বাস করতে পারছেন না, কিন্তু এটাই সত্যি যে আজ রাহুল গান্ধীর এই সামনে থেকে নেতৃত্ব দেওয়ার ছবি কিন্তু সাধারণ মানুষের মনে থেকে যাবে। মানুষ এই ছবিকে লালন করবে।

Whatsapp
